একবিংশ শতকেও লিঙ্গ বৈষম্য ঘুচল না। কন্যাসন্তানের জন্ম অনেকের কাছে অপরাধের মতো। এভাবে এসে গেল আরও একটা নারী দিবস। সমাজে নারী-পুরুষের তফাতের মধ্যে নিজেদের মতো করে মাথা উঁচু করে এগোনোর চেষ্টা করছেন অনেকেই। বাংলার নানা প্রান্তে রয়েছে এমন অজস্র সম্ভাবনা। সেই অর্ধেক আকাশের খোঁজে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল। এই সব আং সাং হিরোইনদের নিয়ে আমাদের বিশেষ প্রতিবেদন। আজ আমাদের প্রতিনিধি মালদহের বাবুল হক, এক যোদ্ধার সঙ্গে আলাপ করালেন।
মন্দিরের সামনে জবা-গাঁদা-বেলপাতার পসরা সাজিয়ে তার অপেক্ষার শেষ নেই। মায়ের ভক্তদের কাছে পুজোর ফুল বিক্রি করেই নিজের পড়াশোনার খরচ চালায় ছোট্ট মেয়েটি। পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারও তাকে টানতে হয়। মাত্র বারো বছর বয়সেই লড়াকু হয়ে উঠেছে প্রিয়াঙ্কা পাহাড়ি। লড়াই যেন তার নিজের সঙ্গেও। হতদরিদ্র পরিবারে একরত্তি মেয়েটিই উপার্জনকারী। ফুল বিক্রি করে যা পকেটে আসে তা দিয়েই নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি অন্ন তুলে দিতে সে পরিবারকেও সাহায্য করে। ষষ্ঠ শ্রেণির স্কুল পড়ুয়া এই ছাত্রীর উপর অনেকটাই নির্ভরশীল তার পরিবারের সদস্যরা। প্রিয়াঙ্কার বয়সের মেয়েরা এই সময় ব্যস্ত থাকে খেলাধুলো কিংবা টিভিতে কার্টুন দেখতে। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা ব্যস্ত ফুলের দোকান সামলাতে।
[বিশ্বকাপে দ্বিতীয় ব্রোঞ্জ জয় মেহুলির, এবার মিক্সড ডাবলসে]
মায়ের মন্দিরের পাশে বটগাছের ধারে খোলা আকাশের নিচে ছোট একটি ফুলের দোকান তার। রোজ অবশ্য নয়, সপ্তাহে দু‘দিন সে ফুল বিক্রি করে। মঙ্গল ও শনিবার। ওই দু’দিন জহুরা মায়ের দর্শনে আসেন ভক্তরা। ক্রেতারা সবাই জহুরা মায়ের ভক্ত। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি যতক্ষণ ভক্তদের আনাগোনা থাকে, ততক্ষণ ধরে চলে ফুলের বিক্রিবাটা। জবাফুল, গাঁদাফুল ও বেলপাতার সম্ভার নিয়ে বসে প্রিয়াঙ্কা।
[১০ মার্চ থেকে চালু এসি লোকাল ট্রেন, একই থাকছে ভাড়া]
মালদহ শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের অদূরেই রয়েছে বিখ্যাত মা জহুরা কালীর প্রাচীন মন্দির। অন্তত তিনশো বছর আগে মালদহে এই জহুরা কালীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার পর এই এলাকার মানুষের দুর্দশা মোচনের জন্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকেই এই জহুরা কালী মন্দিরে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন বছরভর। কলকাতা, বিহার-সহ বাংলাদেশ থেকেও বছরে অন্তত একবার এই জাগ্রত কালী মন্দিরে অঞ্জলি দিতে আসেন ভক্তরা। এই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরের ঠিক সামনেই বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ফুলের দোকান। সেখানেই একটি ফুলের দোকান বছর বারোর ছোট্ট মেয়ে প্রিয়াঙ্কা পাহাড়ির।
প্রিয়াঙ্কার বাবা অজয় পাহাড়ি পেশায় দিনমজুর। বাড়ির কাজকর্ম সামলান মা সীমা পাহাড়ি। তারা এক ভাই ও দুই বোন। প্রিয়াঙ্কা মেজ। স্থানীয় হাজি মহম্মদ আলি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সে। জহুরাতলা কলোনি এলাকাতেই ওদের বাড়ি। গ্রামে প্রিয়াঙ্কারা নিতান্তই গরিব। মাটির বাড়ি। টালির ছাউনি। পরিবারের মুখে অন্ন জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল বাবাকে। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে বসে ছিল তার। ফুল বিক্রি শুরু করেই সে অনেকটা সামলে নিয়েছে। এখন প্রিয়াঙ্কার বাবা অসুস্থ। রোজগারের ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে ভরসা প্রিয়াঙ্কা। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার ভোর হতেই মেয়েটি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ফুল-বেলপাতা কিনতে।
[এবার মহিলাদের জন্য কম খরচে জৈব পচনশীল স্যানিটারি প্যাড আনছে রেল]
দীর্ঘ পাঁচ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে যায় মালদহ শহরের রথবাড়ি মোড়ে। পাইকারি দরে সেখানে জবা-গাঁদা-বেলপাতা কিনে নেয় সে। তারপর সাইকেল চালিয়ে ফিরে আসে জহুরাতলা গ্রামে। মন্দিরের পাশের সেই বটগাছতলায়। জবা-গাঁদার পসরা সাজায় সে। সপ্তাহের ওই দু’টি দিন বাদে বাকি দিনগুলিতে স্কুলে যায় সে। ‘কন্যাশ্রী’ হতে চায় প্রিয়াঙ্কা। তারপর পড়াশোনা করে সে একদিন স্কুলের ‘ম্যাডাম’ হবে। ফুল বেচেই নিজের দেখা এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য সে লড়াই করছে। স্কুলের শিক্ষকরাও জানেন তার লড়াইয়ের কথা। দু’দিন সে স্কুলে অনুপস্থিত থাকলেও শিক্ষকরা কখনও আপত্তি করেন না। প্রিয়ঙ্কার কথায়, “আমরা যে গরিব তাই খেটে খাই।” সে নিজেই জানাল, “আমি অনেক দিন আগে থেকেই জহুরা কালী মন্দিরের সামনে ফুল বিক্রি করে আসছি। আমি যে টাকা উপার্জন করি সেটা বাড়ির কাজে লাগে এবং আমার পড়াশোনার কাজে লাগে। আমিও পরের বছর কন্যাশ্রী হতে পারব।” গড়গড় করে একথা বলে প্রিয়াঙ্কা বুঝিয়ে দেয় তাকে অনেক দূর যেতে হবে। কারণ পড়াশোনার কোনও বিকল্প নেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.