ধীমান রায়, কাটোয়া: আর পাঁচটা শিশুর মতোই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ছিল ছেলেটার৷ একটি দুর্ঘটনা তছনছ করেছে জীবন৷ বাদ গিয়েছে দুটি হাত৷ তবুও বিশ্বাস, ভগবান আবার ফিরিয়ে দেবে বাদ যাওয়া হাত৷ এই বিশ্বাসের ওপরে ভর করে রোজ স্বপ্ন দেখে ছোট্ট ছেলেটি৷ কখনও পুকুরপাড়ে ছুটে ছুটে ঘাসফড়িং ধরে৷ কখনও বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল নিয়ে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে৷ কিন্তু, এসব তো নিছক স্বপ্নই৷ সত্যি হবে কবে? একথাটা বাবাকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করে ১২ বছরের সৌম্য৷ বাবা ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘‘আর ৬টা বছর অপেক্ষা কর সোনা। তারপর ভগবান তোকে ফিরিয়ে দেবেন তোর হাত৷’’
ভগবান তো উপলক্ষ মাত্র। আসলে ছেলের স্বপ্নকে সত্যি করতে আত্মবলিদানের প্রস্তুতি নিয়ে চলেছেন বাবা৷ নিজের একটা হাত একই দুর্ঘটনায় অকেজো। বাকি হাতটি ছেলেকে দিয়ে ছেলের স্বপ্ন সার্থক করতে চান বাবা মৃন্ময় মাজি। তার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করে ফেলেছেন তিনি। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার থানার কানপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃন্ময় মাজির। ছোট মাটির দোতলা বাড়ি। বাড়িতে রয়েছেন মৃন্ময়বাবুর বাবা, মা, স্ত্রী ও এক সন্তান। পৈতৃক কিছুটা জমি ছিল। তবে সেসব ছেলের চিকিৎসার খরচের জন্য বিক্রি করে দিতে হয়েছে। ভাতারের এরুয়ার পঞ্চায়েতে অস্থায়ী কর্মীর কাজ করেন মৃন্ময়বাবু। ছেলে সৌম্য বামুনাড়া উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। মেধাবী ছাত্র হিসাবে স্কুলে পরিচিত। ক্লাসে প্রথম হয় সে।
একটি দুর্ঘটনা মৃন্ময়বাবুর পরিবারকে কার্যত নিঃশেষ করে দিয়েছে। জানা গিয়েছে, তিনবছর আগে ২০১৫ সালের ১৪ মে ওই দুর্ঘটনায় সৌম্যর দুটি হাতই বাদ চলে গিয়েছে তার শরীর থেকে। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ওদিন সাইকেলে চড়ে ছেলেকে নিয়ে মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রামে পুজো উপলক্ষে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন মৃন্ময়বাবু। তখন একটি লরি ওভারটেক করতে গিয়ে পিছন থেকে তাদের ধাক্কা মারে। দুজনেই ছিটকে পড়েন। সৌম্যর দু’হাতের ওপর দিয়ে লরির চাকা চলে যায়। মৃন্ময়বাবুর ডান হাত মারাত্মকভাবে জখম হয়। দু’জনকেই দীর্ঘদিন চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হয়।
মৃন্ময়বাবু বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার পর বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমাদের নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে কলকাতায় একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে চিকিৎসা হয়। প্রায় দেড়মাস ওই নার্সিংহোমে আমাকে ও ছেলেকে ভর্তি থাকতে হয়। ছেলের দুটো হাত কনুইয়ের ওপর থেকে কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। আমার হাতে দু’বার অস্ত্রোপচার হয়। ওই দেড়মাসে সাড়ে ১৩ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল।’’
মৃন্ময়বাবু জানিয়েছেন, নার্সিংহোমে চিকিৎসা শেষ করে কলকাতার একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সৌম্যর কৃত্রিম হাত লাগানো হয়েছে। মৃন্ময়বাবু বলেন, ‘‘জার্মান প্রযুক্তিতে তৈরি এই কৃত্রিম হাতের জন্য সাড়ে ৯ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলে প্রথম থেকে এখনও পর্যন্ত সাড়ে ২২ লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। আমাদের জমিজায়গা বাড়ির যাবতীয় গহনা বিক্রি হয়ে গিয়েছে। ’’
মৃন্ময়বাবু জানিয়েছেন, সৌম্যর জন্য হাত প্রতিস্থাপনের চিন্তাভাবনা নেওয়া হয়েছে। এনিয়ে কেরলের কোচির একটি হাসপাতালে প্রাথমিক কথাবার্তাও হয়ে গিয়েছে। মৃন্ময় মাজি বলেন, ‘‘১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর হাত প্রতিস্থাপন করা যাবে বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। তাঁর জন্য দুটি হাতের ক্ষেত্রে ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ ও একটি হাতে তাঁর প্রায় অর্ধেক খরচ হবে৷ হাতে সময় ছ’টা বছর৷ এর মধ্যে আমাদের টাকার ব্যবস্থা করতে হবে।’’ মৃন্ময়বাবুর কথায়, ‘‘ছেলে এখন জানে বড় হলে ভগবান তার হাত ফিরিয়ে দেবে। এই আশা নিয়েই আমার ছেলে হাসিমুখে থাকে। বাবার দায়িত্ব পালন করতে নিজের হাত না হয় আমি দিতে রাজি। কিন্তু অত টাকা তখন কোথায় পাব?’’ পরক্ষণেই মৃন্ময়বাবু বলেন, ‘‘আশাকরি ভগবান ঠিক ব্যবস্থা করে দেবেন। কেউ না কেউ তো সাহায্য করবে৷’’
ছবি: জয়ন্ত দাস
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.