Advertisement
Advertisement
Hasina

আজও তাড়া করে বেড়ায় ১৫ আগস্টের বিভীষিকা, স্মৃতিচারণ হাসিনার

কেমন ছিল সেই ১৫ আগস্ট? শোনালেন হাসিনা

Bangladesh PM Sheikh Hasina recalls 15 August horror | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:August 15, 2023 10:24 am
  • Updated:August 15, 2023 10:24 am

১৫ আগস্ট বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি শোকাবহ দিন। এদিন বিশ্বে একমাত্র ভাষা ও জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র দেশের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের মাত্র দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া পরিবারের ১৮ সদস্যকে একই সময়ে বাংলাদেশ বিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। দিনটি যেমন বাঙালিদের কাছে বেদনা আর শোকের, অন্যদিকে আদর্শকে বলীয়ান আর চেতনাকে শানিত করারও দিন। আজও মুজিবকন্যাকে তাড়া করে বেড়ায় ১৫ আগস্টের বিভীষিকা। স্মৃতি হাতড়ে দুনিয়া কাঁপানো দিনগুলির কথা শোনালেন শেখ হাসিনা  

 

Advertisement

সাতের দশকে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে এক কোটি বাঙালি পশ্চিমবঙ্গ ও আগরতলায় আশ্রয় নেয়। ভারত এদের খাদ্য-বস্ত্রের ব্যবস্থা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অস্ত্র সহায়তা দেয়। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের নিয়ে গঠিত হয় মিত্রবাহিনী। তাঁরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ৯ মাস পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। প্রথম দিকে ভারত-ভূটান-রাশিয়া-সহ গুটিকয়েক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনি মোস্তাক-জিয়া সরকারকে স্বীকৃতি দেয় চিন। যে চিন আজ ব্যর্থ পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশকে পাশে পেতে মরিয়া। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানের পক্ষ নেয় চিন, আমেরিকা-সহ মুসলিম দেশগুলি। তারা অস্ত্র-সহ সকল সহযোগিতা দান করে।

Advertisement

তবে এই দিনটি আজও তাড়া করে বেড়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কেমন ছিল সেই ১৫ আগস্ট? শোনালেন হাসিনা

তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এমন সময় প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ। এ গোলাগুলির আওয়াজ ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি ঘিরে, যে বাড়িতে বসবাস করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক বিঘা জমির উপর খুবই সাধারণ মানের ছোট্ট একটা বাড়ি। মধ্যবিত্ত মানুষের মতই সেখানে বসবাস করেন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি সবসময়ই সাধারণ জীবনযাপন করতেন। এই বাড়ি থেকেই ১৯৭১ সালের ২৬-এ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যে সংগ্রাম, এই বাড়িটি তার নীরব সাক্ষী। সেই বাড়িটিই হল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে আজানের ধ্বনি হারিয়ে যায়।

রাষ্ট্রপতির বাসভবনের নিরাপত্তায় সাধারণত সেনাবাহিনীর ইনফেন্ট্রি ডিভিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মাত্র ১০-১২ দিন পূর্বে বেঙ্গল ল্যান্সার অফিসার ও সৈনিকদের এ দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ছিল দেশের মানুষের প্রতি অঢেল ভালোবাসা। তিনি সকলকেই অন্ধের মত বিশ্বাস করতেন। তিনি কখনও এটা ভাবতেও পারেননি যে, কোন বাঙালি তাঁর ওপর গুলি চালাতে পারে বা তাঁকে হত্যা করতে পারে। তাঁকে বাঙালি কখনও মারবে না, ক্ষতি করবে না – এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি চলতেন।

চারদিকে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ। বিকট শব্দে মেশিনগান হতে গুলি করতে করতে মিলিটারি গাড়ি এসে দাঁড়ালো ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির সামনে। গুলির আওয়াজে ততক্ষণে বাড়ির সকলেই জেগে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল দ্রুত নিচে নেমে গেল রিসেপশন রুমে – কারা আক্রমণ করল, কী ঘটনা জানতে। বাবার ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বিভিন্ন জায়গায় ফোন করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোন সাড়া পাচ্ছিলেন না।

সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কামাল বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখেন বাড়ির গেট দিয়ে মেজর নূর ও ক্যাপ্টেন হুদা এগিয়ে আসছে। কামাল তাদের দেখেই বলতে শুরু করলো: আপনারা এসে গিছেন, দেখেন তো কারা বাড়ি আক্রমণ করলো? কথা শেষ হতে পারলো না। তাদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠল। কামাল সেখানেই লুটিয়ে পড়ল। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর নূর আর কামাল একইসঙ্গে কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। আর সেই কারণে ওরা একে অপরকে ভালভাবে চিনতো। নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করল সহযোদ্ধা কামালকে। কামাল তো মুক্তিযোদ্ধা। দেরাদুন থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে যায় যুদ্ধ করতে। এরপর বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন শেখ কামালকে নিয়োগ করে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে।

মেজর সৈয়দ ফারুক ট্যাঙ্ক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি লক্ষ্য করে লাগাতার গুলি চালাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী প্রধান সফিউল্লাহ সাহেবকে ফোন করেন। তাঁকে জানান বাড়ি আক্রান্ত। তিনি জবাব দেন: আমি দেখছি। আপনি পারলে বাইরে কোথাও চলে যান। এর মধ্যে ফোন বেজে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরিয়াবাত ফোনে জানান, তাঁর বাড়ি কারা যেন আক্রমণ করেছে। শেখ মুজিব আওয়ামি লিগ নেতা আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে ফোন করেন। আবদুর রাজ্জাক বলেন: লিডার দেখি কী করা যায়। আবদুর রাজ্জাক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। তোফায়েল আহমেদ ফোনে বলেন: আমি দেখছি। রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে বঙ্গবন্ধু বলতে থাকেন: আমি কী করব? তোফায়েল আহমেদ রক্ষী বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিচে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হন। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মীনী পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দেন। কথা বলতে বলতে তিনি সিঁড়ির কাছে পৌঁছন। এ সময় সিড়ির মাঝের প্ল্যাটফর্মে যারা দাঁড়িয়েছিল তারাও দোতালায় উঠে আসছিল। এদের মধ্যে হুদাকে চিনতে পারেন বঙ্গবন্ধু। তার বাবার নাম ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন: তুই রিয়াজের ছেলে না? কী চাস তোরা? কথা শেষ করতে না করতেই গর্জে উঠে ওদের হাতের অস্ত্র। তাদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই যোগ দিয়েছিল রিসালদার মোসলেউদ্দিন।

ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে সিঁড়ির উপর লুটিয়ে পড়লেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মীনী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সিড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ঘাতকের দল ততক্ষণে ওপরে উঠে এসেছে। বেগম মুজিবকে তারা বাঁধা দিয়ে বললো আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন। তিনি বললেন: আমি এক পা-ও নড়ব না, কোথাও যাব না। তোমরা উনাকে মারলে কেন? আমাকেও মেরে ফেলো। ঘাতকদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠল। বেগম মুজিব লুটিয়ে পড়লেন।

বঙ্গবন্ধুর পুত্র কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল ও মেঝো ছেলে জামালের স্ত্রী রোজী জামালকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করে ঘাতকরা। বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে ১০ বছরের রাসেল গৃহকর্মী রমাকে জড়িয়ে ধরে এক কোণে দাঁড়িয়েছিল। একজন সৈনিক রাসেল আর রমাকে ধরে নিচের তলায় নিয়ে যায়। একইসঙ্গে বাড়িতে আরও যারা ছিল তাদেরও নিচে নিয়ে দাঁড় করায়। গৃহকর্মী আবদুল গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তাকেও নিয়ে যায়। বাড়ির সামনে আম গাছতলায় সকলকে দাঁড় করিয়ে একে একে পরিচয় জিজ্ঞেস করে। বঙ্গবন্ধুর ছোটভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের পঙ্গু ছিলেন। তিনি বারবার মিনতি করছিলেন: আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা; আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে মেরো না। ছোট ছোট বাচ্চারা আমার, ওদের কী হবে? কিন্তু খুনিরা কোন কথাই কানে নেয় না। তাঁর পরিচয় পেয়ে তাঁকে অফিস ঘরের বাথরুমে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

