চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়, আসানসোল: ৩ নভেম্বরের সকাল। কুলটির মিঠানিতে ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পিছন দিকে দু’দুটি সিঁধ কাটা। ঘটনার তদন্তে নিয়ামতপুর ফাঁড়ির পুলিশ লক্ষ্য করে, ব্যাঙ্কের পিছন দিকে বড় বড় সিঁধ দুটি কাটা হয়েছে। প্রথমটি সিঁধটি খালি আবাসনের, পরেরটি ব্যাঙ্কের বাথরুমের। ব্যাঙ্ক খুলে দেখা যায় ভাঙা হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা।উধাও সার্ভারও। এমনকী, বিপদসূচক অ্যালার্মও বিকল করে দেওয়া হয়েছে। ভল্টের ঘরের দরজাও ভাঙা হয়েছে। রাতে পুলিশের টহল গাড়ি ব্যাঙ্কের সামনে এসে পড়ায় রণে ভঙ্গ হয় চৌর্যবৃত্তির অপারেশন। তাই ভল্ট ভাঙতে পারেনি সিঁধেলরা।
[বাজারে গিয়ে রংচঙে মাছ পছন্দ? আপনিই কিন্তু জালে পড়ছেন!]
তার দশদিন পরেই একই কায়দায় সিঁধেল চোরের হানা কুলটির চিনাকুড়িতে। এই অপারেশন অবশ্য সফল।গয়নার দোকানে সিঁধ কেটে ৬ লক্ষ টাকার গয়না ও নগদ টাকা হাতিয়ে নেয় চোরের দল। সকালে দোকানের মালিক দেখতে পান তাঁর দোকানের পেছন দিকে দেওয়ালের সিঁধ কেটেছে চোরেরা। নভেম্বর মাসের দুটি ঘটনার কোনও কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। আসানসোল জুড়ে বেড়েছে সাইবার ক্রাইমের মতো ঘটনা। একদিকে যখন এটিএম ক্লোন চক্র ধরতে পুলিশ জেরবার, তখন প্রাচীন চৌর্যবৃত্তি সিঁধেল চোরের হানাও ঘটছে সমানতালে।
[স্বামীকে খুন করতে বন্ধুদের সঙ্গে ছক স্ত্রীর? আইনজীবী খুনে নয়া মোড়]
এক সময় গৃহস্থবাড়িতে হানা দিত সিঁধেলরা। এখন তাদের নিশানা ব্যাঙ্ক, কর্পোরেট অফিস ও গয়নার দোকানে। এক সময় গ্রাম বাংলার একদল পরিশ্রমী কর্মঠ মানুষ, যারা গায়ে তেল মেখে, লুঙ্গি কাছা বেঁধে রাতের আঁধারে শাবল নিয়ে পরের ঘরের ভিটে কেটে অর্থ সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দিত তাদের পরিচিতি ছিল সিঁধেল চোর নামে! মূলত একধরনের অশিক্ষিত কিন্তু পরিশ্রমী মানুষ এই কাজ করত। কিন্তু মিঠানি ব্যাঙ্কের সিঁধেল হানা সেই পুরাতন ভাবনাকে ভেঙেচুরে দিতে বাধ্য। কারণ ব্যাঙ্কের সিসি ক্যামেরার কানেকশন কেটে সার্ভারের হার্ড ডিস্ক যেভাবে খোয়া গিয়েছে, তাতে স্পষ্ট সাইবার ক্রাইমেও সিদ্ধহস্ত সিঁধেল চোরেরা। কথায় আছে চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা। এই চুরিবিদ্যা দশমহাবিদ্যার অন্তর্গত অন্যতম এক বৃত্তি। চোর যদি শাস্ত্র জানে সেই চোরের বুদ্ধিতে নাগাল পাওয়া অসম্ভব। আসানসোল দুর্গাপুর পুলিশের এডিসিপি