ব্রতীন দাস, শিলিগুড়ি: আক্ষরিক অর্থেই এ এক অন্য ভোর! যার জন্য অনেক দিন অপেক্ষাও মানা যায়। সদ্য ঘুম ভাঙা সূর্যের নরম আলোর রক্তিম আভায় মায়াবী তিস্তা। চিকচিক করা বিস্তীর্ণ বালির চর। ডানা মেলে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখির দল। ডিঙি নৌকায় ভেসে বেড়ানো একলা মাঝি। ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চোখ জুড়ানো ক্যানভাস। এতদিন সবই ছিল।
[পাহাড়ে বেড়াতে যাবেন? নিখরচায় সাফারির সুযোগ ব্রিটিশ আমলের ল্যান্ডরোভারে]
তবে সে পরশ পাথর এবার জেগে উঠেছে। রাজ্যের উদ্যোগে ‘ভোরের আলো’ পড়তেই যেন নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে গজলডোবা। আর তারই টানে ছুটে আসছেন পর্যটকরা। তাদের আগ্রহ ধরতে পেরে ভোর পাঁচটাতেই খুলে যাচ্ছে দোকানপাট। কাঠের উনুনের চায়ের দোকানে জমছে ভিড়। শীতে জবুথুবু শরীরটাকে একটু সেঁকে নেওয়ার চেষ্টা। তিরতির করে এঁকে-বেঁকে বয়ে চলেছে তিস্তা। পাশেই বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল। গহন অরণ্য। চা বাগান। এ পথে হাতির পালের নিত্য যাওয়া-আসার চিহ্ন স্পষ্ট। মাঝেমধ্যে তাদের সঙ্গে মোলাকাতও হতে পারে। তিস্তার চরে ছোট ছোট গ্রাম। মন জুড়িয়ে দেওয়ার উপকরণের অভাব নেই।
[ডাল লেকের ধাঁচে হাউসবোটে রাত কাটানোর সুযোগ পূর্বস্থলীর চাঁদের বিলে]
এদিকে হাত বাড়ালে উঁচু টিনের দোতলা বাড়ি। কোনওটা আবার কাঠের। চা বাগানের মেয়েরা রাগবি খেলছে। গ্রামের চাষি বউরা চলছে শহরের পথে। সামনেই যে পৌষ পার্বণ। বাড়ির উঠোনে চাল গুড়ো হচ্ছে ঢেঁকিতে। যোগ্য সঙ্গত করার জন্য রয়েছে খাঁটি গুড়। নলেনের সুবাসে ম ম করছে গজলডোবা ব্যারেজ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে দুধিয়া গ্রাম। বাংলাদেশ থেকে কারিগররা এসেছেন। খেজুর গাছে হাঁড়ি বেঁধেছেন তাঁরা। সকাল-বিকেল সেই রস পেড়ে জ্বাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে নলেন। গরম গরম সেই গুড় কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন বহু মানুষ।
তবে তিস্তাকে ছেড়ে যেতে মন চাইবে না। কেউ আপন মনে তার সঙ্গে গল্প করে চলেন। কোনও যুগল আবার এই খরস্রোতাকে সাক্ষী রেখেই সম্পর্কের জাল বুনতে থাকেন। গজলডোবার মতোই স্বপ্ন দেখেন নিজেদের জীবনেও এক নতুন ভোরের। দূর থেকে ভেসে আসে ভাওয়াইয়ার সুর। পাশ দিয়ে মাঝির দল জেনে যায়, তিস্তার বুকে নৌকা ভাসাবে কি না। যেদিকে মন চায় যতদূর। তাল গাছের ডিঙি নৌকায় জলে ভাসার দেদার ছাড়পত্র। এমন পরিবেশে তিস্তার কানে কানে কথা বললে কেউ বাধা দেবে না। কিংবা হরেক পাখি দেখা, ছবি তোলা। কত উপকরণ। ডানার ঝাপটায় জল কেটে উড়ে যায় নর্দান ল্যাপউইং, ফ্যালকেটেড ডাক, গ্রে হেরন।
[পাহাড়ে একঘেয়েমি? অন্য স্বাদের খোঁজ পেতে চলুন সিটং]
তবে প্রকৃতির উজাড় করে দেওয়া রূপ দেখে মন তো ভরল। কিন্তু পেট? তারও ব্যবস্থা রয়েছে হাতের নাগালে। বাঙালির এমনিতেই মৎস্যপ্রেম টানটান। আর গজলডোবায় পা রাখতে সেই প্রেমটা যেন আরও বেশি করে নাড়া দেয়। কারণ, চোখের সামনে তিস্তার ‘ইলিশ’ চকচকে বোরলি জালে উঠতে দেখে কার মন আর শান্ত থাকে। মাছ দিয়েই সেরে ফেলা যেতে পারে ব্রেকফাস্ট। নদীর পাড়েই রয়েছে রান্নার স্টল। পছন্দমতো রান্না করে দিতে হাজির আশপাশের গাঁয়ের বধূরা।
গজলডোবায় ভোর যতটা সুন্দর, পড়ন্ত বিকেল ঠিক ততটাই মোহময়ী। মনের ক্যানভাসে ছবি এঁকে দেয় তিস্তার বুকে সূর্য ডোবার দৃশ্য। বাথান থেকে গাভীর দল নিয়ে ফেরে রাখাল। আকাশ জুড়ে তখন পাখিদের ঘরে ফেরার পালা। ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে জঙ্গল-বস্তিতে। তিস্তা ব্যারাজে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতাও অন্যরকম। সেচ দপ্তরের বাংলো রয়েছে ‘হাওয়া মহল’। এই গজলডোবাতেই গড়ে উঠছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের প্রকল্প ‘ভোরের আলো’। রাজ্যের মেগা টুরিজম প্রোজেক্ট। পরিকাঠামো তৈরির কাজ শেষ। বিনিয়োগ আসছে। কিছুদিনের মধ্যেই খুলে যাবে পরিবেশ-বান্ধব রিসর্ট। এর বাইরে আরও এক হাতছানি আছে। তা হল কাঞ্চনজঙ্ঘা। আকাশ কিছুটা ফরসা থাকলে পাহাড়ের সুন্দরী দেখার সুযোগ মেলে এই গজলডোবা থেকে। পরশ পাথরের ছোঁয়া পেয়েছে শিলিগুড়ি লাগোয়া এই প্রকৃতিক্ষেত্র। এবার তার আস্বাদ নেওয়ার পালা।
[হাত বাড়লেই সবুজের রাজ্য, মন ভাল করার রসদ জঙ্গলমহলে]