রমার হাত ধরে রাসেল “মা’র কাছে যাব, মা’র কাছে যাব” বলে কান্নাকাটি করছিল। রমা বারবার ওকে বোঝাচ্ছিল: তুমি কেঁদো না ভাই। কিন্তু অবুঝ রাসেল মায়ের কাছে যাব বলে কেঁদেই চলছে। এ সময় একজন পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় পেয়ে বলে: চলো, তোমাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসি। ভাইয়ের লাশ, বাবার লাশ মাড়িয়ে রাসেলকে টানতে টানতে দোতলায় নিয়ে মায়ের লাশের পাশেই গুলি করে হত্যা করে। দশ বছরের ছোট্ট শিশুটাকে ঘাতকের দল বাঁচতে দিল না। যে বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই বাড়িটি রক্তে ভেসে গেল। সেই রক্তের ধারা ওই সিঁড়ি বেয়ে বাংলার মাটিতে মিশে গেছে- যে মাটির মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন।

সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ জিয়াউর রহমান কোন ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেননি বরং সে পুরো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। খুনি রশিদ ও ফারুক বিবিসি-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমদ হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিজেকে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়।

ঘাতকেরা ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নের বাড়িতে আক্রমণ হয় রিসালদার মোসলেউদ্দিনের নেতৃত্বে। বুটের আওয়াজ আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযোদ্ধা যুবনেতা, দৈনিক বাংলার বাণী ও ডেইলি টাইমসের সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এ সময় তাঁর অন্তঃসত্তা স্ত্রী আরজু ছুটে এসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঘাতকদের বুলেট থেকে বাঁচাতে। কিন্তু ঘাতকের দল তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি করে। বুলেটের আঘাতে দুজনের শরীর ঝাঁজরা হয়ে যায়। ছোট দুই ছেলে- তিন বছরের তাপস (এখন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র) আর বছর পাঁচেকের পরশ (যুবলিগ সভাপতি), মা-বাবার লাশের পাশে এসে চিৎকার করতে থাকে আর বলতে থাকে: মা ওঠো, বাবা ওঠো। শিশুদের চোখের জল মা-বাবার রক্তের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়।

গুলি করতে করতে মেজর সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মেজর এ এম রাশেদ চৌধুরী মিন্টু রোডে বঙ্গবন্ধুর সেজ ভগ্নিপতির সরকারি বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে যায়। পরিবারের সকল সদস্যকে তাঁদের ঘর থেকে বের করে নিচতলায় বসার ঘরে নিয়ে আসে। এর পর তাদের উপর ব্রাশ ফায়ার করে। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুর বোন আমিনা সেরনিয়াবাত, ভগ্নিপতি কৃষিমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রব সেরিয়াবাত, তাঁর মেয়ে বিউটি, বেবি, রিনা, ছেলে খোকন, আরিফ, বড় ছেলে আবুল হাসানাত আবদুল্লার স্ত্রী শাহানা, নাতি সুকান্ত, ভাইয়ের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহিদ, ভাগ্নে রেন্টু। আট বছরের নাতনি কান্তা গুলিবিদ্ধ লাশের নিচে চাপা পড়ে যাওয়ায় বেঁচে যায়। দেড় বছরের নাতি সাদেক গুলিবিদ্ধ মায়ের বুকে পড়ে কাঁদতে থাকে। আট বছরের কান্তা বেবির লাশের নিচে চাপা পড়েছিল। সেখান থেকে কোনও মতে বের হয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। সারি সারি গুলিবিদ্ধ আপনজন পড়ে আছে। কারও নিথর দেহ, কেউ বা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ঘরের কোণায় রাখা অ্যাকুরিয়াম গুলি লেগে ভেঙে যায়। অ্যাকুরিয়ামের জলের সঙ্গে মাছগুলি মাটিতে পড়ে যায়। রক্ত ভেজা জলে মাছগুলিও ছটফট করে লাফাতে থাকে। কিছুক্ষণ আগে যে আপনজন মা, বাবা, দাদা-দাদি, চাচা-সহ সকলকে নিয়ে এই শিশুরা ছিল, আর এখন গুলিবিদ্ধ রক্তে ভেজা আপনজন। লাশের নিচ থেকে নিজেকে বের করে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে ৮ বছরের শিশুটি অবাক বিস্ময়ে ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকে।