ওয়েস্ট অনিমিত্র দাস বলেন মিঠানি ও চিনাকুড়ি কাণ্ডে সিঁধেল চোরেদের সন্ধান এখনও মেলেনি। সিঁধ কাটার ধরন দেখে দুটি অপারেশন একই চোরের দল চালিয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তাঁর সংযোজন, সাইবার হানার পাশাপাশি প্রাচীন এই চোর্যবৃত্তির ঘটনাও ঘটছে আসানসোলে। আসলে চোরেরা আধুনিক হওয়ার পাশাপাশি পুরাতন বিদ্যাও ধরে রেখেছে তা এই দুটি ঘটনাতেই বোঝা যায়। এই চোরদের ধরা খুব চ্যালেঞ্জিং। তাঁর ধারণা খুব শীঘ্রই চোরের দল ধরা পড়বে।
ঋগ্বেদে মিলছে চোরেদের কথা। বাইবেলেও রয়েছে আবার জাতক-মালা বা অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যেও উল্লেখ রয়েছে চৌর্যবৃত্তির। বেদের কাল থেকে চলে আসা এই পেশার মানুষকে ভয়ে ও শ্রদ্ধায় কত নামই দিয়েছে। তার মধ্যে কিছু শ্রুতিমধুরও, যেমন নিশি-কুটুম্ব বা স্কন্দোপজীবী। আগমন ঘটেছে ধুতালিয়া (প্রবঞ্চক, ঠক), বুড়োলিয়া (ডুবুরি চোর), গলসি (ফাঁসুড়ে), বাটপাড়, ডাকা-চুরি (ডাকাত), লুকা-চুরি (আধুনিক অর্থে গোপনে চুরি)– এসব পেশার মানুষদের। তার মধ্যে অন্যতম সিন্ধালিয়া (সিঁধেল চোর)।
সিঁধেল চোর কী ?
সিঁধকাঠি দিয়ে সিঁধ কেটে চুরি করে এমন চোর। এ পদ্ধতিতে চুরি করা সবচেয়ে কঠিন। অনেক দিন ধরে ভক্তি সহকারে একজন গুরুর কছে এই ‘বিদ্যা’ অর্জন করতে হয়। সিঁধেল চোররা সিঁধকাঠি দিয়ে গৃহস্থ বাড়ির দেওয়ালেও গর্ত বা সুরঙ্গ করে গোপনে প্রবেশ করে চুরি করে।গর্ত দিয়ে ঘরে ঢোকার আগে গায়ে তেল মেখে নেয় চোর। একদিকে বুদ্ধিমত্তার অন্যদিকে সাহস এবং শিল্প দু’রকম বিদ্যাই রপ্ত করতে হয় চোরকে।
সিঁধ কাঠি
শাবল মেহনতি মানুষের বেশ উপকারী হাতিয়ার। এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। চোর যখন রাতের আঁধারে গেরস্তের বাড়িতে সিঁধ কাটে, শাবল তখন আদিম অস্ত্র। এখানেও অবশ্য উপকারের বিষয় আছে তবে তা চোরের দিক থেকে। এই বিশেষ শাবলকেই সিঁধ কাঠি বলা হয়। সিঁধ কাঠি তৈরি নিয়েও নানা কাহিনী শোনা যায়। কামারের দোকানের সামনে একটি লোহার শিক আর টাকা রেখে যায় চোর। কামারও সেই লোহার শিক থেকে ‘সিঁধ কাঠি’ বানিয়ে আবার রেখে দেয় একই জায়গায়। রাতের অন্ধকারে কাঠি নিয়ে যায় চোর। ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ মুখোমুখি হয় না। সিঁদকাঠি দুই ধরনের- একটা ত্রিকোণ ফলাযুক্ত, এতে মাটির দেওয়াল কাটা যায়। আর একটার মাথা চতুর্ভুজের মতো, এটি পাকা দেওয়াল কাটতে ব্যবহার করা হয়।
