Advertisement
Advertisement

প্রমাণ কই যে কান্দাহার থেকে আসোনি…

কবীর সুমনের সাপ্তাহিক কলাম।

Kabir Suman pens weekly column

ছবি প্রতীকী

Published by: Subhamay Mandal
  • Posted:August 4, 2018 5:19 pm
  • Updated:August 4, 2018 5:19 pm

বিজ্ঞান বলে, মানুষ নামে এই প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছিল মধ্য আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে। এই কথাটি পড়েই কেউ কেউ হয়তো মাত মাত করে উঠবেন। বলবেন, ‘না, ঠিক মধ্য আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে নয়, সরাসরি দক্ষিণেই।’ কিন্তু আমাদের উৎপত্তি যে অযোধ্যা বা কিষ্কিন্ধা নয়, আফ্রিকা- তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে তো আমরা সবাই সবার ভাই-বোন। ইয়া বড় এক দুনিয়ার একদিক থেকে অন্যদিকে হেঁটে গিয়েছে মানুষ। যে যেখানে পেরেছে, চেয়েছে বসত গেড়েছে, সেখানকার লোক হয়ে উঠেছে। কবীর সুমন

‘আমার নাম হিজিবিজ্‌বিজ্‌। আমার নাম হিজিবিজ্‌বিজ্‌, আমার ভায়ের নাম হিজিবিজ্‌বিজ্‌, আমার বাবার নাম হিজিবিজ্‌বিজ্‌, আমার পিশের নাম হিজিবিজ্‌বিজ্‌–’ আমি বললাম, ‘তার চেয়ে সোজা বললেই হয় তোমার গুষ্টিশুদ্ধ সবাই হিজিবিজ্‌বিজ্‌’। সে আবার খানিক ভেবে বলল, ‘তা তো নয়, আমার মামার নাম তকাই। আমার মামার নাম তকাই, আমার খুড়োর নাম তকাই, আমার মেশোর নাম তকাই, আমার শ্বশুরের নাম তকাই–’
(হ য ব র ল, সুকুমার রায়)

Advertisement

আমার নাম সুমন। আমার বাবার নাম সুধীন্দ্রনাথ। আমার বাবার বাবার নাম নারায়ণদাস। বাবার বাবাকে নাকি দেখেছি খুব ছোটবেলায়। মনে পড়ে না ভাল করে। মনে পড়ে বরং তাঁর মৃত্যুর পর বেহালায় আমার বড় জ্যাঠা আর মেজো জ্যাঠার বাড়ির সামনে একটা বৃষ পোঁতা হয়েছিল। টোটেম। বড় হয়ে জেনেছি। আশ্চর্য, সেই টোটেমটা মনে আছে, নারায়ণদাসকে না। তিনি যে আমার বাবার বাবা সেটা জেনেছিলাম আমার মায়ের কাছে। তার বাইরে প্রমাণ? আজ যদি বাংলাবিদ্বেষী, বাঙালিবিদ্বেষী মনুসংহিতা দলের কোনও জল্লাদ এসে বলে, ‘প্রমাণ কর‌ নারায়ণদাস চট্টোপাধ্যায় তোর বাবার বাবা’, কী করে করব? অথবা যদি বলে, ‘তোরা আসলে লাহোর থেকে এসেছিলি তিন পুরুষ আগে।’ কী করে প্রমাণ করব আমরা বরাবর এখানকার লোক?

Advertisement

আব্বুলিশ! সত্যিই কি তাই? আমার বাবার বাবার বাবার বাবা লাহোর বা সমরখন্দ বা কান্দাহার বা ইস্তানবুল থেকে আসেননি তা প্রমাণ করব কী করে, আর কেনই বা করব? আমার বাবার বাবারও বাবা ছিলেন নিশ্চয়ই। রূপকথার সারস নিশ্চয়ই আমার বাবার বাবাকে তঁার মায়ের কোলে টুক করে ফেলে দিয়ে যায়নি। আমার বাবার মা বাবা জন্মানোর ছ’মাসের মাথায় মারা যান। তাঁর নাম? জানি না। তাঁর বাবা-মায়ের নাম? জানি না। তাঁদের পদবিও কি চট্টোপাধ্যায় ছিল? হয়তো। কিন্তু, ধরা যাক চার পুরুষ বা সাত পুরুষ আগে? আজ কিন্তু আমি বা আমার গুষ্টির অন্য কেউ বলতেই পারবে না। মণ্ডল বা বাগদি? একেবারে অসম্ভব কি? আমার পদবি যেমন আইনত ‘সুমন’। আমার পাসপোর্টে লেখা নাম: কবীর। পদবি (Surname): সুমন। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের এফিডেভিটের মাধ্যমে বিধিবদ্ধ করা– তা সে এক শ্রেণির ধর্মান্ধ, একবগ্‌গা প্রগতিশীল বাঙালি আজকের বাংলায় ও বাংলাদেশে যতই অস্বীকার করতে চান। আজ যদি আমার কোনও সন্তান হয় তার পদবি হবে ‘সুমন’। আমার বাবা-মায়ের দেওয়া নামটিকে আমি আমার পদবি বানিয়ে ছেড়েছি।