মেজর ফারুক ট্যাঙ্ক নিয়ে লেকের ওপার থেকে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। সেই গুলি মোহাম্মদপুরে এক বাড়িতে পড়ে। সেখানে ১১ জন মানুষ নিহত হন আরও অনেকেই জখম হয়। মেজর ডালিম রেডিও স্টেশন দখলের দায়িত্বে ছিল। সেখান থেকেই সে ঘোষণা দেয়: শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। ঘাতকেরা শুধু হত্যা করে তাই নয়, তারা বন্ধুর বাড়ি লুটপাট করে। শোবার ঘরে এবং ড্রেসিং রুমের সকল আলমারি, লকার সবকিছু ভেঙ্গে সেখান থেকে যা কিছু মূল্যবান ছিল – গহনা, ঘড়ি, টাকা-পয়সা লুটপাট করে নিয়ে যায়। বাড়িতে ব্যবহার করা গাড়িটাও মেজর হুদা ও নূর নিয়ে যায়। আলমারির সব কাপড় চোপড় বিছানার ওপর পড়েছিল। সেগুলোর অনেকগুলোতে ছিল রক্তের দাগ। এই হত্যাকান্ডের পর লুটপাটের ঘটনা মনে করিয়ে দেয় ওদের চরিত্রের অন্ধকার দিকটা।

সত্যি কী বিচিত্র এ দেশ! একদিন যে মানুষটির একটি ডাকে এদেশের মানুষ অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বিজয় এনেছিল, বীরের জাতি হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে মর্যাদা পেয়েছিল, আজ এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে সেই জাতি সমগ্র বিশ্বের কাছে বিশ্বাসঘাতক জাতি হিসেবে পরিচিতি পায়। খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীদের এদেশের অগণিত জনগণ ঘৃণা করে এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে।

বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই নাসেরের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ছ’জন সন্তান নিয়ে চরম বিপদের সম্মুখীন হন। খুলনায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতেন। সে বাড়ি থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা হয়। টুঙ্গিপাড়ার বাড়িও সিল করে রাখা হয়। ঘরবাড়ি হারা সদ্য বিধবা কোথায় ঠাঁই পাবেন? বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওনা হন। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাঁর গাড়ি আটকে দেয় ঘাতকেরা। তিনি এগুতে চাইলে ঘাতকেরা তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। বাড়ির নিচে পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্য এসআই সিদ্দিকুর রহমানকেও তারা গুলি করে হত্যা করে।

