রঞ্জন মহাপাত্র, দিঘা: সারা বছর ভিড় লেগে থেকে। বর্ষ শেষে শুরু হয়েছে বিচ ফেস্টিভ্যাল। বাঙালির চলো দিঘা স্লোগান এখন স্বার্থক। তবে সৈকতে যাওয়ার ইচ্ছে হলেও সেখানে এখনন ঠাঁই নাই অবস্থা। আর এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকা দালালরা। তাদের হাতযশে আচমকাই সব হোটেল বুকড। লজেও ঠাঁই নেই। চাইলে ইচ্ছেমতো ভাড়া গুনতে হবে। সৈকতের কাছে ২-৩ হাজার টাকাতেও ঘর মিলবে না। এই চক্রের পর্দাফাঁস করতে আমাদের অন্তর্তদন্ত। কীভাবে তারা কৃত্রিমভাবে হোটেলের ঘরের ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে তার খোঁজে এই প্রতিবেদন।
[সৈকতে একসঙ্গে ৪ হাজার মহিলার শঙ্খধ্বনি, গিনেসে নাম চায় দিঘা]
বুধবার সূচনা হয়েছে বিচ ফেস্টিভ্যালের। শনিবার থেকে স্কুলগুলিতে বড়দিনের ছুটি পড়ে যাচ্ছে। এমন একটা সময়ে বাঙালির জনপ্রিয় গন্তব্য দিঘা। লম্বা ছুটিতে অনেকেই দিঘার সমুদ্রের টানে ছুটেছেন। ক্যালেন্ডারে দিন দু’য়েক বা তিনেক লাল রঙের তারিখ দেখতে পেলেই টুক করে একটা হোটেল বুক করে দিঘাগামী ট্রেনে বা বাসে উঠে পড়েন অফিসের কেরানি থেকে শুরু করে বড়বাবু পর্যন্ত। পাহাড় থেকে মুখ ফিরিয়েছেন অনেকেই। তাই এবার দিঘামুখী হওয়ার সংখ্যাটা বেশ লম্বা। ঝামেলা এড়াতে মাস দুয়েক আগে থেকেই অনলাইনে কেউ কেউ হোটেল বুকিং করে নিয়েছিলেন। অনেকে আবার পরে দিঘা বেড়াতে আসার পরিকল্পনা করায় বুকিং দেরিতে করেন। যদিও ততক্ষণে অধিকাংশ হোটেল অনলাইনে বুকিং নেওয়া বন্ধ করা হয়। কারণ ক্রিসমাস-নিউ ইয়ারের ধুয়ো তুলে হোটেল ভাড়া স্বাভাবিক ৩ থেকে ১০ গুন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর টানা কয়েক দিনের ছুটিতে এসে ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির পকেট হয়ে যায় গড়ের মাঠ। গত কয়েক বছরে এই সমস্যায় জেরবার সাধারণ পর্যটকরা। পরপর দুই বা তিন দিন ছুটি পড়লেই এক ধাক্কায় রহস্যজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে দিঘার হোটেলের ভাড়া। বর্ষশেষে টানা ছুটিতে পোয়াবারো অবস্থা দালালদের।
[সমুদ্রপাড়ে তাঁবুতে রাত্রিবাস, এমন দিঘা কখনও দেখেছেন?]
ভাড়া বেড়েছে কয়েক গুন
ভিড় বাড়ার সঙ্গে দিঘায় বেড়ে যায় হোটেল ভাড়া। মন্দারমণি পর্যটন কেন্দ্র দিঘার থেকেও হয়ে ওঠে আরও দামি। হোটেলর যে রুম কয়েক মাস আগে ৩৫০০ টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়েছে, সেই ঘরই এখন ৯০০০টাকার বিনিময়ে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। তবে হ্যাঁ, হোটেল ভাড়া ৩ গুন বাড়ালেও হোটেল ব্যবসায়ীরা বুদ্ধি খাটিয়ে বাড়িয়েছেন যাতে ধরা না পড়েন। ৩৫০০টাকার প্যাকেজে ডিনার এবং ব্রেকফাস্ট ফ্রিতে দেওয়া হত। আর এখন ৯০০০ হাজারে লাঞ্চ শুধু যোগ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্যাকেজ ছাড়া হোটেল বুকিং দেওয়া হচ্ছে না। তাজপুরের অবস্থাও ঠিক একই। তার উপর রয়েছে দালাল রাজ।
কীভাবে সক্রিয় দালালরা?
