Advertisement
Advertisement

Breaking News

আধুনিক সমাজকে ‘আলবিদা’ জানিয়ে কুড়ি বছর গাছের কোটরে জিগর ওরাওঁ

সত্তর ছুঁইছুঁই মানুষটি দুই দশকের বেশি সময় ধরে কালচিনি ব্লকের ভুটান সীমান্ত সংলগ্ন জঙ্গলের এক প্রান্তে পেল্লায় পিপল গাছের কোটরে বসবাস করছেন৷

Meet the ‘tree man’ Jigar Orang of West Bengal
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:September 5, 2017 5:16 am
  • Updated:September 29, 2019 5:16 pm

রাজ কুমার: মনে পড়ে ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ চ্যানেলের সাড়া জাগানো সিরিজ ‘দ্য লেজেন্ড অব মাইক ডজ’-এর কথা? আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া থেকে নিস্তার পেতে পেসিফিক নর্থ ওয়েস্ট হোলি রেইন ফরেস্ট-এর গাছে একটি মানুষের একাকী অদ্ভুত জীবনযাপনের রোমহর্ষক ছবি! শহর জীবনকে গুডবাই জানিয়ে গভীর জঙ্গলে পেল্লায় গাছের ডালে বাসা বেঁধেছিলেন মাইক৷ অনেক কষ্টে খুঁজে বের করার পর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি বৈভবে পূর্ণ আধুনিক সভ্যতাকে মিস করেন না?’ মাইকের সোজাসাপ্টা উত্তর ছিল, ‘মোটেও না৷ আমি সুখী৷’

ঠিক একই রকম মাইকের সন্ধান আমরা পেয়েছি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলের রায়মাটাং এলাকায়৷ নাম জিগর ওরাওঁ৷ সত্তর ছুঁইছুঁই মানুষটি দুই দশকের বেশি সময় ধরে কালচিনি ব্লকের ভুটান সীমান্ত সংলগ্ন জঙ্গলের এক প্রান্তে পেল্লায় পিপল গাছের কোটরে বসবাস করছেন৷ আধুনিক সমাজকে ‘আলবিদা’ জানিয়ে বনবাসেই খুঁজে নিয়েছেন স্বাচ্ছন্দ্য৷

Advertisement

[বনধ প্রত্যাহারের দাবিতে কার্শিয়ংয়ে মিছিল বিনয় তামাং, অনীত থাপাদের]

কয়েক বছর আগের ঘটনা৷ কর্নাটকের জঙ্গলে গজ্জা জনজাতি সম্প্রদায়ের একটি দলের সন্ধান মেলে৷ বুনো হাতির তাণ্ডবের ভয়ে আমগাছের ডালে রাত কাটাত দলের সদস্যরা৷ জিগরের সেই সমস্যা নেই৷ উল্টে মাইকের মতোই তিনি আধুনিকতার কোলাহল থেকে অনেক দূরে হাতি, চিতাবাঘের মতো বুনোদের সঙ্গে একরকম সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়েছেন৷ মাইকের সঙ্গে জিগরের তফাত একটাই৷ মাইক ১৯৯১ সাল থেকে পায়ে জুতো গলাননি৷ জিগরের পায়ে সস্তা প্লাস্টিকের চপ্পল রয়েছে৷ ছিপছিপে চেহারা৷ পাক ধরা চুল উঠে টাক উঁকি দিতে শুরু করেছে৷ এক গোছা লম্বা চুল অবশ্য কাঁধে নেমেছে৷ পরনে নিজের হাতে সেলাই করে তৈরি মোটা কাপড়ের অদ্ভুত রকমের কালো আলখাল্লা৷ গোঁফ, দাড়িতে হাত পড়ে অনিয়মিত। বাঁ হাতে স্টিলের বালা৷ মৃদুভাষী জিগর ভোর হতেই বেরিয়ে পড়েন খাবারের খোঁজে৷ বেশিটাই বুনো ফল। চাল জুটলে ভাত ফুটিয়ে নেন৷

Advertisement

যে গাছের কোটরে বাড়ি তাঁর সেটাও অদ্ভত রকমের৷ তিনটি কোটর রয়েছে পরপর৷ ঠিক যেন তিনতলা বাড়ি৷ সবচেয়ে উপরের কোটরটি ‘বেডরুম’ সাজিয়েছেন জিগর৷ উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট হবে৷ জঙ্গলের বাঁশ কেটে শোয়ার জন্য মাচা গড়ে নিয়েছেন৷ রয়েছে কম্বল, চাদর, পলিথিন৷ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে কোটরের মুখ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেন বনবাসী৷ এরপর নিশ্চিন্তে ঘুম৷ সবচেয়ে নিচের বড় কোটর ‘কিচেন’৷ সেখানেই থাকে বাসনপত্র, খুঁজে আনা সবজি৷ গৃহস্থের বাড়িতে যা থাকে তার অনেক কিছুই পেয়ে যাবেন এখানে৷ এক কোটর থেকে অন্য কোটরে যাতায়াতের জন্য গাছের ডাল বেঁধে সিড়ি বানিয়েছেন৷ সেখান দিয়ে লাফিয়ে চলাফেরা দেখে জিগরকে ‘অরণ্যদেব’-এর সংস্করণ মনে হতেই পারে৷

‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ চ্যানেলের সাড়া জাগানো সিরিজ ‘দ্য লেজেন্ড অব মাইক ডজ’
‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ চ্যানেলের সাড়া জাগানো সিরিজ ‘দ্য লেজেন্ড অব মাইক ডজ’

তবে অরণ্যবাসী হলে কী হবে, কোটরের সংসার লোকালয়ের ঘরদোরের মতোই ঝকঝকে৷ পেল্লায় গাছতলা যেন নিকানো উঠোন৷ নিয়মিত ঝাড়ু দেন৷ সাজানো গোছানো চারদিক৷ বুনো হাতির দল আশপাশে ঘুরে বেড়ালেও এখানে পা বাড়ায় না৷ কেন এভাবে একা গাছে থাকেন? উত্তর নেই৷ প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসেন জিগর৷ অনেক পরে জানান, বাবা অশ্বিনী ওরাওঁ এবং মা কামিনীদেবী রায়মাটাং চা বাগানের শ্রমিক ছিলেন৷ বাগানের নিচে লাইনে শ্রমিক আবাসনে থাকতেন৷ বাবা মারা যাওয়ার পর শ্রমিকের কাজ পেয়েছিলেন৷ বিয়েও করেন৷ এরপর মা মারা যান৷ বাতের যন্ত্রণায় কাবু হলে স্ত্রীও তাঁকে ছেড়ে চলে যান৷ এরপর থেকে জিগর ‘মানসিক শান্তি’-র খোঁজে গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন৷ কখনও ক্লান্ত হয়ে গাছের ডালে ঘুমিয়ে পড়তেন৷ ঘরে ফেরা হত না৷ জঙ্গলের ফল খেয়ে দিন কাটত৷ এভাবে কয়েক বছর চলে৷

[আশ্রমের মধ্যেই ধর্ষণ করে খুন মহিলা, আটক অভিযুক্ত সাধু]

কিন্তু ঠিক কোন সময় সমাজ জীবন ছেড়ে বনবাসী হয়েছেন মনে নেই তাঁর৷ বলেন, “কী হবে বস্তিতে গিয়ে৷ ওখানে হিংসায় ভরা জীবন৷ এখানেই ভাল আছি৷” ভয় করে না? প্রায় চুলহীন মাথায় হাত বুলিয়ে জানান, আগে ভয় করত৷ তখন রাতে গুটিয়ে থাকতাম৷ এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে৷ গাছের কোটরে শুয়ে হাতির পাল ঘুরে বেড়াতে দেখতে বেশ ভাল লাগে৷ জিগরের কথা জানেন বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের কর্তারা৷ তাঁকে সমাজ জীবনে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে কয়েকবার৷ লাভ হয়নি৷ এমনকী পড়শিদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে ভোলেননি উত্তরবঙ্গের ‘মাইক’৷ কোটর বাড়ির কিছুটা দূরে চুয়াপাড়া চা বাগান৷ পাশে এসএসবি ক্যাম্প৷ সেখানকার জওয়ানরা জিগরকে ভাল জানেন৷ কখনও ক্যাম্পে, আবার কখনও আশপাশের বস্তিতে ঘুরে চাল, ডাল জুটিয়ে নেয় সে৷ যাতায়াতের সময় এলাকার অনেকেই খোঁজ নিতে ভোলে না৷ জিগরকে তাঁরা জানেন ‘গাছ বাবা’ নামে। অনেক জনশ্রুতিও চালু হয়েছে৷ অবশ্য সে সবে কান দেন না গাছ বাবা৷ বলেন, “আমি বাইরের দুনিয়ার খবর রাখি না৷” তবে লোকালয়ে যে যান না এমন নয়৷ সেটাও বিশেষ প্রয়োজনে৷ তখন চেনাজানাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় হয়৷ এতটুকুই৷ জিগরের এমন দশার খবর পেয়ে একবার স্থানীয় পঞ্চায়েতের তরফে রায়মাটাং বনবস্তির কাছে ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়৷ কিন্তু সেই ঘরে একদিনের জন্য পা রাখেননি৷ কেন? গাছ বাবার সংক্ষিপ্ত উত্তর, “ওসব ভাল লাগে না৷”

(ছবি : শীলা দাস)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