রাজ কুমার: মনে পড়ে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ চ্যানেলের সাড়া জাগানো সিরিজ ‘দ্য লেজেন্ড অব মাইক ডজ’-এর কথা? আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া থেকে নিস্তার পেতে পেসিফিক নর্থ ওয়েস্ট হোলি রেইন ফরেস্ট-এর গাছে একটি মানুষের একাকী অদ্ভুত জীবনযাপনের রোমহর্ষক ছবি! শহর জীবনকে গুডবাই জানিয়ে গভীর জঙ্গলে পেল্লায় গাছের ডালে বাসা বেঁধেছিলেন মাইক৷ অনেক কষ্টে খুঁজে বের করার পর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি বৈভবে পূর্ণ আধুনিক সভ্যতাকে মিস করেন না?’ মাইকের সোজাসাপ্টা উত্তর ছিল, ‘মোটেও না৷ আমি সুখী৷’
ঠিক একই রকম মাইকের সন্ধান আমরা পেয়েছি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলের রায়মাটাং এলাকায়৷ নাম জিগর ওরাওঁ৷ সত্তর ছুঁইছুঁই মানুষটি দুই দশকের বেশি সময় ধরে কালচিনি ব্লকের ভুটান সীমান্ত সংলগ্ন জঙ্গলের এক প্রান্তে পেল্লায় পিপল গাছের কোটরে বসবাস করছেন৷ আধুনিক সমাজকে ‘আলবিদা’ জানিয়ে বনবাসেই খুঁজে নিয়েছেন স্বাচ্ছন্দ্য৷
কয়েক বছর আগের ঘটনা৷ কর্নাটকের জঙ্গলে গজ্জা জনজাতি সম্প্রদায়ের একটি দলের সন্ধান মেলে৷ বুনো হাতির তাণ্ডবের ভয়ে আমগাছের ডালে রাত কাটাত দলের সদস্যরা৷ জিগরের সেই সমস্যা নেই৷ উল্টে মাইকের মতোই তিনি আধুনিকতার কোলাহল থেকে অনেক দূরে হাতি, চিতাবাঘের মতো বুনোদের সঙ্গে একরকম সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়েছেন৷ মাইকের সঙ্গে জিগরের তফাত একটাই৷ মাইক ১৯৯১ সাল থেকে পায়ে জুতো গলাননি৷ জিগরের পায়ে সস্তা প্লাস্টিকের চপ্পল রয়েছে৷ ছিপছিপে চেহারা৷ পাক ধরা চুল উঠে টাক উঁকি দিতে শুরু করেছে৷ এক গোছা লম্বা চুল অবশ্য কাঁধে নেমেছে৷ পরনে নিজের হাতে সেলাই করে তৈরি মোটা কাপড়ের অদ্ভুত রকমের কালো আলখাল্লা৷ গোঁফ, দাড়িতে হাত পড়ে অনিয়মিত। বাঁ হাতে স্টিলের বালা৷ মৃদুভাষী জিগর ভোর হতেই বেরিয়ে পড়েন খাবারের খোঁজে৷ বেশিটাই বুনো ফল। চাল জুটলে ভাত ফুটিয়ে নেন৷
যে গাছের কোটরে বাড়ি তাঁর সেটাও অদ্ভত রকমের৷ তিনটি কোটর রয়েছে পরপর৷ ঠিক যেন তিনতলা বাড়ি৷ সবচেয়ে উপরের কোটরটি ‘বেডরুম’ সাজিয়েছেন জিগর৷ উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট হবে৷ জঙ্গলের বাঁশ কেটে শোয়ার জন্য মাচা গড়ে নিয়েছেন৷ রয়েছে কম্বল, চাদর, পলিথিন৷ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে কোটরের মুখ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেন বনবাসী৷ এরপর নিশ্চিন্তে ঘুম৷ সবচেয়ে নিচের বড় কোটর ‘কিচেন’৷ সেখানেই থাকে বাসনপত্র, খুঁজে আনা সবজি৷ গৃহস্থের বাড়িতে যা থাকে তার অনেক কিছুই পেয়ে যাবেন এখানে৷ এক কোটর থেকে অন্য কোটরে যাতায়াতের জন্য গাছের ডাল বেঁধে সিড়ি বানিয়েছেন৷ সেখান দিয়ে লাফিয়ে চলাফেরা দেখে জিগরকে ‘অরণ্যদেব’-এর সংস্করণ মনে হতেই পারে৷
