বছর আসে বছর যায়, প্রতিবছরই তৈরি হয় ছোটবড় হাজারো খবর। এদের মধ্যে কোনও তলিয়ে যায় কালের গর্ভে আবার কোনও খবর চিরন্তন ছাপ রাখে, অমোঘ হয়ে থাকে স্মৃতিতে। বছর শেষে এমনই কিছু খবরে আলোকপাত করছে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল, যেগুলি গোটা বছর ছিল শিরোনামে।
রাফালে: রাফালে যুদ্ধবিমান এখন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর মূল অস্ত্র। রাহুলের অভিযোগ ফ্রান্সের কোম্পানি দাসাল্ট অ্যাভিয়েশনের কাছে যুদ্ধবিমানে কেনাবেচার চুক্তিতে বড়সড় দুর্নীতি হয়েছে। ইউপিএ জমানার থেকে বেশি দাম দিয়ে যুদ্ধবিমান কিনছেন মোদি, সেই সঙ্গে সরকারি সংস্থা হ্যালকে বঞ্চিত করে বন্ধু অনিল আম্বানির সংস্থাকে রাফালের বরাত পাইয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এই রাফালেকে অস্ত্র করেই প্রধানমন্ত্রীকে ‘চোর’ বানানোর চেষ্টা করছেন রাহুল। তাঁর দেওয়া স্লোগান ‘চৌকিদার চোর হ্যায়..’ রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। যদিও, সুপ্রিম কোর্ট রাফালে নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে। তবে কংগ্রেসের দাবি, ইচ্ছাকৃতভাবে সর্বোচ্চ আদালতকে ভুলপথে চালনা করেছে সরকার। এই নিয়ে এখনও তরজা চলছে সংসদে।
কাঠুয়া গণধর্ষণ: কাশ্মীরের আট বছরের বালিকাকে সাতদিন আটকে রেখে লাগাতার গণধর্ষণ। তারপর নির্মমভাবে খুন। ফুটফুটে মেয়েটি আদরের ঘোড়াটিকে চরাতে চরাতে চলে গিয়েছিল বাড়ির অদূরে বনের ধারে। তারপর সাতদিন কোনও খোঁজ নেই। সাতদিন পর জঙ্গলের ধারেই উদ্ধার হয় তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। দেবস্থানে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আটক অবসন্ন মেয়েটিকে সাতদিন ধরে ধর্ষণ করে ছ-জন। এদের মধ্যে দুজন পুলিশকর্মী। এমনকি মীরাট থেকেও লালসা মেটাতে ডেকে নিয়ে যায় ঘটনার মূলচক্রী দেবস্থানের কেয়ারটেকার। ক্ষুধার্ত, মৃতপ্রায় মেয়েটিকে খুনের আগেও রেয়াত করা হয়নি। গলায় ফাঁস দিয়ে মারার আগেও তাকে শেষবারের মতো ধর্ষণ করে এক পুলিশ কর্মী। তারপর মুখ-মাথা পাথর দিয়ে থেঁতলে মারা হয় মেয়েটিকে। দেহ ফেলে দেওয়া হয় জঙ্গলের পথে। নির্ভয়া কাণ্ডের মতোই ভয়াবহ ঘটনায় আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একজন নাবালকও ছিল। তারপর কয়েক মাস ধরে এই ঘটনা শিরোনাম হয়ে থাকে দেশের। সেলেব থেকে শুরু করে ক্রীড়াবিদ, প্রত্যেকেই এই ঘটনাকে লজ্জা বলে উল্লেখ করেন। তারপর শুরু হয় এই নিয়ে রাজনীতি। জম্মু-কাশ্মীরে সম্পর্ক খারাপ হয় দুই জোট শরিক বিজেপি ও পিডিপির। মামলা এখনও বিচারাধীন। তবে এই ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
#MeToo: একটা ঝড় বললেও ভুল বলা হবে না। যার জেরে রেহাই পায়নি রাজনীতি থেকে বিনোদন, অর্থনীতি থেকে খেলার দুনিয়া। সোশ্যাল মিডিয়ায় মহিলাদের হেনস্তার অভিযোগ একে একে MeToo হ্যাশট্যাগ দিয়ে পোস্ট করতে থাকেন মহিলারা। প্রথম হেনস্তার অভিযোগটি এসেছিল নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে, এনেছিলেন তনুশ্রী দত্ত। এরপর একে একে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এম জে আকবর থেকে শুরু করে অভিনেতা অলোক নাথ, অনু মালিক, পরিচালক সাজিদ খান, এমনকী বিসিসিআই প্রশাসনক রাহুল জোহুরি পর্যন্ত এই ঝড়ে আক্রান্ত হন। এর জেরে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয় আকবরকে। পদ হারাতে হয় বহু সেলিব্রিটিকে।
