শুভময় মণ্ডল: প্রায় ৫০ হাজার লোক, যতদূর চোখ যায় লালে লাল পতাকায় ছেয়ে আছে। সুদূর মহারাষ্ট্রের এপাড়া, ওপাড়া, বেপাড়া থেকে জড়ো হয়ে নাসিক শহর থেকে মার্চ শুরু করে ১৮০ কিমি দূরে দেশের আর্থিক রাজধানী মুম্বই পৌঁছনোর। সেখানে তাঁরা বিধানসভা অভিযান করেন, মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁদের দাবি জানান। তবে কৃষকদের লং মার্চকে ঘিরে দেশ জুড়ে যা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে এবং মহারাষ্ট্র সরকারকে যেমন সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে তাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়তো হয়েছে, কৃষকদের দাবি-দাওয়াও মানা হয়েছে। কিন্তু তাতে লং মার্চকে কেন্দ্র করে দুটি মূলগত প্রশ্নের সমাধান দূর অস্ত।
প্রথম, একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণ রাষ্ট্রে শ্রম করে জাতির জন্য খাদ্যশস্য এবং শিল্পের জন্য কাঁচামাল উৎপাদন করা কৃষিজীবী সম্প্রদায়কে তাদের চাষবাস এবং ন্যূনতম খাদ্য গ্রহণের জন্য ঘর ফেলে ১৮০ কিমি পায়ে হেঁটে মুম্বই আসতে হল কেন? দ্বিতীয়, এই কৃষকদের তাঁর কুটির থেকে কে বের করে আনল?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর দ্বিতীয়টির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই মূলগতভাবে দুটিরই উত্তর একই বক্তব্য থেকে নিষ্কাশিত হয়। প্রথম প্রশ্নটির উত্তর, কৃষিনির্ভর ভারতবর্ষে কৃষির প্রতি ক্রমবর্ধমান অবহেলা। প্রথম কয়েকটি পরিকল্পনায় খাদ্য উৎপাদনে দেশকে স্বয়ম্ভর করার নিমিত্তে কৃষিতে সরকার মনোযোগ দিলেও, পরবর্তীকালে কৃষির আধুনিকীকরণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসলের বাজার তৈরি, দালাল-ফড়ে নিয়ন্ত্রণ করা এবং ফসলের ন্যায্যমূল্য কৃষকের হাতে পৌঁছনোর দাবিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সমাধান হিসেবে নেতা ধরে ব্যাংক লোন পাইয়ে দেওয়া এবং বেসরকারি উদ্যোগে ফসলের বাজার নির্মাণের মতো বিহিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় উপায়ে পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো কৃষিতে ধনী, উচ্চফসলী জমি অঞ্চলে সাফল্য দেখা গেলও মহারাষ্ট্রের মতো খরাপ্রবণ তুলা, বাজরা, ইক্ষু ও তৈলবীজ চাষ অধ্যুষিত অঞ্চলে লাভ হয়নি। বলা বাহুল্য, বহুজাতিক রিটেল চেন তুলা, বাজরা বা ইক্ষু কোনওটাই কেনে না। ফলে কৃষক ব্যাংক লোন ডিফল্টার হয়েছে এবং পরবর্তী বছর লোন না পেয়ে সাহুকার, জমিনদারের কাছে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়েছে। এখন চাষবাস করে এদের সুদ-সহ টাকা পরিশোধ কৃষকের সামর্থ্যের বাইরে, ফলে আত্মহত্যা ছাড়া গতি নেই। বছরের পর বছর সরকার পরিবর্তন হলেও মহারাষ্ট্র-কর্ণাটকের কৃষকদের এই জীবনদশার পরিবর্তন হয়নি। তাই জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী মহারাষ্ট্র কৃষক আত্মহত্যায় শীর্ষস্থানে।
কিন্তু হিসেব করে দেখলে দেখা যায় দেশের বড় রাজ্যগুলির মধ্যে মহারাষ্ট্র বেশ ধনী রাজ্য। দেবেন্দ্র ফড়ণবিসের বিজেপি সরকার আসার পর থেকেই মহারাষ্ট্র দেশের জিডিপি অবদানে তিন বছর ধরে শীর্ষস্থানে। কিন্তু কৃষির বিকাশদর কমছে। ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে যে কৃষির বিকাশ ছিল প্রায় ১০%, পরবর্তী দুটি অর্থবর্ষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭.৩%-এ। রাজ্যে উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু গ্রামীণ এবং কৃষিজীবী জনতা বাদ পড়েছে। উন্নয়ন রাজ্যের চারটে মহানগর আর শিল্পপতি- বৃহৎ ব্যবসায়ী সমাজের হাতে গিয়ে ঠেকেছে। আরও একটি প্রয়োজনীয় বিষয় হল, মারাঠওয়াড়ায় পওয়ার পরিবার এবং বিদর্ভে মুণ্ডে পরিবারের রাজনৈতিক জমিদারির অবসান হওয়া দরকার। এই ফড়েরা কৃষকদের দাবিকে গোষ্ঠী, জাত, সম্প্রদায়গত দাবিতে পরিণত করে কৃষকদের সমস্যাকে লঘু করে? সরকার এদের খুশি করেই আন্দোলনকে নিস্ক্রিয় করে দেয়। বস্তুত এবারও শিব সেনা আন্দোলনকে কতকটা দখল করে ফেলেছে। তাই ১৮০ কিমি পদযাত্রা করেও আন্দোলন সফল হবে কিনা, তা নিয়ে ওয়াকিবহাল সন্দিহান।