স্টাফ রিপোর্টার: দু’দফায় সাকুল্যে কয়েক মিনিট। কোনও ইঙ্গিত ছাড়াই মঙ্গলবার ভরসন্ধ্যায় আচমকা আছড়ে পড়ল কালবৈশাখী। প্রকৃতির রোষে লন্ডভন্ড হয়ে গেল কলকাতা, হাওড়া, সল্টলেক-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। রেশ বুধবার সকালেও রয়েছে। সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। রাজ্যের কয়েক জায়গায় বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিও হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে জোড়া ঝড়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৪। জানা গিয়েছে, পোস্তা ও শিয়ালদহে আহত দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এদিকে বুধবারও বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এমনটাই জানানো হয়েছে আবহাওয়া দপ্তরের পক্ষ থেকে।
মঙ্গলবার ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯৮ কিলোমিটার। হাওয়া অফিসের তথ্য, বিগত ৭২ বছরের মধ্যে এমন জোরাল কালবৈশাখী মহানগরে হয়নি। ন’বছর আগের সেই বিধ্বংসী আয়লার পর সাম্প্রতিককালে কোনও ঝড়েরই এমন কালান্তক তাণ্ডব দেখা যায়নি। অতীতে গাইঘাটা, গোকর্ণ বা দাঁতনের প্রলয়ঙ্কর টর্নেডোর স্মৃতিই যেন ফেরত এসেছিল। কলকাতায় মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের, হাওড়ায় ছ’জনের। এছাড়াও হুগলি ও বাঁকুড়ায় মৃত্যুর খবর মিলেছে। সল্টলেকে রিকশায় গাছ পড়ে গুরুতর আহত হয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ভাইঝি, গাছ চাপায় গুরুতর আহত এ ই ব্লকের এক রিকশা চালক ও ইজেডসিসির পিছনে এক গাড়ির যাত্রীও।
[মেটিয়াবুরুজে নিখোঁজ কিশোরীকে নিয়ে গুজবে কান না দেওয়ার পরামর্শ লালবাজারের]
কলকাতায় চাঁদনিতে একটি অটোতে গাছ ভেঙে পড়ে মারা যান অটোর যাত্রী ২৭ বছরের তরুণী আমরিন জাভেদ ও অটোচালক মানোয়ার আলম(৫১)। গুরুতর আহত অটোর আরও তিন যাত্রী। বেহালায় গাছ চাপা পড়ে মারা যান নীরুস মিনজ(৬৫)। আনন্দপুরে পাঁচতলা একটি বাড়ির দেওয়াল ভেঙে গিয়ে মারা গিয়েছেন শাহিদ খান(৪০)। কলাকার স্ট্রিটে ছ’তলা বাড়ির কার্নিস ভেঙে মারা গিয়েছেন অনীত শুক্লা(২৪)। হাওড়ার ডুমুরজলায় গাছ চাপা পড়ে মারা যান বাঁকড়ার বাসিন্দা মুনমুন দাস(২৪)। বেলুড়ের তারাচাঁদ গাঙ্গুলি স্ট্রিটে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন সৌভিক দাস, লিলুয়ার বাসিন্দা সত্যজিৎ দাস, বেলুড়ের সোহনলাল স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী খুশি মৌর্য, সাঁকরাইলের বাসিন্দা জয়দেব দাস(৩২) ও অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি। বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাতেই মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন, বুধবারের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে। পুরসভা ও পুলিশকেও মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় থাকার নির্দেশ দেন।