বিচারপতি বিদ্রোহ: বছরের শুরুটা হয়েছিল নজিরবিহীন ঘটনা দিয়ে। ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের চার বিচারপতি। বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি মদন লেকুর, বিচারপতি জে চেলামেশ্বর এবং বিচারপতি কুরিয়েন জোসেফ বেনজিরভাবে সাংবাদিক বৈঠক করে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বিচারপতি চেলামেশ্বর বলেন, বিচারব্যবস্থা নিরপেক্ষ না হলে গণতন্ত্র বাঁচবে না। দেশের গণতন্ত্রের অস্তিত্ব বিপন্ন। বিচারের নামে চলছে বিনয়ম। মামলা বণ্টনের ক্ষেত্রে পক্ষপাত হচ্ছে। আদালতের প্রশাসন ঠিকমতো চলছে না।
সিবিআই বিতর্ক: শুধু বিচারব্যবস্থা নয়, এবছর নজিরবিহীন টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয় সিবিআইয়ের অন্দরেও। সিবিআইয়ের দুই শীর্ষ আধিকারিক অলোক ভার্মা এবং রাকেশ আস্তানা একে অপরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু করে দেন। বিরোধীদের অভিযোগ, রাকেশ আস্তানার সাহায্যে সিবিআইয়ের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করছিল সরকার। বিদ্রোহ এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, আস্তানাকে গ্রেপ্তার করার প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন অলোক ভার্মা। শেষ পর্যন্ত দুই আধিকারিককেই অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাদের পরিবর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সিবিআই প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয় নাগেশ্বর রাওকে।
উর্জিত প্যাটেলের পদত্যাগ: দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সঙ্গে বিবাদের জেরে পদ ছাড়তে বাধ্য হলেন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর উর্জিত প্যাটেল। এর আগেই সরকারের বিরুদ্ধে আরবিআইয়ের কাজে হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনেছিলেন রিজার্ভ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য্য। এর জেরেই উর্জিত পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বলে ধারণা অর্থনীতিবিদদের। যদিও, উর্জিত পদত্যাগপত্রে ব্যক্তিগত কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর পরিবর্তে শক্তিকান্ত দাসকে নতুন আরবিআই গভর্নর করা হয়েছে।
পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন: সাম্প্রতিক রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন ছিল রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা এবং মিজোরামে। পাঁচ রাজ্যেই পরাস্ত হয়েছে বিজেপি। হিন্দি বলয়ের তিন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যেই সরকার গড়েছে কংগ্রেস। তেলেঙ্গানায় জিতেছে টিআরএস, মিজোরামে জিতেছে এমএনএফ। মিজোরাম, তেলেঙ্গানায় কার্যত ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে বিজেপি।
মোদিতে অনাস্থা: অন্ধ্রপ্রদেশেকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনে টিডিপি। কিন্তু বিরোধীদের সেই প্রস্তাব ভোটাভুটিতে খারিজ হয়ে যায়। প্রত্যাশিতভাবেই লোকসভায় আস্থা ভোটে জয়ী হয় এনডিএ সরকার। অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে মাত্র ১২৬টি। অনাস্থা প্রস্তাবের বিপক্ষেই বেশিরভাগ সাংসদ সমর্থন করেন। সরকারপক্ষে ভোট পড়ে ৩২৫টি ভোট। তবে, অনাস্থা প্রস্তাবের থেকেও বেশি শিরোনামে আসে সংসদে মোদি-রাহুল দ্বন্দ্ব। বক্তব্য শেষে রাহুলের মোদিকে আলিঙ্গন এবং শেষে চোখ মারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক আলোচনার শীর্ষে ছিল।