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, কৃষকদের তাঁদের কুটির থেকে কে বার করে আনল? এক্ষেত্রে বিতর্কমূলক সোজা, স্পষ্ট, পরিষ্কার জবাব- কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। প্রশ্ন উঠতে পারে কৃষক সভার আন্দোলনকে ছোট করার কারণ কী? একথা সত্য সিপিএম নিয়ন্ত্রিত সারা ভারত কৃষক সভা কৃষকদের সংগঠিত করে আজ মুম্বই মহানগরী পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে এসেছে। তবেই আমরা তাদের সমস্যায় নজর দিতে বাধ্য হচ্ছি। এজন্য শত অভিনন্দন যথেষ্ট নয়, কিন্তু এই উদ্যোগের পিছনে রাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। তাছাড়া বামদলগুলি এই জাতীয় কর্মসূচি নির্দিষ্ট সময় অন্তর দেশের সবপ্রান্তে নিয়ে থাকে। কিন্তু এবার মানুষ তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়েছে রাজ্য সরকারের প্রবঞ্চনা এবং মোদি সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের গড়িমসি থেকে। রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের সময় বিজেপি কৃষকদের ঋণ মুকুবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সরকার গড়ার পর বিজেপি-শিব সেনা সরকার বাণিজ্যিক কোম্পানির মতো ঋণ মুকুবের ক্ষেত্রে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন লাগিয়ে দেয়। কৃষক সভার বক্তব্য মানলে এই শর্তপূরণে অপারগ হয়েই কৃষকরা পথে নেমেছে। দ্বিতীয় জন অর্থাৎ কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি ২০১৫-১৬ অর্থ বাজেটে কৃষিতে নজর দেওয়া এবং কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রাথমিকভাবে এর মেয়াদ পঞ্চদশ লোকসভা হলেও কোনও এক সর্বজনজ্ঞাত কারণে পৃথিবীর আহ্নিক গতিকে অস্বীকার করে মোদিবর্ষ ২০২২ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তাই ২০১৮-তেও কৃষি সংস্কার আশানুরূপ নয়।
মোদিজির আমলে প্রথম দুইবছর কৃষি উৎপাদনের হার বাড়লেও, বিমুদ্রাকরণ বর্ষ থেকে পিছতে শুরু করে। সেই বছর অর্থসংকটের জন্য চাষের কাজে বাঁধা এবং দুগ্ধ উৎপাদন বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরবর্তী বছরও ঘাটতি পূরণ করে উৎপাদন আশানুরূপ নয়। এই বাজেটে অর্থমন্ত্রীর পেশ করা তথ্য অনুযায়ী কৃষিতে উন্নয়নহার ছিল ৪.১%। এখন সমস্যা হল দেশের অর্থনীতির ১৮% জুড়ে থাকা কৃষিতে বৃদ্ধির হার ৫% এরও নিচে, কিন্তু তাঁর চেয়েও বড় চিন্তার বিষয় হল এই ১৮% অর্থনীতির উপর ৪৮% মানুষ নির্ভরশীল যার সিংহভাগই গ্রামীণ। এই বিপুল বৈষম্যের প্রতিকারকল্পে সরকারি নজর যদি না পড়ে তবে পথে নামা ছাড়া জনতার উপায় থাকে না। সেই হিসেবে দেখতে গেলে আজকের লং মার্চ বহুদিনের বঞ্চনার সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া। রাষ্ট্র তাতে নজর না দিলে ভবিষ্যতে বাড়বে বই কমবে না। বিগত ত্রিশ বছর ধরে কৃষির প্রতি যে অবহেলা হয়েছে তাঁর সম্পূর্ণ দায় নিশ্চয় মোদিজির নয়, কিন্তু তিনি জনগণকে যে আশা দেখিয়েছেন তা পূরণের দায় নিশ্চিতভাবেই তাঁর। সরকারের শ্যেন চক্ষুর ফাঁক গলে যদি কয়েক হাজার কোটি টাকা নীরব মোদি, মেহুল চোখসি, এ রাজা, কানিমোঝিরা নিয়ে যায় তবে সাধারণ মানুষের পথে নামা ছাড়া উপায় থাকে না। সরকারের মনে রাখা উচিত এখনও তারা গণতান্ত্রিক ভাবেই আন্দোলন করছে, সাতের দশকের নকশালবাড়ি বা কিছুবছর আগেও মাওবাদী আন্দোলনের নজির মনে রাখলে কৃষকদের দায়িত্ববোধকে সম্মান জানানো ছাড়া উপায় থাকে না।
বস্তুত একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কাজ করে মজুরি, ফসল ফলিয়ে ন্যায্য দাম পাওয়া বা আরেকটু এগিয়ে বললে নাগরিকের জীবন- স্বাধীনতা-সম্পত্তির রক্ষাকর্তা হিসেবে সরকারকে পছন্দ করার অধিকার সকলের আছে। সেই কাজে ব্যর্থ হলে প্রাথমিকভাবে সরকার এবং সর্বশেষ উপায় হিসেবে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তনে জনগণকে পথে নামার নির্দেশ রাষ্ট্রতাত্ত্বিকরাই দিয়ে গিয়েছেন। লক্ষ্যণীয়, ভারতবর্ষে কোনওদিনই পরিস্থিতি সেই পর্যায়ে পৌঁছয়নি। তবু দেশের ৪৮% জনগণ কেন কষ্টে রয়েছে তা নিয়ে বৃহত্তর চিন্তাভাবনা জরুরি। মনে রাখতে হবে, পেট ভর্তি থাকলে কেউ ১৮০ কিমি হেঁটে, রোদ মাথায় করে মুম্বই ভ্রমনে আসে না। আন্দোলনের চরিত্র লাল হোক বা গেরুয়া, মানুষের সম্মানজনক পরিস্থিতিতে সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার মৌলিক অধিকার। এই অধিকার উপলব্ধ করতে রাষ্ট্র বাধ্য।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.