Advertisement
Advertisement

Breaking News

Election

সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বছর, কী প্রভাব দুনিয়ার কোটি কোটি নাগরিকের উপরে?

ভূ-রাজনৈতিক রঙের বিন্যাস কি বদলাবে?

2024 is going to be the world's biggest election year
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:March 15, 2024 6:02 pm
  • Updated:March 15, 2024 6:02 pm

৬০টি দেশের জনগণ, দুনিয়ার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, ভোট দিয়ে তাদের সরকার নির্বাচিত করবে এ বছর। ফলশ্রুতি, ২০২৪ হতে চলেছে সভ্যতার ইতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বছর। এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে দুনিয়ার কোটি কোটি নাগরিকের উপর। যা বদলে দিতে পারে পৃথিবীর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। লিখছেন অতনু বিশ্বাস

নির্দিষ্ট সময়ের পর ভোট হবে, তাতে থাকবে শাসন-ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা। ক্ষমতার বদল যে হতেই হবে, এমন কোনও বাধ‌্যবাধকতা অবশ্য নেই। তাই বলা ভালো যে, শাসন-ক্ষমতা বদলে দেওয়ার জাদুদণ্ড থাকবে জনগণেশের হাতে। ব্যালটে ছাপ দিয়ে হোক কিংবা হোক ইভিএমের (EVM) বোতাম টিপে। এটাই গণতন্ত্র।

Advertisement

ভোটের মাধ্যমে তাই শুধুমাত্র দেশের শাসন-ক্ষমতারই বদল হয় না, সেই সঙ্গে বদলে যায় দেশের নীতি, সমাজের দিশা, বিদেশনীতি। তবে ভোটের মধ্য দিয়েই বদলায়, না কি জনগণের ক্রমেই বদলাতে থাকা ধ্যানধারণা দীর্ঘদিন ধরে জমে থেকে তার প্রকাশ ঘটে ভোটের মধ্যে, সে নিয়ে চর্চা চলতে পারে বইকি। দুনিয়ায় এত দেশ। প্রতি বছরই বহু দেশে ভোট হয়। শাসক থাকে, আবার শাসক বদলায়। দুনিয়ার মানচিত্রেরও বদল ঘটে। বামপন্থার লাল রং কোথাও দক্ষিণপন্থার নীল রঙে রূপান্তরিত হয়, কোথাও বা নীল হয় লাল। লাল-নীলেরও রকমফের হয়। গোলাপি, গাঢ় লাল।

Advertisement

গাঢ় কিংবা হালকা নীল। বসন্ত কিংবা শরতের প্রকৃতির রংবদলের এর তুলনা করা যায় কিনা সেটাও আকর্ষণীয় চর্চার বিষয় হতে পারে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও কখনও সমগ্র একটা মহাদেশ-ই রং বদলাতে শুরু করে। এই তো কিছু দিন আগেই দক্ষিণ আমেরিকায় (South America) খেলে গেল ‘গোলাপি তরঙ্গ’। রঙের খেলা কিন্তু থেমে থাকে না, পালটে পালটে যায়। এই রঙের খেলা সভ্যতার গতিশীলতার নির্দেশকও বটে। আর্জেন্টিনায় দক্ষিণপন্থী জেভিয়ার মিলেই প্রেসিডেন্ট হলেন। মহাদেশের গোলাপির মধ্যে লাগল নীলের ছোঁয়া।

[আরও পড়ুন: হাওড়া ব্রিজে ভয়াবহ দুর্ঘটনা, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিলারে ধাক্কা বাসের]

ইউরোপ আবার ক্রমেই দক্ষিণপন্থী হয়ে উঠছে। মহাদেশের দেশে দেশে দক্ষিণপন্থী (Rightist) এবং অতি-দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল, সুইডেন, গ্রিস, কোথায় নয়! এমনকী জার্মানি কিংবা ফ্রান্সের মতো বড় অর্থনীতির যে দেশগুলোর শাসন-ক্ষমতায় এখনও মধ্য-বামপন্থী কিংবা মধ্যপন্থীরা রয়েছে, সেখানেও। এসবের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত এবং কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা আকর্ষণীয় হতে পারে। কিন্তু সেটা তোলা থাক অন্য সময়ের জন্য।এসবের মধ্যে ২০২৪ সত্যিই ব্যতিক্রমী। সার্বিকভাবে এটা এ-গ্রহের একটা ভোটের বছর বলা চলে।

