সুকুমার সরকার, ঢাকা: ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি ভারতীয়রাও রক্ত দিয়েছেন। এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাদ্য দিয়ে সহায়তা করেছে। সেই সম্পর্কের তুলনা অন্য কারও সঙ্গে হতে পারে না বলেই জানাচ্ছে ঢাকা (Dhaka)।
তবে ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষ ও গত সপ্তাহে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে ১৫ মিনিট কথা বলেছেন।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চিন সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর চিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তবে হালে বাংলাদেশ ও চিন সম্পর্ক অনেক মজবুত। পয়লা জুলাই থেকে বাংলাদেশের পণ্যের উপর চিন ৯৭ শতাংশ শুল্ক মকুব করেছে। এসব ঘটনার জেরে অনেকের মধ্যে সংশয় জেগেছে, তবে কি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরল। কিন্তু এর মাঝেই ইদ (EID) উপলক্ষে বাংলাদেশের রেলের চাহিদা পূরণের জন্য সোমবার ভারত থেকে ১০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন আসছে। ভারত এই ইঞ্জিনগুলো দিচ্ছে অনুদান হিসেবে। বাংলাদেশ ও ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কে এটি সহযোগিতার আরেকটি অধ্যায়।
[আরও পড়ুন: ‘বন্ধু’ বাংলাদেশকে ইদের উপহার হিসেবে ১০টি রেল ইঞ্জিন দিচ্ছে ভারত ]
পাশাপাশি আগামী ৩১ জুলাই ছিটমহল দিবস। ২০১৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের মধ্যে থাকা ছিটমহলগুলো বিনিময় করেছিল। এতে দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৭৪ বছরের পুরনো সমস্যার সমাধান হয়েছে। জমি কে কম পেল আর কে বেশি পেল তা নিয়ে আটকে থাকেনি কোনও দেশই। কারণ দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের লক্ষ্য ছিল, জনগণের মঙ্গলের জন্য সমস্যার সমাধান করা। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে চিনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে যোগ হয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিদেশমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামি লিগ সভাপতি শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র নীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। প্রতিবেশীদের সঙ্গে যত ধরনের সমস্যা আছে তার সবই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করছেন তিনি। এপ্রসঙ্গে বিদেশমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ভারতের সঙ্গে গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, সীমান্তের ৭৪ বছরের পুরনো সমস্যা ও সমুদ্রসীমা সমস্যার সমাধান করেছি। দুই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের বিচক্ষণতা ও পরিপক্বতা দিয়ে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় ও মাত্রায় উন্নীত করেছেন। আসলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক ঐতিহাসিক। আমরা পরস্পরের ভালো-মন্দের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা খুব ভাল বন্ধু।’’
বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনীতিবিদদের মতে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে পুরো ভারত যেভাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে তা বিশ্বে বিরল। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশ থেকে ভারত দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের সেনাদের সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকেও বেশ কয়েক বছর আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। মাঝে কিছু বছর দুই দেশের মধ্যে কিছুটা টানাপড়েন থাকলেও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বরাবরই জোরালো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সম্পর্ককে আরও জোরালো করেছেন। সেই সঙ্গে সহযোগিতার নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে সম্পর্ক তাতে অন্য কোনও দেশের প্রভাব পড়ার কোনও সম্ভাবনা তাঁরা দেখছেন না।
[আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদকে আমেরিকা থেকে প্রত্যর্পণের সম্ভাবনা উজ্জ্বল, কার্যকর হতে পারে ফাঁসি]
ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, চিন অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়েছে, এর জন্য এই অঞ্চলে দাদাগিরি করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ফোনালাপ অস্বাভাবিক কিছু নয়। আরও অস্বাভাবিক নয় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কাশ্মীর প্রসঙ্গ তোলা। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। টাকা-পয়সা বা কোনও কিছু দিয়ে তো আর সেই সম্পর্ক ভোলানো যাবে না। দুই দেশের মধ্যে যে বোঝাপড়া তাতে এই সম্পর্কে অন্য কোনও দেশের প্রভাব নিয়ে আমি চিন্তার কিছু দেখি না।’
নয়াদিল্লির শীর্ষস্থানীয় নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো ড. জয়িতা ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ একটি বিশেষ সম্পর্কের অংশীদার। এই সম্পর্কের মূলে আছে স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ ও অভিন্ন সংস্কৃতি। এটি স্বতন্ত্র একটি সম্পর্ক এবং এটি মনে রেখেই এ সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ও ভারতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এটি প্রতিযোগিতার সময় নয়। বরং দুই দেশের উচিত সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে সহযোগিতা জোরদারের মাধ্যমে এ সম্পর্কের আরও পরিচর্যা করা।’
বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। কারণ পাকিস্তানের কোনও বন্ধু নেই। উপসাগরীয় দেশগুলোও পাকিস্তানকে ফিরিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের একমাত্র বন্ধু যদি এখন কেউ থেকে থাকে সেটি হল সৌদি আরব। আর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ইমরান খানের ভালই জানা আছে। আর ওই ফোনালাপের পর ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের বাংলাদেশের অবস্থানের প্রশংসা করে মন্তব্য করেছে।
চিনের প্রভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আশঙ্কা নাকচ করে তিনি আরও বলেন, ‘কোনও দেশের সম্পর্ক জাতীয় স্বার্থে করা হয়। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রক্তে বাঁধা। সাত হাজার ভারতীয় সেনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। অন্যদিকে চিনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আর্থিক লেনদেনের। তারা অবকাঠামো গড়তে সহযোগিতা করছে। আমরা কৃতজ্ঞ যে চিন আমাদের পদ্মা সেতু নির্মাণে সহায়তা করেছে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে এর তুলনা চলে না। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে ভূ-রাজনৈতিক, স্ট্র্যাটেজিক মাত্রা ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল জড়িত।’
[আরও পড়ুন: জঙ্গি হওয়ার জন্যই ধর্ম বদলে বিয়ে করেছিল, ঢাকার আদালতে স্বীকারোক্তি প্রজ্ঞার]
ঢাকা ও নয়াদিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার জোরালো আগ্রহ আছে। ভারতের সবচেয়ে বড় স্থলসীমান্ত বাংলাদেশের সঙ্গে। ভারতের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা থেকে শুরু করে উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্যও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না, সমস্যাগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সব পক্ষকে নিয়ে সমাধান করতে চায়।