সম্যক খান : গলায় বল্লম মারার আগে ভারী কোনও বস্তু দিয়ে বাঘটির মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। যাতে তার মাথার খুলি ফেটে গিয়েছিল। তার পরই একের পর এক আঘাত করা হয়েছে বাঘটির উপর। ময়নাতদন্তের পর প্রাথমিকভাবে এটাকে নৃশংস হত্যাকাণ্ড বলেই মনে করছেন বনদপ্তরের কর্তারা। আর সেজন্য শনিবারই দুপুরে গুড়গুড়িপাল থানায় বাঘের হানায় আহত দুই ব্যক্তির নামে এফআইআর করা হয়েছে বনদপ্তরের পক্ষ থেকে। মেদিনীপুরের ডিএফও রবীন্দ্রনাথ সাহা জানিয়েছেন, বাবলু হাঁসদা ও বাদল হাঁসদা-সহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। বিষয়টি পুলিশকে তদন্ত করে দেখতে বলা হয়েছে। কোনওভাবেই অপরাধীদের ছাড়া হবে না। এদিকে, কলকাতায় পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “কেন জীবিত অবস্থায় বাঘটিকে ধরা গেল না, তা নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।”
[ পঞ্চায়েত পর্বে বাঘের মৃত্যুতেও রাজনৈতিক তরজায় শাসক-বিরোধী ]
এদিকে পুড়ে ছাই হয়ে গেল সেই বাঘ বাবাজি। দেড় মাসের ত্রাস পুড়ে ছাই হয়ে গেল মাত্র সাড়ে পাঁচ ঘণ্টাতেই। এজন্য লাগল প্রায় এগারো কুইন্টাল কাঠ। বনদপ্তরের আধিকারিক থেকে শুরু করে শালবনির আড়াবাড়ি রেঞ্জ অফিসের রেস্ট হাউসের এক শেডের তলায় গভীর রাতেই দাহ করে দেওয়া হল আদিবাসী শিকারিদের হাতে নিহত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে। তার আগে ওই রেস্ট হাউস তথা কমিউনিটি হলেই চারজন প্রাণীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপস্থিতিতে ময়না তদন্ত করা হল বাঘটির। চামড়া, দাঁত, নখ, লিভার, হৃৎপিণ্ড থেকে শুরু করে দেহাংশের নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে ভিসেরার জন্য। ওই নমুনাগুলি রাজ্য ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানোও হয়েছে। প্রধান মুখ্য বনপাল রবিকান্ত সিনহা বলেছেন, “ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষায় আছি আমরা। তারপরই চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”
গতকাল দুপুরে বাঘের আক্রমণে যে শিকারি দলের সদস্যরা জখম হয়েছিলেন তাদের প্রতি বনদপ্তর যে কঠোর পদক্ষেপ নিতে চলেছে তা বনকর্তাদের কথা থেকেই পরিষ্কার। শুক্রবার রাত থেকেই মেদিনীপুরে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছেন মুখ্য বনপাল শক্তিশঙ্কর দে। তিনি বলেছেন, “বাঘটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রথমে সামনে থেকে বাঘটির মাথায় আঘাত করা হয়েছে। তারপর কানের উপরে, পিঠে একাধিক আঘাতের পাশাপাশি গলায় বল্লম ঢোকানো হয়েছে। আবার লাঠি দিয়ে পেটানোরও প্রমাণ পাচ্ছেন বনদপ্তরের কর্তারা। যেভাবে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গের’ ভঙ্গিতে বাঘটিকে মারা হয়েছে তাতে যে দলটির সদস্যরা আহত হয়েছেন সেই দলটির হাতেই বাঘটি মারা গিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
[ ফেটে চৌচির লালগড়ের বাঘের খুলি, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ঘনীভূত রহস্য ]
জানা গিয়েছে, যে ওই দলে প্রায় ১৫ জন সদস্য ছিলেন।তাঁরাই বাগঘরার জঙ্গলে প্রথমে বাঘটিকে দেখতে পান। যাঁদের মধ্যে দু’জন আহত হয়েছিলেন। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁদের ভরতি করা হয়। যাঁদের মধ্যে বাবলু হাঁসদা শনিবার সকালে ছাড়া পেয়ে বাগঘরায় নিজের বাড়িও ফিরে গিয়েছেন। অপরজন বাদল হাঁসদা এখনও হাসপাতালেই ভরতি আছেন। তাঁর আঘাত একটু বেশি। তাঁর মাথায় ও পেটে চোট আছে। তাঁর নামে বনদপ্তর এফআইআর করেছে শুনে হাসপাতালে মেল সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের বেডে শুয়েই আঁতকে উঠলেন তিনি। শিকারি দলের সঙ্গে থাকার কথাও এদিন অস্বীকার করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমরা কোনও শিকার করতে যাইনি। লাঠি হাতে পনেরোজন জঙ্গলের দিকে গিয়েছিলাম মাত্র। বাঘ শিকার তো দূরের কথা, আমরা অন্য কোনও শিকারের উদ্দেশ্যেও যাইনি। আমাদের নামে মামলা হলে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।” বনদপ্তরের পক্ষ থেকে এফআইআরের কথা শুনে রীতিমতো উত্তেজিত বাদলের দাদা রবি হাঁসদাও। তিনি বলেছেন, যাঁরা বাঘের থাবায় আক্রান্ত হলেন, তাঁদের নামেই মামলা দায়ের করেছে বনদপ্তর। বাঘ আঁচড় দেওয়ার পরই তাঁর ভাই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। জ্ঞান হারানো আহত ব্যক্তিরা বাঘকে কীভাবে মারতে পারল সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। তার উপর বনদপ্তরই জানিয়েছে, বিকেল তিনটের সময় বাঘটিকে মারা হয়েছে। আর আহতরা বেলা বারোটার সময়ই জখম হয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়ে গিয়েছে। তাহলে তারা বাঘটি মারল কীভাবে? জানা গিয়েছে যে দুই আহতকে জেরা করেই বাঘের মৃত্যু রহস্যের উদঘাটন করতে চাইছে পুলিশও। এদিন বাবলু হাঁসদা হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও তাকে গুড়গুড়িপাল থানায় ডেকে পাঠানো হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।