আমরা অবশ্যই লোকসভা ভোটের দামামা শুনতে পাচ্ছি। এবং স্বাভাবিক কারণেই তা আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে কিন্তু এ-বছর দুনিয়াজুড়ে মস্ত কিছু ভোট (Election) রয়েছে। প্রায় ৬০টি দেশের জনগণ, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, ভোট দিয়ে তাদের সরকার নির্বাচিত করবে এ-বছর। ফলশ্রুতি, ২০২৪ হতে চলেছে সভ্যতার ইতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বছর। এই মাত্রার এক প্রায়-সর্বব্যাপী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে দুনিয়ার কোটি কোটি নাগরিকের উপর। যা বদলে দিতে পারে পৃথিবীর ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

[আরও পড়ুন: কীভাবে কপালে চোট মুখ্যমন্ত্রীর? ‘ধাক্কা রহস্যে’র ব্যাখ্যা দিল তৃণমূল]

এছাড়াও এ-বছর রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এই সমস্ত কিছুর মধ্যে কিছু কিছু ভোটের প্রভাব আবার সংশ্লিষ্ট দেশ বা তাদের প্রতিবেশী দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে বিস্তৃত হতে পারে এ গ্রহের সর্বত্র। দেখা যাক এমনই কয়েকটা নির্বাচন এবং সেসবের সম্ভাব্য ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব। বছরের শুরুর দিকে যেমন তাইওয়ানের ভোটে চিন-বিরোধীদের জয়কে চিনা নেতা শি জিনপিংয়ের পরাজয় হিসাবে দেখেছেন অনেকে। তাইওয়ানকে চিনের অন্তর্ভুক্তিকরণের প্রচেষ্টা আপাত-ধাক্কা খেয়েছে এর ফলে, অবশ্যই। আমাদের প্রতিবেশী দুই দেশ, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে ভোট নিয়ে তরজা চলেছে বিস্তর। বাংলাদেশে প্রধান বিরোধীদের বয়কট এবং পাকিস্তানের ভোট-পরবর্তী নাটকের মধ্যমেয়াদি রাজনৈতিক ফল দেখার জন্য আমাদের অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে আরও খানিকটা সময়।

পর্তুগালের সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল মার্চের ১০ তারিখ। মধ্য-দক্ষিণপন্থী আর মধ্য-বামপন্থী দল এগিয়ে থাকলেও অতি-দক্ষিণপন্থী দল ‘চেগা’ পেয়েছে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভোট। একটা হিসাব দিলেই স্পষ্ট হবে কীভাবে দ্রুত বদলাচ্ছে ইউরোপের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল। ২০১৯-এ চেগা পেয়েছিল ১.৩% ভোট, ২০২২-এ পেয়েছিল ৭.৩% ভোট, আর ২০২৪-এ পেয়েছে ১৮.১% ভোট।

যাই হোক, ভারত ছাড়া এ বছরের তিনটে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের প্রেক্ষিত এবং তার সম্ভাব্য ফলের পর্যালোচনা করা যাক। প্রথম ভোট জুনে। সেটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভোট। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির ভোটাররা ভোট দিয়ে প্রতিনিধি পাঠান ইউরোপীয় পার্লামেন্টে। ব্রাসেল্‌সে যার সদর দপ্তর। ২৭টা দেশের এই জোটের প্রেক্ষিতে এই ইউরোপীয় পার্লামেন্ট কিন্তু ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নীতি-বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেয় এরাই। ইউরোপের ল্যান্ডস্কেপ ক্রমশ নীলচে হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এটাও পরিষ্কার যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভোটেও ক্ষমতা বাড়বে দক্ষিণপন্থীদের। ফলশ্রুতি– অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিক, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড আর স্লোভাকিয়ার মতো ন’টি দেশে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-বিরোধীদের শীর্ষে আসার সম্ভাবনা। আরও ন’টি দেশ যেমন, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, লাতভিয়া, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্পেন আর সুইডেনে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হবে এই ইউরোপীয় ইউনিয়ন-বিরোধীরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই ডাইনে মোড়ার ফলশ্রুতিতে প্রভাব পড়বে তাদের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতিতে, বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে। এই নতুন সংখ্যাগরিষ্ঠরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতির বিরোধিতা করবে, এটাই প্রত্যাশিত।

