Advertisement
Advertisement
Bangladesh

৩০ লক্ষ নিরীহ বাঙালির মৃত্যু! তবু একাত্তরের গণহত্যায় কেন নীরব আমেরিকা?

সারা বিশ্বের গণহত্যার ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

Write up on the genocide Bangladesh Can’t Forget
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:December 21, 2024 10:50 pm
  • Updated:December 21, 2024 10:50 pm  

বিশ্বদীপ দে: ”লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করো, দেখবে তাহলেই ওরা আমাদের পদলেহন করবে।” ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। হাইকমান্ডের সঙ্গে বৈঠক করছেন পাক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সেই সময়ই তিনি নাকি এমনটা বলেছিলেন। আর তারপরই পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণের পথ বেছে নেয় পশ্চিম পাকিস্তান। পরিকল্পনা করা হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর। জানা যায়, খানসেনার হত্যালীলায় সেই সময় প্রাণ হারান ৩০ লক্ষ নিরীহ মানুষ!

ইতিহাসে গণহত্যা বললেই অবধারিত ভাবে উঠে আসে নাৎসিদের ইহুদি নিধনের বীভৎস ইতিহাস। কিন্তু নিজের দেশেরই (সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানেরই পূর্ব প্রান্তের ভূখণ্ড) নাগরিকের উপরেই এমন হত্যালীলা নজিরবিহীন। ইউরোপ, জার্মানি অধিকৃত পোল্যান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়ন (আজকের রাশিয়া) মিলিয়ে ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত নাৎসিদের গণহত্যায় প্রাণ হারান প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি। অথচ বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) অত কম সময়ে ওই পরিমাণে মৃত্যুযজ্ঞ সেই তুলনায় যেন অনেক কম আলোচিত। গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন প্রতিদিন। এমন মৃত্যুহার গণহত্যার ইতিহাসে বোধহয় সবচেয়ে বেশি। তবুও কেন মার্কিন মুলুক এই ইতিহাস আজও সেভাবে স্মরণ করতে চায় না। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে যে তা ভোলা সম্ভব নয়। যতই ভুলিয়ে দেওয়ার প্রয়াস হোক।

Advertisement
মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান

কেন আমেরিকা এমন গণহত্যায় নীরব ছিল সেপ্রসঙ্গে আসার আগে একবার ফরাসি সাংবাদিক পল ড্রেফুসের এক মন্তব্য স্মরণ করা যাক। তিনি বলেছিলেন, ”বছরের পর বছর ধরে এক কুৎসিত ভাবে উত্থিত, অহংকারী অতিথির মতো আচরণ করেছে পশ্চিম পাকিস্তান। সেরা খাবারটা খেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এঁটোকাঁটা রেখে গিয়েছে।” এত অল্প কথায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসনকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ভৌগলিক ব্যবধানের মতোই অর্থনৈতিক অবস্থানের পার্থক্য এমনটাই ছিল একই দেশের দুই অংশের মধ্যে। এর মধ্যেই ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ঘোষণা করে দেশে নির্বাচন হবে। কিন্তু সেই নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও সভাপতি জেনারেল আগা মহম্মদ ইয়াহিয়া খান ওই নির্বাচনে কোনওরকম হস্তক্ষেপের প্রয়োজন অনুভব করেননি। তাঁর ধারণা ছিল শেখ মুজিবর রহমানের জেতার সম্ভাবনা ততটা নেই।

এমনও শোনা যায়, পাক গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অন্য কথা বলছিল। কিন্তু তাতে পাত্তা দেননি ইয়াহিয়া। শেষমেশ অবশ্য দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামি লিগই বেশি ভোট পেয়েছে। এই ফলাফলে আঁতকে ওঠেন ইয়াহিয়া। আর তারপরই তিনি বৈঠক ডেকে মার্শাল ল প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ৫০ হাজার মানুষের সামনে আইন অমান্যের ঘোষণা করেন মুজিব। পরিস্থিতি ক্রমেই আগুনে হয়ে উঠতে থাকে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শুরু হয়ে গেল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। গ্রেপ্তার হলেন মুজিব। ৬০ থেকে ৮০ হাজার পাক সেনা ঢুকে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। ৯ মাস ধরে চলতে থাকা গণহত্যা কাড়ে ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণ। সংখ্যাটা এর বেশি না কম তা নিয়ে নান বিতর্ক হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের এক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো সিজা কার্টিস বলছেন, ”সংখ্যা যাই হোক না কেন, স্পষ্টতই বাঙালিদের ওপর ব্যাপক নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছিল।”

