রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: তিয়াত্তর বছর বয়সে তিনি এক অভিনব পুজো করেন। খেলার পুজো! খেলার মাঠের পুজো! প্রকৃত সেবায়েতের মতো। প্রতি দিন ভোর- চলে যান। অনুশীলন চলে ঘণ্টা দু’য়েক। গাছের ডাল ভেঙে ‘হার্ডলস’ তৈরি করেন। তার পর সবেগে দৌড়ে এসে লাফ দেন। দোকানে গিয়ে ‘হার্ডলস’-এর সরঞ্জাম কেনার পয়সা নেই যে। কিন্তু তা বলে ট্রেনিংয়ে ফাঁক থাকলে চলে কখনও? দায়িত্ব বলে একটা বস্তু রয়েছে আসলে। দেশকে পদক জেতানোর দায়িত্ব। আর যে সে পদক নয়, মহাশয়। সোনা, একেবারে স্বর্ণপদক! চলতি মাসেই দু’খানা জিতে এলেন যেমন!
তিয়াত্তর বছর বয়সে আরাধ্য ঠাকুর-দেবতাকেও প্রাণপণে ডাকেন তিনি। প্রার্থনা করেন। উঁহু, অর্থকড়ি চান না। নিজের সুস্বাস্থ্যও কামনা করেন না। তবে শতায়ু প্রার্থনা করেন। কারণ, শত বছরেও তিনি মাঠে নামতে চান। দেশকে পদক দিতে। এক প্রবল বিশ্বাসে বশীভূত হয়ে তিয়াত্তরে যদি পারি, একশোতেও পারব! পারব তত দিন, জীবন থাকবে যত দিন!
দেখুন দেখি, গৌরচন্দ্রিকার ‘প্রকোপে’ ভদ্রলোকের নাম-ধাম-কীর্তি কিছুই এতক্ষণে লেখা হল না। ইনি, অমল কুমার বিশ্বাস। ডানলপের বাসিন্দা। আর কীর্তিখানা হল, তিয়াত্তর বছর বয়সে তিনি সাউথ এশিয়া মাস্টার অ্যাথলেটিক ওপেন চ্যাম্পিয়নশিপ মিট থেকে দু’টো সোনা এবং একটা করে রুপো-ব্রোঞ্জ জিতে ফিরেছেন! ফিরেছেন, এ মাসেই। অর্থাৎ, যে বয়সে আর পাঁচটা লোক হাসপাতাল আর ডাক্তার-বদ্যি করে কাটায়, শেষের প্রহর গোনে, সে সময় বঙ্গদেশের তিয়াত্তরের ‘তরুণ’ দেশকে জেতানোয় ব্রতী!
‘বাহাত্তুরে বুড়ো’-র প্রবাদটাই তুলে দেবেন নাকি আপনি? শুনে ফোনের ও পার থেকে হেসে ফেলেন অবসরপ্রাপ্ত বায়ুসেনা সার্জেন্ট। হুঁ, অতীতে তাই ছিলেন অমলবাবু। পরবর্তীতে পুলিশেও কাজ করেছেন। বলছিলেন, “খেলার মাঠের নেশা আমার ছোটবেলা থেকে। খুব অর্থাভাবে আমার শৈশব কেটেছে, জানেন? বাবা বলতেন, তোমার দু’টো সম্পদ। মাথা ও শরীর। একটা ভালো জীবন পেতে গেলে এ দু’টো তোমাকে ভালো রাখতে হবে।” তাই বলে তিয়াত্তরেও সে নেশা কাটবে না? “কাটল না তো। মাঝে মাঝে আমিও বুঝি না পারি কী করে? সাউথ এশিয়া মাস্টার অ্যাথলেটিক ওপেন মিট থেকে দু’টো বিভাগে সোজা জিতলাম। ৪x১০০ মিটার রিলেতে আর ৪x৪০০ মিটারে। আশি মিটার হার্ডলসে রুপো পেয়েছি। পনেরোটা দেশের প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছিল। মনে হয়, জীবনে ডিসিপ্লিনটাই ফ্যাক্টর হয়ে গেল। কখনও বিড়ি- সিগারেট ছুঁয়ে দেখিনি। চা পর্যন্ত খাই না। আমার মেরিট, আমার আত্মাকে দূষিত হতে দিইনি কখনও। খাবারদাবারও খাই অত্যন্ত মাপ মতো। তেল-ঝাল-মশলা ছুঁয়েও দেখি না। দাঁতের ডাক্তার ছাড়া জীবনে কখনও ডাক্তারের কাছে যাইনি,” গড়গড়িয়ে বলে চলেন তিয়াত্তরের ‘বিস্ময় যুবক।’
দেখতে গেলে, অমল কুমার বিশ্বাস বিস্ময়ই বটে। যে কোনও খেলা খেলতে ন্যূনতম একটা খরচ থাকে। কিন্তু সে খরচ চালানোর মতো ক্ষমতাও অমলবাবুর ছিল না। অগত্যা, গাছের ডাল। অগত্যা, নারকেল দড়ি! দুইয়ে জুড়ে ‘হার্ডলস’ তৈরি করে অনুশীলন চালানো। যে অনুশীলন করে-করে গোটা ষাটেক পদক আছে বাড়িতে। জিজ্ঞাসা করি, কাউকে বলেননি কেন কখনও? কত তো সুযোগ- সুবিধে আছে এখন। উত্তর আসে, “পারি না আমি। নিজের জন্য বলতে লজ্জা লাগে। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব, করি। শিরদাঁড়া সতেজ রাখার একটা যন্ত্র রয়েছে। নিজেই কিনেছি। আসলে দারিদ্রে ছোট থেকে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি আমি। অর্থের মোহ আমার নেই।” পদক ঠিকই আছে। সাধকদের জাগতিক মায়া-মোহ থাকে নাকি? আর কে না জানে, দিন শেষে খেলাধুলো সাধনারই সমনামী!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.