ব্রতদীপ ভট্টাচার্য: মাছের বাজারে বড় মাপের কই চোখে পড়লে বাঙালির জিভে জল আসতে বাধ্য। ৪০০, ৬০০ কিংবা ৮০০, দাম যাই হোক না কেন, তেল কই-এর স্বাদ পেতে টাকার হিসেব-নিকেশ করে না মাছে ভাতে বাঙালি। কিন্তু এবছর জামাইষষ্ঠীতে জামাইয়ের রসনাতৃপ্তির জন্য কই মাছ কিনতে গেলে সতর্ক থাকাই ভাল। না হলে গাঁটের কড়ি খরচ করে বড় ঠকা ঠকতে হতে পারে। কারণ এবছর জামাইষ্ঠীর বাজার ছেয়ে গিয়েছে ‘ছদ্মবেশী কই’ মাছে। দেশি কই মাছের দামে এই ছদ্মবেশী কই বেচে লোক ঠকাচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
দেখতে হুবহু কই-এর মতোই। আকারে আয়তনে বেশ বড়। হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। আসল-নকল না চিনলে সাধারণ মানুষের পক্ষে তফাত বোঝা দায়। রান্না করা পর্যন্ত পার্থক্য কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু মুখে দিতেই দু’টোর ফারাক একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায়। কই মাছের স্বাদ-গন্ধ তাতে বিন্দুমাত্র নেই। ছদ্মবেশী এই কই খাওয়ার পর কেউ বলছেন, “অনেকটা তেলাপিয়া মাছের মতো খেতে।” কারও দাবি, “তেলাপিয়ার তাও স্বাদ হয়। এই মাছ তো একেবারেই বিস্বাদ।”
[দু’বছরের মধ্যে ২২ শহরে ফুরোবে ভূ-গর্ভস্থ জল, চিন্তায় কেন্দ্র]
মৎস্যদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এই ছদ্মবেশী কই আসলে ভিয়েতনামিজ বা থাই কই। যা মৎস্য চাষি বা ব্যবসায়ীদের কাছে ‘হাইব্রিড কই’ বলে পরিচিত। ভিয়েতনাম আর থাইল্যান্ডে এই প্রজাতির মাছ খুব প্রচলিত। বছর চারেক আগে বাংলাদেশ থেকে চোরা পথে রাজ্যে ঢুকেছে এই ‘হাইব্রিড কই’। দেখতে দেশি কই-এর মতোই। রং-কিছুটা আলাদা। সাধারণ মানুষের পক্ষে খোলা চোখে দেশি কই-এর সঙ্গে এই হাইব্রিড কই আলাদা করা কঠিন। আকারে আয়তনে লোভনীয়। দেশি কই-এর চেয়ে বড়। দেখতে এতটাই হৃষ্টপুষ্ট যে, বাজারে দেশি কই আর হাইব্রিড কই পাশাপাশি রাখলে আগে হাইব্রিড-এর দিকেই নজর যাবে ক্রেতাদের। কিন্তু স্বাদে দেশি কই-এর সঙ্গে হাইাব্রিড কই-এর আকাশ পাতাল তফাত। দামেও ফারাক বিস্তর।
মৎস্যদপ্তরের আধিকারিকদের থেকে জানা যায়, ভিয়েতনামিজ বা থাই কই খুব সস্তা। কারণ এগুলি পুকুরে চাষ হয়। খুব দ্রুত বাড়ে। মাত্র দুই আড়াই মাসে একটি মাছের ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম ওজন হয়ে যায়। বেশি সময় রেখে দিলে ৮০০ থেকে এক কেজি ওজন হয় একটি মাছের। যেখানে একটি দেশি কই ১০০ বা ১৫০ গ্রাম ওজন হতে প্রায় সাত থেকে আট মাস সময় লাগে। ১০০ থেকে ১৫০ গ্রামের দেশি কই ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু এই ভিয়েতনামিজ বা হাইব্রিড কই-এর দাম তার অর্ধেকের চেয়েও কম। কিন্তু মৎস্যদপ্তরের আধিকারিকদের দাবি, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই ভিয়েতনামিজ বা থাই কই বাজারে এনে বড় মাপের দেশি কই বলে চড়া দামে বিক্রি করে লোক ঠকাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে লোক ঠকানোর জন্য ছোট থাকতেই এই হাইব্রিড কই তুলে দেশি কই বলে বিক্রি করছে তারা। কিন্তু ক্রেতাদের কয়েকটি জিনিস জানা থাকলে আর ঠকতে হবে না বলে দাবি মৎস্য দপ্তরের আধিকারিকদের।
কীভাবে তফাত বুঝবেন? উত্তর ২৪ পরগনার মৎস্য দপ্তরের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর দিলীপ কুমার মণ্ডল জানিয়েছেন, দেশি কই সাধারণত কালচে খয়েরি রঙের হয়। আর ভিয়েতনামিজ আর থাই কই-এর রং অনেকটা ফ্যাকাশে সবুজ। পেটের দিকে রং সাদা হয়ে যায়। দেশি কই আকারের চ্যাপটা। তার তুলনায় ভিয়েতনামিজ আর থাই কই অনেকটা গোলাকার হয়। থাই কই-এর লেজে কালো ছোপ থাকে। দিলীপবাবু আরও জানান, দেশি কই জল ছাড়া দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকে। কিন্তু ভিয়েতনামিজ বা থাই কই জল থেকে তুলে নেওয়ার পর বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে না।
মৎস্যদপ্তরের আধিকারিকদের থেকে জানা যায়, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় এখন এই ভিয়েতনামিজ বা থাই কই-এর চাষ হচ্ছে। তার মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা, নৈহাটি, হাবড়া, অশোকনগর এবং নদিয়ার বেশ কিছু এলাকায় বেশি চাষ হয়। হাইব্রিড মাগুরের চাষ ছেড়ে চাষিরা এখন হাইব্রিড কই-এর চাষ করছেন বলে দাাবি মৎস্য দপ্তরের। এমনকী হাইব্রিড মাগুরের বদলে হাইব্রিড কই চাষে উৎসাহ দিচ্ছে মৎস্য দপ্তর। অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর দিলীপ কুমার মণ্ডল বলেন, “কম সময়ে এই মাছ বেশি উৎপাদন হয়। হাইব্রিড মাগুর ক্ষতিকারক, অন্য মাছের চাষ নষ্ট করে। কিন্তু এই ভিয়েতনামিজ কই আলাদা চাষ করা হয়।” তবে আসল কই বলে এই ভিয়েতনামিজ কই বিক্রি কোনওভাবেই সমর্থন করছে না মৎস্য দপ্তর। সাধারণ মানুষকে এই ‘ছদ্মবেশী’ কই সম্পর্কে সচেতন করতে প্রচারও শুরু করা হবে বলে দাবি তাদের।
[নাগাল্যান্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণে শহিদ অসম রাইফেলসের ৪ জওয়ান]