Eastern Command Lt. Gen remembers Bangladesh Liberation War

জানা যায়, কেবল ২৫ মার্চ রাতেই খানসেনার হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫০ হাজার মানুষ। আর সেই সঙ্গেই ছিল নারী নির্যাতন, লুটপাট! এক অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক জিওফ্রে ডেভিস সেই সময় ঢাকায় এসেছিলেন রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি পরে জানিয়েছিলেন, ২ থেকে ৪ লক্ষ মহিলা ধর্ষিতা হয়েছিলেন সেই সময়।

এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমেরিকার কী ভূমিকা ছিল তা আজও আলোচনায় উঠে আসে বারবার। সেই সময় আমেরিকার মসনদে রিচার্ড নিক্সন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী বই ‘ফরগটেন জেনোসাইড’-এ দাবি করা হয়েছে, ১৯৭১ সালে কিসিঞ্জারই নিক্সনকে অনুরোধ করেন পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষেই থাকা উচিত আমেরিকার। অথচ সেই সময় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্চার ব্লাডের মত ছিল ভিন্ন। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল তিনি বলেন, ”আমাদের সরকার গণতন্ত্রের অবদমনকে দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নৃশংসতার নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছে… আমাদের সরকার যা করেছে তাকে অনেকেই অনেকেই নৈতিক দেউলিয়াপনা বলে মনে করবে।” সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এই গণহত্যাকে ‘আধুনিক সময়ের ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্নের একটি’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু এসব কথায় কান না দিয়ে কিসিঞ্জার লাগাতার নিক্সনকে বোঝাতে থাকেন ইয়াহিয়ার পাশে থাকার জন্য। নিক্সনও সেই পরামর্শই মেনে নিতে থাকেন। আসলে সেই সময় সোভিয়েতের সঙ্গে আমেরিকার ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ চরমে। আর সেই লড়াইয়ের কথা মাথায় রেখেই চিনকে পাশে চাইছিল মার্কিন প্রশাসন। যেপথে যেতে হলে ইয়াহিয়ার হাত ধরাই সঠিক পথ বলে মনে হচ্ছিল। তাই পাকিস্তানকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে আমেরিকা। এবং এর ফলে ভারতের আরও কাছে চলে আসে সোভিয়েত। ১৯৭১ সালে দুই দেশ স্বাক্ষর করে শান্তি চুক্তিতে।

Nixon

আর এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের একদিকে ভারত-সোভিয়েত, অন্যদিকে পাকিস্তান-আমেরিকা-চিন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আর সেই রাজনৈতিক তথা কূটনৈতিক লড়াইয়ে বাংলাদেশের গণহত্যাকে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় খুঁজে পায়নি আমেরিকা। যা আজও নিরন্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক আলোচ্য বিষয় হয়েই রয়ে গিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ফের ফিরিয়ে আনছে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস।

ইন্দিরার সঙ্গে নিক্সন

মনে করাচ্ছে শামশুর রহমানের সেই অমর পঙক্তি, ‘অভিশাপ দিচ্ছি ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার কানায়-কানায় রক্তে উঠবে ভরে,/ যে রক্ত বাংলায় বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র জোয়ারের মতো।’ সেই রক্তস্রোতকে আমেরিকা যতই অস্বীকার করুক, বর্তমান বাংলাদেশ প্রশাসন চেষ্টা করুক মুছে দিতে… ইতিহাস হারায় না। থেকে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement