ব্রতীন দাস, শিলিগুড়ি: ‘জ্যাকেট’ মানে বাঘের চামড়া। হাতির দাঁত এখানে ‘ব়্যাডিস’। গণ্ডারের খড়গকে বলা হচ্ছে ‘সিঙারা’। এরকমই ‘কোড’ব্যবহার করে অনলাইনে চলছে ব্যবসা। দর কষাকষি। sangbadpratidin.in-এর অন্তর্তদন্তে উঠে এসেছে এমনই সব তথ্য। পশুর দেহাবশেষ নিয়ে চলছে অসাধু কারবার।
[কাঠ পাচারের নয়া কৌশল, জঙ্গলের কাঠ কেটে বাড়ি বানিয়ে নিলাম!]
উত্তরবঙ্গকে করিডর করে বন্যপ্রাণীর দেহাংশ পাচারে বিদেশি হাত! জঙ্গি–যোগের আশঙ্কা। আর এনিয়েই কেন্দ্রকে চিঠি দিল রাজ্য বন দপ্তর। রয়্যাল বেঙ্গলের চামড়া থেকে মাথার খুলি, তুষার চিতার চামড়া। হাতির দাঁত থেকে চিতাবাঘের চামড়া বা তক্ষক। প্যাঙ্গোলিনের আঁশ থেকে সি-হর্স। বুলেটপ্রুফ জারে কোটি কোটি টাকার সাপের বিষ থেকে ভালুকের পশম, পিত্ত। ক্রমেই লম্বা হচ্ছে পাচারের ‘আইটেম’। এর বেশিরভাগেরই গন্তব্য চিন।
নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ এমনকী চিনে বসে বন্যপ্রাণী পাচারের কারবার চালাচ্ছে চক্রের ‘মাথা’-রা। শুধু মোটা টাকার লেনদেন নয়, বন্যপ্রাণীর দেহাংশ পাচারের বিনিময়ে চিন থেকে অস্ত্র আমদানি করা হচ্ছে বলেও সূত্র মারফত খবর এসেছে বনকর্তাদের কাছে। কিন্তু কারা সেই অস্ত্র আমদানি করছে, কোথায় যাচ্ছে সেসব অস্ত্র। এসব নিয়ে তথ্য জোগাড়ের কাজ চলছে। এ ব্যাপারে অবশ্য মুখ খুলতে নারাজ বনকর্তারা।
[শিকেয় সরকারি সুবিধা, অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবাতেও দেদার কালোবাজারি]
গত বছর ডুয়ার্সে বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের কাছ থেকে যেভাবে একে-৪৭ রাইফেল ও তাজা কার্তুজ পাওয়া গিয়েছে, তাতে উত্তরপূর্বের জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে চক্রের মাথাদের যোগসাজশের আশঙ্কা করছেন এ রাজ্যের বনকর্তারা। সেক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী পাচারের টাকায় ওইসব জঙ্গি সংগঠন অস্ত্র কিনতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ তাঁদের। রাজ্যের বনমন্ত্রী বিনয় বর্মন বলেছেন, “ফ্রান্স থেকে বুলেটপ্রুফ জারে সাপের বিষ বাংলাদেশ হয়ে আমাদের রাজ্যে ঢুকছে। বন্যপ্রাণী পাচারে নেপাল, ভুটানের পাচারকারীরাও ধরা পড়ছে। ফলে এর সঙ্গে যে আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত, তা তো প্রমাণ হয়েই গিয়েছে। আমরা কেন্দ্রকে চিঠি দিয়ে সবটা জানিয়েছি।”
শিলিগুড়ি তথা উত্তরবঙ্গকে করিডর করে বন্যপ্রাণী পাচারের বিরাট চক্র যে সক্রিয় তা স্বীকার করে নিয়ে বনমন্ত্রী বলেন, “বিএসএফ ও এসএসবি–র সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমরা ওই চক্রের পান্ডাদের ধরার চেষ্টা চালাচ্ছি। অনেক পাচারকারী ধরা পড়েছে। গত কয়েক বছরে পাচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, এমন প্রচুর পরিমাণ বন্যপ্রাণীর দেহাংশ উদ্ধার হয়েছে। আমাদের বনকর্মীরা খালি হাতে পাচারকারীদের কাছ থেকে একে–৪৭ উদ্ধার করছেন, এটা গর্বের।”