এই বছরের শেষদিকে, নভেম্বরের ৫ তারিখ, রয়েছে অতি-গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবং খুব বড় কিছু না ঘটলে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে লড়াই হতে চলেছে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আর রিপাবলিকান প্রার্থী প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে। এবং ট্রাম্প যেভাবে তঁার প্রভাব অক্ষুণ্ণ রেখেছেন, লড়াইটা যে খুব সহজ নয়, সেটাও ঠিক। এই লড়াইতে ট্রাম্প যদি জেতেন, তাহলে সেটা সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ হবে কি না, সে নিয়ে আলোচনা চলতে পারে বিলক্ষণ।

এবং এই ইতিহাসের নির্মাণ খুব অসম্ভব নয়, বিশেষ করে বাইডেনের অ্যাপ্রুভাল রেটিং এই মুহূর্তে বেশ খারাপ। ভোটের অবশ্য আট মাস বাকি, এবং সেটা রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে অনেকখানি সময়। যাই হোক, ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হলে মার্কিন সমাজে তার প্রভাব তো পড়বেই। তবে প্রেসিডেন্ট যিনিই হোন, বা যে দল-ই ক্ষমতায় আসুক, তাইওয়ান কিংবা ইজরায়েল নিয়ে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির বিরাট কোনও পরিবর্তন কেউই দেখতে পাচ্ছেন না।
তবে অন্য অনেক পরিবর্তন অবশ্যই হবে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে ইউক্রেনে মার্কিন অনুদান কমতে পারে। ইরান, কিংবা পরিবেশ নিয়ে বদলাতে পারে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি। উত্তর কোরিয়ার একনায়কের সঙ্গে ট্রাম্পের তরজা দেখার আবার সুযোগ ঘটতে পারে দুনিয়ার। আবার, এতকিছু নাও হতে পারে। চার বছরের ব্যবধানে ট্রাম্প ১.০ আর ট্রাম্প ২.০-কে দু’জন ভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবেও দেখতে পারে দুনিয়া।

মোটের উপর আমেরিকা লাল থেকে নীল হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে এই নভেম্বরের ভোটে। সেই সঙ্গে ইউরোপ ক্রমশ নীল, গাঢ় নীল হয়ে চলেছে। এসবের মধ্যে একটা ভারসাম্য আনতে পারে কিন্তু ব্রিটেনের ভোট। নিয়মানুসারে, ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন হতে হবে পরের জানুয়ারির মধ্যে। তবে বেশিরভাগ পর্যালোচকের মতে, ঋষি সুনক ভোট ডাকতে পারেন এ-বছরের শেষদিকের কোনও এক সময়। এবং চোদ্দো বছরের দক্ষিণপন্থী কনজারভেটিভ শাসনে পঁাচ প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকার পর এবং ‘ব্রেক্সিট’-এর মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাড়ি ছিঁড়ে বেরনোর পর ব্রিটেন এবার ঝুঁকে পড়েছে বামপন্থী লেবার পার্টির দিকে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখাচ্ছে প্রায় ২০ শতাংশ ভোটে এগিয়ে লেবার পার্টি। তাই খুব বড়সড় কিছু বদল না ঘটলে লেবার নেতা ‘স্যর’ কেয়ার স্টারমার যে পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন, সেটাও একরকম নিশ্চিত। এ কিন্তু এক গুরুত্বপূর্ণ বদল। ইউরোপ যেখানে দক্ষিণপন্থী কিংবা অতি-দক্ষিণপন্থী হয়ে উঠছে, আমেরিকার ট্রাম্পের দক্ষিণপন্থী রিপাবলকান দল যেখানে হোয়াইট হাউস দখলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে হাজির, সেখানে ব্রিটেনের লেবার পার্টি আর তার নেতা কেয়ার স্টারমার আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্যের নিরিখে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন বইকি। সব মিলিয়ে, ২০২৪ বোধ করি ভূ- রাজনৈতিক রঙের বিন্যাস বদলে দিতে পারে অনেকটাই। যেমনটা সচরাচর হয় না এক বছরের সীমায়।

(মতামত নিজস্ব)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