ক্রিং ক্রিং ক্রিং …। টেলিফোনটা বেজেই যাচ্ছে। হাসিনার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ালেন। দেখেন নিচে অ্যাম্বাসেডর সানাউল হক সাহেব ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, স্বামী বিজ্ঞানী ওয়াজেদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমি তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। অপর পারে জার্মানির অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ সাহেব কথা বলছেন। তিনি জানালেন বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। আমার মুখ থেকে বের হল: “তাহলে তো আমাদের আর কেউ বেঁচে নাই”। রেহানা পাশে ছিল। তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু তখনও জানি না কী ঘটনা ঘটেছে। মাত্র ১৫ দিন আগে জার্মানি এসেছি। বেলজিয়ামে বেড়াতে গিয়েছিলেন। নেদারল্যান্ডসেও গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, নেদারল্যান্ডসে কীভাবে সাগর থেকে ভূমি উত্তোলন করে – পারলে একবার দেখে এসো। একদিন আগেই বাবা-মার সঙ্গে কথা হয়েছে। কেন জানি মা খুব কাঁদছিলেন। বললেন “তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, তুই আসলে আমি বলবো।” আমাদের খুব খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল তখনই দেশে ছুটে চলে যাই। শেখ মুজিব বলেছিলেন: রোমানিয়া ও বুলগেরিয়াতে তিনি যাবেন। আর ফেরার পথে আমাদের নিয়ে আসবেন। কিন্তু আমাদের আর দেশে ফেরা হল না। একদিন পরই সব শেষ। বেলজিয়ামের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক, যিনি রাজনৈতিক সদিচ্ছায় অ্যাম্বাসেডর পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন, রাতারাতি তার চেহারাটাই পালটে গেল। তিনি জার্মানিতে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ সাহেবকে বলেন, যে বিপদ আমার কাঁধে পাঠিয়েছেন তাঁদের ফেরত নেন। আমরা তার কাছে আপদ হয়ে গেলাম। আমাদের বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাড়িটাও দিলেন না। পায়ে হেঁটে নোম্যান্স ল্যান্ড পার হয়ে জার্মানির মাটিতে পৌঁছলাম। জার্মানির অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ সাহেব গাড়ি পাঠিয়েছেন। আর তাঁর স্ত্রী আমার বাচ্চাদের জন্য শুকনো খাবার-দাবারও গাড়িতে দিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে কয়েকদিন আশ্রয় পেলাম। তাঁদের আদর যত্ন দুঃসময়ে আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান। হুমায়ুন রশীদ ও তাঁর স্ত্রীর অবদান। জার্মান অ্যাম্বাসির সকল অফিসার ও কর্মচারি আমাদের অত্যন্ত যত্ন করেছিলেন। অ্যাম্বাসির গাড়িতে আমাদের কার্লস রুয়ে পৌঁছে দিলেন। জার্মান সরকার, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-সহ আরও অনেকে আমাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চাইলেন। জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের অ্যাম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ ও ডক্টর ওয়াজেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি আমাদের ভারতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন। আমরা জার্মানি থেকে ভারতে পৌঁছালাম।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রক্তাক্ত বেদনার আঘাত বুকে ধারণ করে পথচলা। বাবা মা ভাইদের হারিয়ে ভারতে ৬ বছর অবস্থানের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। একটি প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছিলেন, যে বাংলাদেশ আমার বাবা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, তা ব্যর্থ হতে পারে না। লাখো শহিদের রক্ত আর আমার বাবা-মা ভাইদের রক্ত ব্যর্থ হতে আমি দেব না। আমার চলার পথ খুব সহজ ছিল না, বারবার আমার উপর আঘাত এসেছে। মিথ্যা অপপ্রচার, ১৮ বারেরও বেশি গুলি, বোমা ও গ্রেনেড হামলার শিকার হতে হয়েছে। খুনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া বিভিন্ন সময় বলেছিল, “শত বছরেও আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না।” “শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও কখনও হতে পারবে না।” এর পরেই তো সেই ভয়াবহ ২০০৪ সালের ২১-এ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। আওয়ামি লিগের নেতাকর্মীরা মানবঢাল রচনা করে সেদিন শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জনগণের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।

১৯৭১-এর প্রতিশোধ আর স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পথচলা থামিয়ে দেওয়াই ছিল জাতির পিতাকে হত্যার মূল লক্ষ্য।

