রাহুল চক্রবর্তী, শাসন: তাঁর ঘরে তিনটি ‘সবুজসাথীর’ সাইকেল। ভাইপো, ভাইঝি, নাতির।
বাংলার অনেক ঘরে ঘুরলেই হয়তো এমন ছবি পাওয়া যাবে। কিন্তু যাঁকে উদ্দেশ্য করে বলা, তিনি যে সে লোক নন। বাম জমানায় তাঁর নামে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত। তাঁর প্রভাব, প্রতিপত্তি দেখেছে তামাম শাসন। স্কুলেও যেমন তিনি ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক, তেমনই ছিলেন শাসনের ‘মাস্টারমশাই’। অথচ এখন তিনি ভিটেমাটি ছেড়ে অনেক দূরে। কাঁধ থেকে লাল ঝান্ডা নামিয়েছেন ২০১৫ সালের জুন মাসে। সিপিএমের সদস্যপদ নবীকরণ করেননি। দলের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছেড়ে এখন গুণগান গাইছেন তৃণমূলের উন্নয়নের। মোদিকে হারাতে মমতাকেই ভোট দেওয়ার আবেদনও রেখেছেন।
তিনি মজিদ মাস্টার। একটা সময় তাঁর নামের সঙ্গেই জুড়েছিল ‘শাসনের ত্রাস’ শব্দটা। বাম জমানায় তিনিই শাসন এলাকাকে শাসন করতেন। একাধিক অভিযোগ রয়েছে তাঁর নামে। জেলও খেটেছেন। একটা সময় শাসন আর মজিদ মাস্টার ছিল সমার্থক। রাজনীতির অলিগলি এমনই জটিল যে, প্রবাদপ্রতিম প্রাক্তন সিপিএম নেতার থেকে এখন প্রতাপ বেশি তৃণমূলের যে কোনও ছাত্র নেতার। ভোটের এই মরশুমে শাসনে মজিদ মাস্টারের নাম জিজ্ঞাসা করলে উঠে আসছে অনেক কথাই। শাসন থানার কাছে চৌরাস্তার মুখে সিরাজুল ইসলাম বললেন, “ভোট হোক বা না হোক, একটা সময় মজিদ মাস্টারই ছিলেন শেষ কথা। কী না করেছেন তিনি। এখন তাঁর প্রভাব না থাকলেও, নামটা কাঁটার মতো বিঁধে আছে শাসনজুড়ে।” গ্রামেরই আরেক বাসিন্দা ফারুক শেখ জানালেন, “মজিদ মাস্টার গ্রামে এলে অশান্তি তৈরি হতে পারে, এমন আশঙ্কা থাকেই। বছর দুয়েক আগে মজিদ মাস্টার বাড়িতে এসেছিলেন। তা নিয়ে এলাকায় অশান্তি দেখা দেয়। গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ জানায়। তারপর তাঁকে চলে যেতে হয়।”
শাসন গ্রামে মজিদ মাস্টারের স্ত্রী, ছোট মেয়ে থাকেন। ২০০৯ সাল থেকে মজিদ ঘরছাড়া। শাসন ছাড়িয়ে বারাসতের কাজিপাড়া শিমুলতায় থাকেন। পাশে কাজিপাড়া বয়েজ স্কুলের কাছেই মেয়ে-জামাইয়ের বাড়ি। দুই বাড়িতে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটছে তাঁর। স্কুলে শিক্ষকতা করার সুবাদে নাতি-নাতনিদের প্রতিদিন রুটিন করে ইংরেজির পাঠ দেন। শাসন ইউনিয়ন হাইস্কুলে তিনিই ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক। এখন বয়স পঁচাত্তর ছাড়িয়েছে। দু’বছর আগে ‘ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনিভার্সিটি’ থেকে ৬১ শতাংশ নম্বর পেয়ে ইংরেজিতে এমএ পাস করেছেন।” অকপটেই জানালেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবুজসাথীর তিনটি সাইকেল আছে আমাদের পরিবারে। কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাফল্যে বাংলার মেয়েরা আজ অনেক এগোচ্ছে।” হঠাৎ করে মমতার প্রশাংসা? ‘বামেরা আদর্শচু্যত’ বলে মজিদ বিঁধলেন আলিমুদ্দিনের ম্যানেজারদের। আর জানালেন, “আমি ভোট দিতে পারলে মমতাকেই দিতাম। আর সন্ধ্যায় যখন আড্ডা দিই, তখন সকলকেই বলি, মোদিকে হারাতে ভোট দিন মমতাকেই।” ষষ্ঠ দফার ভোট রক্তাক্ত হয়েছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে। এখানেও তৃণমূলের পাশে দাঁড়িয়ে মাস্টার বললেন, “বামেরাও ধোয়া তুলসীপাতা ছিল না। এখন বিজেপিও নয়।”
শাসনে এখন ভেড়ির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি করছে রাজ্যের শাসকদলের নেতৃত্ব। অনেক সময় তা নিয়ে গন্ডগোলও হয়েছে। এখন কিছুটা শান্ত। পুরনো সংগঠনের জেরে শাসনে এখনও কিছু সিপিএমের ভোট আছে। তবে বিন্দুমাত্র সংগঠন নেই বিজেপির। হাড়োয়ার তৃণমূল বিধায়ক হাজি নুরুল ইসলাম বললেন, “মজিদ অস্তিত্বহীন। বিজেপির সংগঠন নেই। সিপিএম এজেন্টই দিতে পারবে না।” কী হবে ভোটের দিনের শাসনে? এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূল নেতা শম্ভু ঘোষ বলেন, “২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কোনও গন্ডগোল হয়নি। পঞ্চায়েত ভোট শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। লোকসভাতেও যার ভোট সে-ই দেবে।”