উত্তরবঙ্গে বন দপ্তরের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের প্রধান, জলপাইগুড়ির বেলাকোবার রেঞ্জার সঞ্জয় দত্ত বলেছেন, “বন্যপ্রাণী পাচারের চক্রের শিকড় খুঁজতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে পড়ার মতো অবস্থা হচ্ছে। নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, চিনে চক্রের জাল ছড়িয়ে। পাচারের জগতে বন্যপ্রাণীর দেহাংশের আলাদা আলাদা কোড নেম রয়েছে।” তাঁর দাবি, “সাধারণ অপরাধীদের সঙ্গে বন্যপ্রাণী পাচারে যুক্তদের মিল নেই। এক্ষেত্রে একটা সামান্য সূত্র ধরে ম্যাপ তৈরি করতে হয়। সেই ম্যাপ অনুযায়ী এগিয়ে তবেই আসল অপরাধী কিংবা পাচারের আইটেম উদ্ধার করা সম্ভব হয়।” বনকর্তাদের দাবি, পরিকাঠামোর ঘাটতি রয়েছে তাঁদের। পুলিশের মতো তাঁরা ফোন ট্যাপ কিংবা কল ডিটেলস পান না। ফলে পাচারকারীদের ট্র্যাক করা অনেক সময় অসুবিধা হয়ে যায়।
[কেজি প্রতি ভরতুকি, সার কিনতে গিয়ে প্রতারণার ফাঁদে কৃষকরা]
গত তিন বছরে শুধুমাত্র এসএসবি জওয়ানরা ৯৫ কোটি টাকার বেশি বন্যপ্রাণীর দেহাংশ উদ্ধার করেছে বলে তাদের দাবি। ১২৫ টি মামলা হয়েছে। বন দপ্তরের দাবি, এর দ্বিগুণ অর্থের বন্যপ্রাণীর দেহাংশ বাজেয়াপ্ত করেছে তারা। সম্প্রতি ডুয়ার্সের কালচিনি থেকে উদ্ধার হয় ১৪ টন রক্ত চন্দন।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, তক্ষক সিডিউল তিনের আওতায়। কিন্তু সেই তক্ষক ঢালাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। ১৭ ইঞ্চি লম্বা তিনশো গ্রাম ওজনের একটি তক্ষক বিদেশের বাজারে ভারতীয় মুদ্রায় ৮০ লক্ষ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। মূলত পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে এর বাজার রয়েছে। সেখানে তক্ষকের শরীরের নির্যাস থেকে যৌনবর্ধক ওষুধ তৈরি হয়। এমনকী তক্ষকের মাংস খেলে না কি এডস ও ক্যানসার রোধ হয়।
[সরকার পাঠাচ্ছে খাদ্যসামগ্রী, কোন চক্র উধাও করছে রেশনের চাল-গম?]
জানা যায় ভালুকের পিত্ত থেকেও তৈরি হচ্ছে ওষুধ। ভালুকের পশম অঙ্কনের জন্য দামি তুলি তৈরির কাজে লাগছে। প্যাঙ্গোলিনের আঁশ কিংবা সি–হর্স এমনকী প্রজাপতিও পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক বনকর্তা জানিয়েছেন, মোটা টাকার লোভে বন্যপ্রাণী পাচারের সঙ্গে স্থানীয় নামী ব্যবসায়ী থেকে চিকিৎসক এমনকী শিক্ষক, স্কুল–কলেজের পড়ুয়ারাও যুক্ত হয়ে পড়ছে। সাপের বিষ পাচার–কাণ্ডে ইতিমধ্যে স্কুল শিক্ষকদের জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। রেঞ্জার সঞ্জয় দত্ত জানিয়েছেন, “বন্যপ্রাণীর দেহাংশ পাচারে শিলিগুড়ির কয়েকজন ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকের জড়িত থাকার তথ্য হাতে এসেছে। সেইমতো অভিযান চলছে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.