সপরিবারে জাতির পিতার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় যে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছিল, নিজেদের রক্ষার জন্য তারা বেশ তৎপর ছিল। জেনারেল জিয়া ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স-সহ সকল অবৈধ ও অসাংবিধানিক আইনকে বৈধভাবে প্রণীত আইন বলে ঘোষণা দিলেন, যা ছিল সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। জাতির পিতার হত্যার বিচার বন্ধ ছিল প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে।

বাংলাদেশ আওয়ামি লিগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে সংসদে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করেছিল। এর ফলে প্রচলিত আদালতে সপরিবারে জাতির পিতার হত্যার বিচার শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর উচ্চতর আদালতে এই মামলার কার্যক্রম উদ্দেশ্যমূলকভাবে থামিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামি লিগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে সরকার গঠন করার পর উচ্চতর আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ক্ষেত্রে বিএনপি-জামাতের সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত হয় এবং বহু প্রতীক্ষিত এই বিচার সম্পন্ন হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন খুনি এখনও বিদেশে পলাতক থাকায় রায় এখনও সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করা যায়নি।

[আরও পড়ুন: সেপ্টেম্বরেই ভারতে হাাসিনা, চিনা চাল ভেস্তে নতুন পথে দিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক]

বাংলাদেশের এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে জাতির পিতার অবদান নেই। বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না। ১৫ আগস্টের নির্মমতা, নৃশংসতা আর পৈশাচিকতা সকল বর্বরতা ও নির্মমতাকে হার মানিয়েছিল। জাতির পিতার বত্রিশের বাড়ি থেকে বাংলাদেশ জন্ম লাভ করেছিল, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই বাড়িতেই তাঁকে গোটা পরিবারসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হাজার বছরেও এ কলঙ্ক মোচন হবেনা। জনকের ঋণ কোনোদিন শোধ করা যাবেনা? জাতির পিতার হত্যাকারী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী ও তাদের সুবিধাভোগীরা জাতির পিতার সত্তাকে ভীষণ ভয় পায়। মৃত্যুর পর তাঁর লাশ নিয়েও তাদের অনেক শঙ্কা ছিল। যে কারণে পরিবারের সবার লাশ ঢাকায় দাফন করলেও পিতার লাশ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাদের এতো বেশি ভয় ছিল যে, তারা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ৭ মার্চের ভাষণসহ তাঁর নামটি পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে পিতার আদর্শের মশাল প্রজ্বলিত করেছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে—বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। এই বাংলাদেশ এক উদীয়মান নক্ষত্র, এই বাংলাদেশ অদম্য, এই বাংলাদেশ অকুতোভয়।খুনি চক্র জানতো না যে, জাতি বেঁচে থাকলে জাতির পিতাও বেঁচে থাকে। রাষ্ট্র বেঁচে থাকলে সেই রাষ্ট্রের জনকও বেঁচে থাকে। পিতা আর জনকের কোনও মৃত্যু নেই। যতদিন এই বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে, এই রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু তাঁর মহান কীর্তির জন্য ততদিন বেঁচে থাকবেন। যতদিন এই পৃথিবীতে বাঙালি জাতি বেঁচে থাকবে, ততদিন পিতা বঙ্গবন্ধুর নাম তাদের হৃদয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানচিত্রের সঙ্গে মিশে আছে। ওই মানচিত্রের লালবৃত্ত, সে-তো তাঁরই মুখচ্ছবিl ওই সংবিধানের আদর্শের কথাগুলো, সে-তো তাঁরই কথাl বাংলাদেশের প্রতিটি দিন,তাঁরই দিনl বঙ্গবন্ধু মেঘনার প্রতিটি স্রোত আর বঙ্গোপসাগরের প্রতিটি সাহসী ঢেউ।

(সুকুমার সরকার, সংবাদ প্রতিদিন-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি)

[আরও পড়ুন: বাংলাদেশে শুরু নির্বাচনী তোড়জোড়, ‘পাশে থাকবে ভারত’, বিশ্বাস আওয়ামি লিগের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