পলাশ পাত্র, তেহট্ট: বাবা-মায়ের সঙ্গে মালদহ যেতেই চাইছিল না খুদে দেব। জোর করেই তাকে নিয়ে যান বাবা-মা। তারপর সব এলোমেলো হয়ে গেল। দৌলতাবাদে সলিল সমাধি হল তৃতীয় শ্রেণির দেবের। হোগলবেড়িয়ার সুন্দলপুরের বাজারপাড়ায় প্রামাণিক পরিবারের মা ও ছেলের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে গ্রাম জুড়ে। খুদে অয়ন, অর্ঘ্য, সুপ্রিয়, রাখিরা তাদের প্রিয় দেবকে হারিয়ে স্মৃতি হাতড়াচ্ছিল অসহায়ভাবে। নদিয়ায় পাঁচ শিক্ষক-সহ পনেরোজন দৌলতাবাদের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। একে একে করিমপুর আনন্দপল্লীর শ্মশানঘাটে দেহ এসেছে আর আকাশ বাতাস কান্নায় ভেঙে পড়ছে।
সোমবার সকালে করিমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে মালদহগামী অভিশপ্ত বাসটিতে চেপেছিলেন মা রুম্পা, বাবা দিবস, জ্যাঠা দীনবন্ধু প্রামানিক, স্থানীয় চিকিৎসক সঞ্জয় সরকারের সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণির ছোট্ট দেব। দৌলতাবাদের মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় জলে পড়ে যাওয়া বাসটি থেকে দেবের বাবা ও জ্যাঠাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। বর্তমানে তারা বহরমপুর হাসপাতালে ভরতি। কিন্তু বাড়ি ফেরা হয়নি মা ও ছেলের। মায়ের সঙ্গেই তলিয়ে যায় ন’বছরের দেব। সোমবার গভীর রাতে মা ও ছেলের দেহ আসে বাড়িতে। কান্নায় ভেঙে পড়ে বাড়ির লোকজন। মঙ্গলবার ভোররাতে দু’জনের দেহ সৎকার করা হয়। এদিন সকালেও প্রামাণিক পরিবারের বাড়ির সামনে গিজগিজ করছিল ভিড়। অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ায় গোটা গ্রাম। শোকার্ত মানুষগুলোর মুখ থেকে আক্ষেপের কথার মধ্যেই দেবের মৃত্যু নিয়ে বারেবারে উঠে আসছিল এই পরিবারটায় প্রদীপ জ্বালানোর কেউ থাকল না।
জেঠিমা নিবেদিতার কাছেই ছোট থেকে থাকত দেব। কালিপুজোর সময় দুর্ঘটনায় পায়ে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল খুদে দেবের। সোমবার বহরমপুরে ফের অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা ছিল। তাই ভয়ে না খেয়ে জেঠিমার কাছে লুকিয়ে ছিল সে। দু’চোখ মুছতে মুছতে নিবেদিতা দেবী বলেন, “বংশের একমাত্র ছেলে ছিল দেব। আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ও আমার ছেলের মতোই ছিল। সারাক্ষণ আমার কাছেই থাকত।” পঁচাশি বছরের দাদু বলরাম ও ঠাকুমা সরস্বতী প্রামাণিকেরও নেওটা ছিল বাড়ির একমাত্র ছেলে। রাতে দাদু-ঠাকুমার কাছেই ঘুমাতো দেব। সোমবার ভোরে দেব ভয়ে ঘুম থেকে উঠছিল না। একপ্রকার জোর করেই তাকে তুলে দিয়েছিলেন সরস্বতীদেবী। আক্ষেপ করতে করতে বলেন, “ও উঠছিল না। আমি ওকে ডেকে দিলাম। এখন কী নিয়ে থাকব?” দেবের অভিন্নহৃদয় বন্ধু অয়ন বলে, “আমি মামার বাড়ি গিয়েছিলাম। শুনেই মায়ের সঙ্গে বাড়ি আসি। ওর সঙ্গে লুকোচুরি, আলুভাজা, বিড়াল দৌড়, ক্যাচ খেলা করতাম।”
অয়নের মতো সুন্দলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া সুপ্রিয়, অর্ঘ্য, রাখি, রিয়া, সহেলিরা এদিন তাদের প্রিয় বন্ধু দেবকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে। বন্ধুকে হারিয়ে শোকবিহ্বল খুদেরা দেবের ছবি বুকে আঁকড়ে ধরেই যেন তাকে কাছে রেখে দিতে চাইছে। এসেছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক এলাহি মণ্ডল-সহ অন্য শিক্ষকরা। প্রত্যেকেই জানান, ভাল ছেলে ছিল দেব। স্থানীয় চিকিৎসক সঞ্জয় সরকারের দেহ রাতে চলে আসার পর সৎকার করা হয়। হোগলবেড়িয়ার পোড়াঘাটির মা ছায়ারাণী মাহাত(৭২), ছেলে জ্যোতি প্রকাশ মাহাতর(৫৮) দেহ আসা মাত্র গ্রামে কান্নায় ভেঙে পড়েন গ্রামবাসীরা। মৃত্যু হয়েছে সুন্দলপুরের রুপালী মণ্ডল(৪৫) ও সুনীতা মণ্ডল(৩৫)। গৌরীপুর হেমাজউদ্দিনের শিক্ষক প্রদ্যুৎ চৌধুরির(৩৭)। স্কুলে যাবার পথে দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.