আলিপুর জানাচ্ছে, এদিন সন্ধ্যায় ১৩ মিনিটের ব্যবধানে মহানগরের উপর দিয়ে বয়ে যায় দু’টি ঝড়। প্রথমটি আসে ৭.৪২ মিনিটে। তার সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৮৪ কিলোমিটার। দ্বিতীয়টি ৭.৫৫ মিনিটে, ৯৮ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে। শেষ কবে মহানগরের উপর দিয়ে এমন বিধ্বংসী ঝড় বয়ে গিয়েছে, তা মনে করতে পারছেন না আবহাওয়াবিদরাও। এবং টর্নেডোর মতো এক্ষেত্রেও পূর্বাভাস ছিল না। ফিরতি অফিস টাইমে কল্লোলিনীর ব্যস্ততা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই ঝড়ের ঝাপটায় বেপথু হয়ে গেল তার যাবতীয় ছন্দ। গাছ উপড়ে বন্ধ হয়ে যায় বহু রাস্তা। তার ছিঁড়ে থমকে যায় ট্রেন চলাচল। এমনকী, মেট্রো পরিষেবাও ব্যাহত হয়। কিছু ক্ষেত্রে মোবাইল নেটওয়ার্কও ঠিকঠাক কাজ করেনি। উড়ে আসা আবর্জনা আর শুকনো পাতায় রাজপথ হয়ে ওঠে আঁস্তাকুড়। ঝড় থামলে শুরু হয় মুষলধার বৃষ্টি। রাত অবধি বৃষ্টি হয়েছে ২৯.৬ মিলিমিটার। সব মিলিয়ে দুর্গতি চরমে। রাত দশটা পর্যন্ত বিমানবন্দরে জারি ছিল বিশেষ সতর্কতা। বহু বিমান ছাড়তে ও পৌঁছতে দেরি হয়েছে।
[শাপমুক্তির শপথ নিয়ে এবার পাটুলিতেও নচিকেতার চা]
দুরন্ত ও বেনজির এই কালবৈশাখীর আঁচ বিলক্ষণ পুইয়েছেন শহরতলির ট্রেন যাত্রীরাও। কোথাও ওভারহেড তার ছিঁড়ে কোথাও লাইনে গাছ পড়ে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। হাওড়া-শিয়ালদহ দুই শাখাতেই ছিল এক চিত্র। শিয়ালদহ-টিটাগড়, শিয়ালদহ-ডানকুনি, শিয়ালদহ-দুর্গানগর ট্রেন চলাচল দীর্ঘক্ষণ বন্ধ থাকে। বন্ধ থাকে শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেন চলাচলও। এদিকে হাওড়া লাইনের চেহারাটাও ছিল একই রকম। বিভিন্ন স্টেশনে আটকে যায় ট্রেন। ভদ্রেশ্বর থেকে ব্যান্ডেল ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। গভীর রাত পর্যন্ত ট্রেন স্বাভাবিক হয়নি। দমদম মেট্রোয় লাইনে গাছ পড়ে বন্ধ হয় যায় মেট্রো চলাচল। গিরিশ পার্ক থেকে কবি সুভাষ ট্রেন চলাচল করলেও বাকি অংশ ছিল বন্ধ। রাতে পুরোপুরি মেট্রো পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কিন্তু এমন দুর্গম গতিতে ধেয়ে আসা ঝড়টির কোনও পূর্বাভাস হাওয়া অফিস পেল না কেন? আবহাওয়াবিদদের ব্যাখ্যা, এর নেপথ্যের প্রাকৃতিক অনুষঙ্গগুলি এত তাড়াতাড়ি দানা বেঁধেছে যে, তার আগাম আঁচ পাওয়া দুষ্কর। “বীরভূম-মেদিনীপুরে বেশ কিছু বজ্রগর্ভ মেঘ তৈরি হয়েছিল। সেগুলি হাওয়ার টানে শহরের ঠিক উপরে এসে খুব অল্প সময়ের মধ্যে জুড়ে যায়। বজ্রগর্ভ মেঘগুলি একত্র জুড়ে গিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা মেঘ তৈরি করেছিল। যার জেরেই এই বিপত্তি।”– মন্তব্য হাওয়া অফিসের অধিকর্তা গণেশকুমার দাসের। এদিন অধিকর্তা বলেন, ঝড়-বৃষ্টির একটা আগাম সম্ভাবনার কথা বিকেলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন ভয়ংকর রূপ নেবে তা বোঝা যায়নি। বুধবারও ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন গণেশবাবু।
[প্রেমিকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নাম করে নাবালিকাকে পাচারের ছক, গ্রেপ্তার ১]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.