কিংশুক প্রামাণিক: পাহাড়ের নয়া সমীকরণে দার্জিলিং লোকসভা আসনের রাজনৈতিক চরিত্র অনেক বদলে গেল। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থন পাশে নিয়ে গতবার দার্জিলিং জিতেছিলেন বিজেপির সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া। কিন্তু বিমল গুরুং, রোশন গিরিদের ভুল রাজনীতি এবং পাহাড় থেকে পলায়ন বদলে দিয়েছে মোর্চার সংসার। এখন দলের রাশ বিনয় তামাং, অনিত থাপাদের হাতে। বিজেপির প্রতি তাঁদের কোনও দায়বদ্ধতাই নেই। বরং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শান্তির স্লোগানে তাঁরা শামিল। মুখে কেন্দ্র বিরোধী জেহাদ। গোর্খাল্যান্ড যে রাজ্য সরকারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, তা অনুধাবন করে ফের জিটিএর কাজে মনোনিবেশ করেছেন বিনয়রা। অনিশ্চয়তা, বনধ, বোমা, গুলি বন্ধ হওয়ায় পাহাড়ের সাধারণ মানুষ কতটা খুশি তা মুখ্যমন্ত্রীর পাহাড় সফরে স্পষ্ট। স্বভাবতই আগামী লোকসভা ভোটে নাটকীয় কিছু না ঘটলে দার্জিলিং আসন বিজেপির পক্ষে জেতা খুব কঠিন।
গতবার বিজেপির প্রার্থী জিতেছিলেন ১,৯৭,২৩৯ ভোটে। মজার তথ্য হল, আলুওয়ালিয়া পাহাড়ের তিন বিধানসভা আসন দার্জিলিং, কার্শিয়াং ও কালিম্পং থেকেই লিড নিয়েছিলেন ১,৯৭,৭৪৬ ভোটে। অর্থাৎ সমতল থেকে তৃণমূলের বাইচুং ভুটিয়া এগিয়ে থাকলেও পাহাড়ের বিজেপির পক্ষে মোর্চার বিপুল ভোট আালুওয়ালিয়াকে বড় ব্যবধানে জিতিয়ে দেয়। দার্জিলিং বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে তিনি লিড নেন সর্বোচ্চ ৭৩,৩১৪ ভোটে। কার্শিয়াং থেকে বিজেপি লিড পায় ৬৫,৬৮৩ ভোটে আর কালিম্পং দেয় ৫৮৭৪৯ ভোটে লিড। তবে মোর্চার বিক্ষুব্ধ মহেন্দ্র লামা পান প্রায় ৪৭ হাজার ভোট। উল্লেখ্য, মোর্চার এত বিরোধিতার পরও তৃণমূল কিন্তু পাহাড়ে পায় ৯১,২৭১ ভোট। আলাদা রাজ্যের দাবির বিরোধিতা করে নজিরবিহীন ফল। আর সমতলে বিজেপি মাটিগাড়ায় ৯ হাজার, শিলিগুড়িতে ৭ হাজার ও ফাঁসিদেওয়াতে ৫ হাজার লিড নিলেও চোপড়ায় তৃণমূল লিড নেয় ২২,৭৬৫ ভোটে। যদিও বিধানসভা ভোটে এই চিত্র বদলে যায়। পাহাড়ে তিন আসন পায় মোর্চা। সমতলের চারটির একটিও বিজেপি পায়নি।
এই ভোট সমীকরণ কিন্তু আগামী লোকসভা ভোটে সম্পূর্ণ বদলে যাবে মোর্চার নেতৃত্ব বদলে। তাঁরা মমতার পক্ষে থাকবেন। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হল, পাহাড়ের তেরোটি বোর্ডের সমর্থন মমতার পক্ষেই রয়েছে। এই জনজাতির ভোটব্যাঙ্ক গত বিধানসভা ও পুরভোটে পুরোটা পায় তৃণমূল। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হবে জিএনএলএফ-এর সমর্থনও। পাহাড়ের কিংবদন্তি নেতা প্রয়াত সুবাস ঘিসিংয়ের ছেলে মন ঘিসিং মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য। মমতা যেভাবে পাহাড়ের লাইফ লাইন রোহিণী সড়কের নাম ঘিসিংয়ের নামে উৎসর্গ করেছেন, তাতে তাদের সমর্থকরা উল্লসিত। কাজটা আবার তিনি করিয়েছেন বিনয়-অনিতদের নেতৃত্বাধীন জিটিএর মাধ্যমে। অর্থাৎ খুব বুদ্ধি করেই তিনি পাহাড়ের সব বড় শক্তিকে একসূত্রে বেঁধে নয়া ঐক্য গড়েছেন। সেই ছবিটা স্পষ্ট হয় রাজভবনে ৮ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে। এই ঐক্যই বিজেপিকে ভোটে বিপদে ফেলে দিতে পারে পাহাড়ে।
বস্তুত, ভোট এক বছর বাকি থাকলেও দিল্লি দখলের যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। মমতা বনাম মোদির লড়াইও বাংলার রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই। বিরোধীদের গ্রহণযোগ্য নেতা কে? সেই প্রশ্নে মমতাকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করতে উদ্যোগী অনেকেই। গুজরাতের পাতিদার আন্দোলনের যুব নেতা নেতা হার্দিক প্যাটেল কলকাতায় এসে যেভাবে এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী পদে একমাত্র যোগ্য মুখ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলে যুক্তি দিয়েছেন তা খুবই অর্থবহ। তাঁর গুরুত্ব কতটা তা মমতাও বোঝেন। তাঁর লক্ষ্য লোকসভায় আসন বাড়ানো। রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে গতবার ৩৪টি তৃণমূল পেয়েছিল। এবার এ রাজ্য থেকে আরও বেশি আসন জিততে মমতা প্রস্তুতি শুরু করেছেন। বিশেষ করে বিজেপির হাতে থাকা দার্জিলিং ও আসানসোল তাঁর প্রধান টার্গেট।
অন্যদিকে, বিজেপি সম্পর্কে পাহাড়ে এমনিতেই নেতিবাচক পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল। মুখে নানা কথা বললেও গোর্খাল্যান্ড-এর দাবি পূরণ করার প্রতিশ্রুতি পালনে বিজেপি ব্যর্থ। পরপর দু’দফায় বিজেপি প্রার্থীকে জিতিয়েছে পাহাড়। বিনিময়ে কী পাওয়া গেল ক্ষোভ তা নিয়েই। তবে পাহাড়ের সমর্থন পেলেই হবে না, তৃণমূলকে সমতলের জমি পোক্ত করতে হবে। বিধানসভা ভোটে গোটা রাজ্যে ঝড় বইয়ে দিলেও শিলিগুড়ি মহকুমায় তৃণমূলের ফল ভাল হয়নি। সেই ক্ষত মেরামত করেই লোকসভা ভোটে যেতে বদ্ধপরিকর মমতা। সেই সঙ্গে দার্জিলিং আসনের সব সমীকরণ তিনিও জানেন। তাই বিজেপিকে হারাতে কী ফরমুলায় মমতা প্রার্থী দেবেন তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তিনি তার স্ট্র্যাটেজি সঠিক সময়ে সাজাবেন। সব মিলিয়ে দার্জিলিং আসন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল পাহাড়ের রং বদলে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.