একবিংশ শতকেও লিঙ্গ বৈষম্য ঘুচল না। কন্যাসন্তানের জন্ম অনেকের কাছে অপরাধের মতো। এভাবে এসে গেল আরও একটা নারী দিবস। সমাজে নারী-পুরুষের তফাতের মধ্যে নিজেদের মতো করে মাথা উঁচু করে এগোনোর চেষ্টা করছেন অনেকেই। বাংলার নানা প্রান্তে রয়েছে এমন অজস্র সম্ভাবনা। সেই অর্ধেক আকাশের খোঁজে সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল। এই সব আং সাং হিরোইনদের নিয়ে আমাদের বিশেষ প্রতিবেদন ‘তোমারে সেলাম’। আমাদের প্রতিনিধি আসানসোলের চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়, এক যোদ্ধার সঙ্গে আলাপ করালেন।
চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়, আসানসোল: ভোর তিনটেয় আসানসোল স্টেশন। খবরে কাগজে চোখ বোলান ফুলেশ্বরী। খবরের কাগজ জুড়ে নারীমুক্তি আন্দোলন আর প্রগতির কথা। প্রথম পাতা জুড়ে জ্বলজ্বল শব্দ, লেনিনের মূর্তি ভাঙার তাণ্ডব ত্রিপুরায়, মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, সিসিটিভি ক্যামেরাবন্দি হত্যা। তাতে তাঁর কি? ভোর চারটের সময় অন্ধকার তুচ্ছ করে এক যুবতি সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে যান আসানসোল রেল স্টেশন। এই বাড়ি-ওই বাড়ি। খবরের কাগজে দড়ি বেঁধে কারওর ব্যালকনি বা বারান্দায় ছুঁড়ে দেন ফুলেশ্বরী। ছুঁড়ে দেওয়া কাগজের নিউজ প্রিন্টের মতোই একটু একটু করে যেন হারিয়ে যায় ফুলেশ্বরি মণ্ডলের স্বপ্ন। প্রায় ৫০০ পরিবারের কাছে রোজ কাগজ পৌঁছে দেন সেই কাকভোরে। দুপুরে বাড়ি ফিরেই জল নিতে কলের লাইনে দাঁড়ানো। ঘোড়া কাঁখে জল ভরে সেই জল উঠবে ভাতেরহাঁড়িতে, তবেই ভাত উঠবে পরিবারের সবার মুখে। পরিবারে একমাত্র রোজগেরে ফুলেশ্বরী মণ্ডল।
জানা গিয়েছে, বাড়িতে অসুস্থ বাবা, মানসিক বিকারগ্রস্ত মা আর শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাই। আসানসোলের বড়তোড়িয়ায় নেপালিবস্তির কাছে ছোট্ট একখানি ঘরে থাকেন তাঁরা। ফুলেশ্বরী জানান, বাবা বিনোদ মণ্ডলের বয়স হয়েছে। তাই আর কাগজের হকারি করতে পারেন না। গ্রাজুয়েট হয়েও বাবার পেশাকেই আঁকড়ে ধরতে হয়েছে সংসার চালাবার দায়ে। ভাই উত্তম মণ্ডল শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। মা অসুস্থ ও সম্প্রতি মানসিক বিকারগ্রস্ত। গোটা পরিবারে মুখে ভাত আর দাদা মায়ের চিকিৎসার খরচ তুলতে এইভাবেই রোজগার করতে হয় তাঁকে। শহরের অলি-গলি থেকে গ্রামের মেঠো রাস্তায় প্রতিদিন ছোটেন ফুলেশ্বরী। ভোর থেকে দুপুর। গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা। শীত থেকে বসন্ত। ৩৭টা বসন্ত এইভাবেই পেরিয়ে গিয়েছে জীবনের। ছুটি নেই। শরীর খারাপের অজুহাত নেই। সামাজিকতা নেই, নেই উৎসবে বেড়ানো। সারা বছরই ছুটতে হয় তাঁকে। না ছুটলেই পেট বনধ। জেলার একমাত্র মহিলা খবরের কাগজের হকার। নারী প্রগতির বার্তা আজ তিনি পৌঁছে দেবেন বাড়ি বাড়ি। ঠান্ডা ঘরে নারী প্রগতির ভাষণ। শব্দের অক্ষর বিন্যাসে মহিলা খবরের ফেরিওয়ালা পৌঁছে দেন দেশ দুনিয়ার খবর।
কিন্তু তাঁর খবরে রাখে কে? স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়ার। সাঁতা গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা, সেখানেই মাধ্যমিক। আর্টস নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক বার্ণপুর শান্তিনিকেতন থেকে। বিসি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন। কিন্তু সংসারের জোওয়াল কাঁধে এসে পড়ায় সব স্বপ্ন ভুলে হকারিকেই পেশা করে নিতে হয়েছে। একা ভোরের রাস্তায় সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেওয়ার সময় স্বপ্নগুলো ভেসে ভেসে আসে। শহরের পিচগলা রাস্তায় জলছবির মতো ভেসে ওঠে স্কুল-কলেজের দিনগুলি। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ বাড়াতেই হয়, সংসারের চাপ বলে কথা। কারণ বাস্তব বড় নির্মম। কারণ পরিবারের এখন একটাই ছাতা, তার নাম ফুলেশ্বরী।
ছবি- মৈনাক মুখোপাধ্যায়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.