পঞ্চায়েত ভোট ও হিংসা: প্রত্যাশিতভাবে পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যের বেশিরভাগ আসনে জয় পায় শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। সবকটি জেলা পরিষদই দখল করে রাজ্যের শাসকদল। কিন্তু বিজেপি তথা অন্য বিরোধীদের দাবি ছিল, পঞ্চায়েতে বেনজিরভাবে হিংসা ছড়িয়ে সাফল্য পেয়েছে শাসকদল। এবছর পঞ্চায়েত ভোটে রেকর্ড সংখ্যক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। অন্যদিকে, তৃণমূলস্তরে রাজ্যের তিন বিরোধী দল সিপিএম-বিজেপি-কংগ্রেসকে একসঙ্গেও লড়তে দেখা গিয়েছে অনেক জায়গায়।
বিতর্কের নাম যোগী: নামে কী এসে যায়! হয়তো অনেক কিছুই। নাহলে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এভাবে নাম বদলের পিছনে পড়বেন কেন? মোঘলসরাই থেকে পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন, ফৈজাবাদ থেকে অযোধ্যা। বছরভর যোগী আদিত্যনাথের নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল নাম বদলের পালা। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কিছু মিমও ছড়িয়েছে যোগীর নাম বদল নিয়ে। তবে, শুধু নাম বদল নয়, যোগী এবার বিতর্কে জড়িয়েছেন হনুমানের জাত নির্ধারণ করতে গিয়েও। বছর শেষে রাজস্থানে ভোটের প্রচারে গিয়ে তিনি বলে বসেন হনুমান নাকি দলিত। বেজায় চটে যায় মরুরাজ্যের একাধিক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। ভোটের ফলেও প্রভাব পড়ে যোগীর এই মন্তব্যের।
বিজেপির রথযাত্রা: বছরের শেষে মেগা রথযাত্রার আয়োজন করে ধামাকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বঙ্গ বিজেপি। সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ছাড়াও বিজেপির প্রথম সারির একগুচ্ছ নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাদ সাধল প্রশাসন। রথযাত্রার অনুমতি মিলল না। শেষবেশ বাধ্য হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয় বিজেপি। কিন্তু আদালতে এখনও পর্যন্ত টানাপোড়েন চলছে।
পাক মসনদে ইমরান: প্রত্যাশিতভাবেই পাকিস্তানের মসনদে বসলেন ইমরান খান। ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ, সহজেই হারিয়ে দিল নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) এবং বিলাওয়াল ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে। চিরাচারিত দুই দলীয় ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় আনল পাকিস্তান। মসনদে বসেই ভারতের উদ্দেশ্যে শান্তির বার্তা দিয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী।
খেলার মাঠে বল বিকৃতি: এবছর মার্চ মাসে অস্ট্রেলিয় ক্রিকেটের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত হল। বল বিকৃতিতে অভিযুক্ত হয়ে নির্বাসিত হলেন অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ, সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার এবং মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ক্যামেরুন ব্যানক্রফ্ট। স্মিথ ও ওয়ার্নারকে নির্বাসিত করা হয়েছে ১ বছরের জন্য, ব্যানক্রফ্ট নির্বাসিত হন ৯ মাসের জন্য।
বিতর্কে মিতালি: বছরশেষে বিতর্ক স্পর্শ করে গেল মহিলা ক্রিকেটের অন্যতম সেরা তারকা মিতালি রাজকেও। বিশ্বকাপ চলাকালীন মিতালিকে সেমিফাইনালে না খেলানো নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে। এরপরে কোচ রমেশ পওয়ারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই অভিযোগ তোলেন মিতালি। প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়কের অভিযোগ ছিল, কোচ রমেশ পওয়ার এবং অধিনায়ক হরমনপ্রিত ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে জাতীয় দল থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে। এরপরে এই বিতর্কের জেরেই পদ হারাতে হয় কোচ রমেশ পওয়ারকে।
অলঙ্করণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়