[জাতীয় রাজনীতি ও মেরুকরণের মডেল]

আমার যৌবনে আমি দেখেছিলাম আমার পরিচিত এক বাঙালি যুবক যাঁর পদবি ছিল ‘দাস’, একটি চাকরি পাওয়ার জন্য চেষ্টাচরিত্তির করে ‘সিং’ পদবিটি নিয়েছিলেন। গোপাল দাস থেকে তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল গোপাল সিং। এমন ঘটনা আরও অনেক ঘটেছে এদেশে। বাংলা পত্রিকার বিজ্ঞাপনে চোখ বোলালে পদবি ও নাম পরিবর্তনের বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে বইকি। ২০০০ সালের একদিন কলকাতার এক বড় পত্রিকায় আমার নাম পালটানোর বিজ্ঞপ্তি পড়ে এক অভিভাবকস্থানীয় বন্ধু ফোন করে আমায় নতুন নামে ডেকেছিলেন। আমার পরিচিত ও বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ আমায় ‘কবীর’ ও ‘কবীরদা’ বলে ডাকেন, যেমন সুমন মুখোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু এবং আমার ছাত্রছাত্রীরা। সত্যি বলতে, আমায় ‘কবীর’ নামে ডাকলে বেশ লাগে।

তাহলে নাম পালটানো সম্ভব। ধামও। আমার বাবার দেশ কলকাতা। আমার বাবার বাবার দেশ নাকি জয়নগর। নিশ্চিত হব কী করে? সবটাই ‘নাকি’। আমার হাতে বা দেরাজে কোনও কাগজ নেই যা আমার বাবার বাবার দেশের প্রমাণ দেবে। আর তাঁর বাবা বা মা? ‘নাকি’ দিয়েও কিছু বলা যাবে না, বলা যায়নি। তাঁরা বা তাঁদের আগের পুরুষ যে অন্য কোনও দেশ থেকে এসে কোনও এক উপায়ে ‘চট্টোপাধ্যায়’ পদবিটি জোগাড় করেননি, তার প্রমাণ কী? পদবি এদিক-ওদিক আমাদের দেশে কোনও বড় ব্যাপারই নয়। ভারতের এক কূটনীতিক আমায় বলেছিলেন, উপমহাদেশে নাকি আঠেরোটি Alias বা ওরফে সম্ভব।

[অসমে ৪০ লক্ষ বাঙালির এখন ডিটেনশন ক্যাম্পের আতঙ্ক]

এত বড় দুনিয়া। এতকালের দুনিয়া। বিজ্ঞান বলে, মানুষ নামে এই প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছিল মধ্য আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে। এই কথাটি পড়েই কেউ কেউ হয়তো মাত মাত করে উঠবেন। হয়তো বলবেন, ‘না, ঠিক মধ্য আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে নয়, সরাসরি দক্ষিণেই।’ কিন্তু আমাদের উৎপত্তি যে অযোধ্যা বা কিষ্কিন্ধা নয়, আফ্রিকা– তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে তো আমরা সবাই সবার ভাই বোন। ইয়া বড় এক দুনিয়ার একদিক থেকে অন্যদিকে হেঁটে গিয়েছে মানুষ। যে যেখানে পেরেছে, চেয়েছে বসত গেড়েছে, সেখানকার লোক হয়ে উঠেছে। অসমে বিজেপি যা করছে, এরপর হয়তো অবিজেপি-অনসমিয়া বিশেষ করে অহিন্দুদের, অথবা আরও বিশেষ করে হিন্দু বলো-মুসলমান বলো বাঙালিদের আফ্রিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে- যেখান থেকে মানুষ ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর দিকে দিকে।

(মতামত নিজস্ব)
[email protected]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