না, সাদা চোখে আপনি ধরতে পারবেন না। দিঘার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী রয়েছেন যাদের কাজ হল ভিড়ের সম্ভাবনা অনুমান করে আগে থেকেই হোটেলর ঘর স্বাভাবিক ভাড়ায় বুকিং করে নেওয়া। ভিড় বাড়লে তা চড়া দামে বিক্রি করা হয়। চারদিনের ভিড়ে মুনাফায় ভরে ওঠে পকেট। সাধারণ মানুষকে কীভাবে ঠকানো হয় তা দেখিয়ে দিয়েছে সৈকত শহর।
নিয়মকে বুড়ো আঙুল
পর্যটকদের অভিযোগ, ভিড়ের অজুহাতে একশ্রেণির হোটেল ও লজের ভাড়া একলাফে বেড়ে কোথাও দ্বিগুন আবার কোথাও তিন গুন হয়েছে। এখন থেকেই পর্যটকরা ভুগতে শুরু করেছেন। আগে থেকে হোটেল বুক না-করে যাঁরা দিঘায় আসছেন তাঁরা অনেকেই হোটেল কালোবাজারির দাপটে আর থাকার জায়গা পাচ্ছেন না। তাই অনেকেই সারাদিন কাটিয়ে রাতের ট্রেনে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। যাঁরা থেকে যাচ্ছেন তাঁদের অনেক বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। কলকাতা থেকে আসা এক পর্যটক জানালেন, ‘‘যে ঘরের ভাড়া ৭০০-৮০০ টাকা ছিল, সেই ঘরের ভাড়াই হঠাৎ করে ১২০০-১৪০০ টাকা চাইছে।’’ কোথাও আবার তা ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। তাঁদের অভিযোগ, দিঘায় অধিকাংশ হোটেল, লজে ভাড়ার তালিকা টাঙানো নেই। তারই সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির হোটেল মালিক যেমন খুশি ভাড়া আদায় করছেন। অথচ দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ থেকে ভাড়ার তালিকা হোটেলের রিসেপশনে টাঙানো নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু তা মানেন না প্রায় কেউই। পর্যটকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও উঠছে হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তা হলে সব জেনেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেনা অসাধু হোটেল মালিকদের বিরুদ্ধে? প্রশ্ন তুলেছেন পর্যটকেরা।
কী করছে প্রশাসন?
ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কাঁথি মহকুমা প্রশাসন দিঘায় প্রশাসনিক বৈঠকের আয়োজন করে। যেখানে দিঘা,মন্দারমণি,তাজপুর,শংকরপুর পর্যটন কেন্দ্রের হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের স্পষ্টত হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। হোটেল ভাড়া স্বাভাবিকের থেকে বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে হোটেলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এবিষয়ে অভিযোগ জমা পড়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। সেইসঙ্গে জেলা প্রশাসন ও মহকুমা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনকে এবিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে কোনভাবেই হোটেল ভাড়া বাড়িয়ে নেওয়া না হয়। তিনি পুলিশকে জানিয়ে দেন, অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। হোটেলে বেশি লোক আসছে বলে বেশি ভাড়া নেব, হোটেলমালিকদের এই বিপজ্জনক প্রবণতা থেকে দূরে থাকতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। নইলে আইনি পথে হাঁটবে রাজ্যও, হুঁশিয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর। কোনওভাবেই পর্যটকদের কোনও অসুবিধা তৈরি করা যাবে না। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দশমতো মহকুমা প্রশাসনও হোটেল ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে কোমর বেঁধে নেমেছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.