সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: জ্যোতি মালহোত্রা। এক ‘সুন্দরী’ স্পাই। পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া এই ইউটিউবারকে নিয়ে আলোচনা বোধহয় আসমুদ্র হিমাচলকে ছাড়িয়ে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে গিয়েছে। ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যই হল নতুন একটা অধ্যায় হারানো সময়কে টেনে আনে। যে সময় লিখে রেখেছে এমনই বহু স্পাইয়ের কাহিনি। নুর ইনায়ৎ খান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অধুনাবিস্মৃত এই ‘স্পাই প্রিন্সেস’ তথা ‘গুপ্তচর রাজকন্যা’র নাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ব্রিটিশদের হয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করা এই তরুণী ছিলেন টিপু সুলতানের বংশধর! এই লেখায় আমরা ফিরে দেখব তাঁকেই।
১৯৪৩ সালের গ্রীষ্মকাল। প্যারিসে এলেন নুর। শুরু হল গুপ্তচর জীবন। কিন্তু ওই মুহূর্তে আসার আগে আমরা একটু পিছিয়ে যাব। ২৯ বছর পিছনে। ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি মস্কোয় জন্ম তাঁর। বাবা ইনায়ৎ খান। ছিলেন ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী। হায়দরাবাদের নিজামের থেকে পেয়েছিলেন ‘তানসেন’ উপাধি। কেবল গায়ক নয়, একই সঙ্গে কবি এবং দার্শনিকও ছিলেন বরোদায় জন্ম নেওয়া ইনায়ৎ। সুফিবাদ ছিল তাঁর অস্তিত্বের অংশ। এই মানুষটিক পূর্বসূরি ছিলেন টিপু সুলতান।
এদিকে ইনায়তের মা পিরানি আমিনা বেগমের মা ছিলেন মার্কিন নাগরিক। তখন অবশ্য তাঁর নাম ওরা রে বেকার। ইনায়তের আমেরিকা সফরের সময়ই তাঁদের আলাপ। সেখান থেকে মন দেওয়া নেওয়া। এরপর ইসলাম ধর্মাবলম্বী হন ওরা। তারপর বিয়ে করেন ইনায়তকে। এরপরই জন্ম তাঁদের প্রথম সন্তান নুরের (পরবর্তী সময়ে তাঁর আরও তিন ভাইবোন হয়)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে তখন আর সামান্য সময়ই বাকি। তাই রাশিয়া থেকে ব্রিটেনে উড়ে গেল ইনায়তের পরিবার। লন্ডনের পাশেই ব্লুমসবেরিতে থাকতে শুরু করে তারা। ১৯২০ সালে নটিং হিলে স্কুলে ভর্তি হন নুর। আরও পরে ফ্রান্সে চলে যান সকলে।
১৯২৭ সালে মৃত্যু হয় ইনায়তের। ১৩ বছরের শান্ত, লাজুক, স্বপ্নিল কিশোরী নুরের উপরই দায়িত্ব পড়ল ছোট ভাইবোন এবং শোকাবিষ্ট মাকে সামলে রাখার। সেসবের ফাঁকেই সঙ্গীতশিক্ষা, শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা। ধীরে ধীরে আরও বড় হয়ে ছোটদের জন্য ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় গল্প লেখা শুরু করলেন নুর। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হল তাঁর বইও। বছর পঁচিশ বয়স তখন নুরের। সেই সময় কে জানত এমন শান্তশিষ্ট নরম মেয়েটিই অচিরে গুপ্তচর হয়ে উঠবেন!
আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বহু কিছুই চিরতরে বদলে দিয়েছিল। নুরও সেই ঘূর্ণির ভিতরে পড়ে অসহায়ের মতো ভেসে যান। ততদিনে ফ্রান্স দখল করে নিয়েছে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। নুরের পরিবার অগত্যা ১৯৪০ সালে চলে গেল ব্রিটেনে। দার্শনিক বাসিল মিচেলের বাড়িতেই থাকতে শুরু করেন তাঁরা।
এদিকে নাৎসি তথা হিটলারের কারণেই বারবার এভাবে ঠাঁইনাড়া হতে থাকায় নুর এবং তাঁর ভাই বিলায়েতের মনে জন্ম নিচ্ছিল নাৎসিদের বিরুদ্ধে জাতক্রোধ। এরপরই তাঁর ‘উওম্যানস অক্সিলিয়ারি এয়ারফোর্স’-এ যোগ দেওয়া। সেখানেই ওয়্যারলেস অপারেটরের প্রশিক্ষণ নেওয়া। অপারেটর হিসেবে দ্রুত ও নিখুঁত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন নুর। আর সেই কারণে তিনি নজরে পড়ে গেলেন ১৯৪০ সালে স্থাপিত গোয়েন্দা সংস্থা এসওই-র (স্পেশাল অপারেশনস এগজিকিউটিভ)।
১৯৪৩ সালের ২৪ জুন। ‘প্রসপার’ নেটওয়ার্কের হয়ে কাজ করা শুরু নুরের। গেস্টাপোর নজর এড়িয়ে রেডিও অপারেটর হিসেবে লন্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চললেন তিনি। এদিকে ততক্ষণে ফ্রান্সে কর্মরত ব্রিটেনের সব গুপ্তচর ধরা পড়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় নুরকেও ব্রিটেনে ফিরে আসতে বলা হয়। কিন্তু তিনি রাজি হননি। কেননা সেক্ষেত্রে এখানে নাৎসিদের খবর লন্ডনে পৌঁছনোর কোনও উপায় থাকবে না। কিন্তু ৩ মাস কাজ করার পর ধরা পড়ে গেলেন নুর। সন্দেহ ‘ডবল এজেন্ট’ অঁরি দেরিকোর দিকে। সম্ভবত অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তি, উভয়ের হয়েই কাজ করা ওই ব্যক্তি ধরিয়ে দেন নুরকে।
কিন্তু দুর্ধর্ষ গেস্টাপো বাহিনীর সম্মুখীন হয়েও নুর ছিলেন অবিচল। কোনও তথ্যই তিনি জানাননি। বিভ্রান্ত করে গিয়েছিলেন নাৎসি বাহিনীকে। নভেম্বরে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল জার্মানিতে। অন্ধকার কারাগারে শিকলে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয় তাঁকে। পালাবার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। শোনা যায়, রাতের অন্ধকারে একক সেলের ভিতরে গুমরে কাঁদতেন। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন আর হাতে সময় নেই। এই জীবনে আর মা-ভাইবোনদের মুখোমুখি হওয়া হবে না। ১৯৪৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এল সেই দিন। ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি হন নুর। গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যান। আশি বছর পরের পৃথিবীতে তিনি যেন বিস্মৃত। ২০২০ সালের আগস্টে নুরকে সম্মানিত করা হয় ব্রিটেনের ‘ব্লু প্লেক’ সম্মানে। আজ নুর যেন এক রূপকথার চরিত্র। গত আট দশকে পৃথিবী বদলেছে আমূল। তবু সেই বদলানো পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসেন নুর ইনায়ৎ খান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.