এরপর সিঁদকাঠি নিয়ে চোরেরা হাজির হয় অকুস্থলে। যেনতেন প্রকারেণ সিঁধ কাটলে চলবে না, এ একপ্রকার শিল্পকর্মই বটে! দেহের মাপজোক সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকে এই চোরদের। সিঁধের মধ্যে দিয়ে নিজের পুরো শরীর গলিয়ে দেওয়া যায়। সিঁধ কেটে প্রথমে পাততে হয় কান। নিশ্বাসের শব্দ শুনে বুঝে নিতে হয় অন্দরের বাসিন্দাদের গতিবিধি। যদি মনে হয় কেউ হাল্কা জেগে আছে তার জন্য আছে ঘুমপাড়ানি মন্ত্র, যাকে চলতি ভাষায় বলে নিদালী মন্ত্র, বেদের কালে একে বলা হতো অবস্বপনিকা। এই মন্ত্রে হাল্কা ঘুম গভীর হয়, আর জেগে থাকা মানুষ ঘুমে অচেতন হয়ে যায়। তবে চোর নিজে প্রবেশের আগে পুতুল বা হোলা জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে নাকি পরীক্ষা করে নেয়। যদি গৃহস্থ জেগে থাকে তবে হামলার হাত থেকে বাঁচার জন্য এই প্রথা অবলম্বন করে সিঁধেল চোর।
প্রাচীন শাস্ত্র সমরাদিত্য-সংক্ষেপ নামক পুঁথিতে রয়েছে গুরু শিষ্যের চুক্তি রয়েছে কখনো মিথ্যা বলতে পারবে না। আর গুরুর কথা অবাধ্য হলে গৃহস্থের হাতে ধরা পড়বে চোর। সুতরাং চরম নিষ্ঠাবান হতে হবে চোরকে। বলে রাখা ভাল সিঁদ বস্তুটা হাজার দু’য়েক বছর আগের। উৎকৃষ্ট সিঁধ নাকি সাত প্রকার : পদ্মব্যাকোষ অর্থাৎ ফুটন্ত পদ্মফুলের মতো সিঁধ, ভাস্কর অর্থাৎ সূর্যের মতো গোলাকার, বালচন্দ্র অর্থাৎ কাস্তের আকারের চাঁদের মতো, বাপী অর্থাৎ পুকুরের মতো চৌকোণা, অর্থাৎ অনেকখানি চওড়া। এছাড়া রয়েছে স্বস্তিকের চেহারার সিঁধ আর পূর্ণকুম্ভের চেহারার সিঁধ। মোট এই সাতরকম। জায়গা বিশেষে অবশ্য সিঁদ কাটার পদ্ধতি আলাদা আলাদা। মনু শাস্ত্র মতে “ভিত্তি পক্ক ইষ্টকের হইলে আকর্ষণ, অপক্ক হইলে ছেদন, ও কেবল মৃত্তিকার হইলে জল সেচন করিতে হয়, এবং কাষ্ঠের হইলে কাটিতে হয়।”
আসানসোলের প্রান্তিক অঞ্চল বা গ্রামীণ এলাকার মানুষরা জানান সিঁধেল হানা এখনও হয়। তাঁরা কখনও এই চোর ধরা পড়তে দেখেননি। কিংবা সিঁধ কাঠিও দেখেননি। তবে যেখানেই সিঁধ কেটে চুরির ঘটনা ঘটেছে সেখানে দুটি জিনিষ তাঁরা লক্ষ্য করেছেন। এক চোরের বিষ্ঠা ও দুই গহস্থ বাড়িতে চুরি করে কিছু খেয়ে যাওয়া। গোপন বিদ্যার এটাও নাকি চোরেদের সংস্কার। মিঠানি ব্যাঙ্কের ঘটনায় এই দুটি দৃশ্য দেখা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান সিঁধের আশেপাশে বিষ্ঠা দেখেছেন এবং চোরেরা ব্যাঙ্ক লাগোয়া আবাসনে কাজু-কিসমিস খেয়ে গেছে। সুতরাং চোর ও চুরিবিদ্যা আধুনিক হলেও গোপন তুকতাক আজও অব্যাহত।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.