তবে অরণ্যবাসী হলে কী হবে, কোটরের সংসার লোকালয়ের ঘরদোরের মতোই ঝকঝকে৷ পেল্লায় গাছতলা যেন নিকানো উঠোন৷ নিয়মিত ঝাড়ু দেন৷ সাজানো গোছানো চারদিক৷ বুনো হাতির দল আশপাশে ঘুরে বেড়ালেও এখানে পা বাড়ায় না৷ কেন এভাবে একা গাছে থাকেন? উত্তর নেই৷ প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসেন জিগর৷ অনেক পরে জানান, বাবা অশ্বিনী ওরাওঁ এবং মা কামিনীদেবী রায়মাটাং চা বাগানের শ্রমিক ছিলেন৷ বাগানের নিচে লাইনে শ্রমিক আবাসনে থাকতেন৷ বাবা মারা যাওয়ার পর শ্রমিকের কাজ পেয়েছিলেন৷ বিয়েও করেন৷ এরপর মা মারা যান৷ বাতের যন্ত্রণায় কাবু হলে স্ত্রীও তাঁকে ছেড়ে চলে যান৷ এরপর থেকে জিগর ‘মানসিক শান্তি’-র খোঁজে গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন৷ কখনও ক্লান্ত হয়ে গাছের ডালে ঘুমিয়ে পড়তেন৷ ঘরে ফেরা হত না৷ জঙ্গলের ফল খেয়ে দিন কাটত৷ এভাবে কয়েক বছর চলে৷
কিন্তু ঠিক কোন সময় সমাজ জীবন ছেড়ে বনবাসী হয়েছেন মনে নেই তাঁর৷ বলেন, “কী হবে বস্তিতে গিয়ে৷ ওখানে হিংসায় ভরা জীবন৷ এখানেই ভাল আছি৷” ভয় করে না? প্রায় চুলহীন মাথায় হাত বুলিয়ে জানান, আগে ভয় করত৷ তখন রাতে গুটিয়ে থাকতাম৷ এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে৷ গাছের কোটরে শুয়ে হাতির পাল ঘুরে বেড়াতে দেখতে বেশ ভাল লাগে৷ জিগরের কথা জানেন বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের কর্তারা৷ তাঁকে সমাজ জীবনে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে কয়েকবার৷ লাভ হয়নি৷ এমনকী পড়শিদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে ভোলেননি উত্তরবঙ্গের ‘মাইক’৷ কোটর বাড়ির কিছুটা দূরে চুয়াপাড়া চা বাগান৷ পাশে এসএসবি ক্যাম্প৷ সেখানকার জওয়ানরা জিগরকে ভাল জানেন৷ কখনও ক্যাম্পে, আবার কখনও আশপাশের বস্তিতে ঘুরে চাল, ডাল জুটিয়ে নেয় সে৷ যাতায়াতের সময় এলাকার অনেকেই খোঁজ নিতে ভোলে না৷ জিগরকে তাঁরা জানেন ‘গাছ বাবা’ নামে। অনেক জনশ্রুতিও চালু হয়েছে৷ অবশ্য সে সবে কান দেন না গাছ বাবা৷ বলেন, “আমি বাইরের দুনিয়ার খবর রাখি না৷” তবে লোকালয়ে যে যান না এমন নয়৷ সেটাও বিশেষ প্রয়োজনে৷ তখন চেনাজানাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়৷ এতটুকুই৷ জিগরের এমন দশার খবর পেয়ে একবার স্থানীয় পঞ্চায়েতের তরফে রায়মাটাং বনবস্তির কাছে ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়৷ কিন্তু সেই ঘরে একদিনের জন্য পা রাখেননি৷ কেন? গাছ বাবার সংক্ষিপ্ত উত্তর, “ওসব ভাল লাগে না৷”
(ছবি : শীলা দাস)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.