Advertisement
Advertisement
India

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে ভারতে থাকা আফগান শরণার্থীরা

তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের রাস্তা কি খুলে রাখছে ভারত?

Afghan refugees in India face uncertain future | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:September 1, 2021 3:36 pm
  • Updated:September 1, 2021 3:36 pm

তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের রাস্তা কি খুলে রাখছে ভারত? কূটনৈতিক এই অনিশ্চয়তার সমান্তরালে ঘুরঘুর করছে কিছু মানবিক বিষয়। প্রথমত, ভারত কি শরণার্থীদের কিঞ্চিৎ স্বস্তি ও মঙ্গলে আরেকটু উদার হতে পারে? কিংবা রাষ্ট্রসংঘ? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 

Advertisement

ফগানিস্তান নিয়ে ভারতের ঘোষিত নীতি ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ হলেও, জনপ্রিয় ধারণা, স্বীকৃতির প্রশ্নে নয়াদিল্লি আগের তুলনায় অনেকটাই নরম। নইলে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে সন্ত্রাসে মদত না দেওয়ার জন্য ‘তালিবান’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘সব আফগান গোষ্ঠীকে’ আহ্বান জানানো হত না। ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যে বিবৃতি জারি করেছিল, তাতে সন্ত্রাসে মদত না দেওয়ার জন্য ‘তালিবান ও আফগান গোষ্ঠীগুলিকে’ আহ্বান জানানো হয়েছিল। আগস্ট মাসের পুরোটাই নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিত্বের দায়িত্বে ছিল ভারত। কূটনীতিতে শব্দচয়ন ও তার ব্যবহার অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। প্রথম বিবৃতিতে ‘তালিবান’ উচ্চারণ এবং পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার সম্ভবত এটাই বোঝাচ্ছে, যুদ্ধবাজ ও সন্ত্রাসী সরকারকে স্বীকৃতি-দানের প্রশ্নে ভারত হয়তো তার আড়ষ্টতা ভাঙতে চলেছে।
কী আশ্চর্য, সেই বিবৃতি প্রচারের আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে দোহায় তালিবানের ডেপুটি হেড শের মহম্মদ আব্বাস স্টানেকজাই যা বললেন, সাউথ ব্লকের কর্ণগহ্বরে অবশ্যই তা মধুর ধ্বনি। শের মহম্মদের কথায়, “এই উপমহাদেশে ভারত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সঙ্গে তালিবান সব ধরনের সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী। এমনকী, আগের মতো বাণিজ্যিক সম্পর্কও।” দেরাদুনের ‘ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমি’-র এই প্রাক্তন ছাত্রের সংক্ষিপ্ত বার্তা আফগানিস্তানের (Afghanistan) ‘মিল্লি’ টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করেছে। বোঝা যাচ্ছে, বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি-লাভ তালিবানদের কাছে কতখানি জরুরি ও অর্থবহ।

Advertisement

[আরও পড়ুন: আফগানিস্তানে লাঠি যার দেশ তার]

প্রথম তালিবানি শাসনকে ভারত মান্যতা দেয়নি। কুড়ি বছর আগের চরম মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা রং বদলে নামাবলি চড়িয়েছে, ভারত এখনও তা পুরোপুরি মানতে প্রস্তুত নয়। না মানারই কথা। কেননা, মন ও মানসিকতা বদলের ধারাবাহিকতার পরিচয় তালিবানরা এখনও দিতে পারেনি। তবে পরিচয় দিলেও ভারতের সামনে বিকল্প সামান্যই! স্বীকৃতি না দিয়ে কুড়ি বছরের লগ্নি ও ‘গুড উইল’ জলাঞ্জলি দেওয়া একটা বিকল্প। অন্য বিকল্প, নীতির সঙ্গে সাময়িক আপস করে দেশের স্বার্থরক্ষা ও তালিবান ভূমিতে ভারতের পায়ের ছাপ আবছা হলেও টিকিয়ে রাখা। ভারত সম্ভবত দ্বিতীয় পথেই হাঁটবে ও ভবিষ্যতের ছবি স্পষ্টতর হওয়ার অপেক্ষায় থাকবে। সেজন্য অলক্ষে, সরাসরি কবুল না করে তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে খিড়কির দরজাটা খুলে রেখেছে। রাষ্ট্রসংঘের বিবৃতি ও শের মহম্মদ আব্বাস স্টানেকজাইয়ের মন্তব্য সেই ইঙ্গিতবাহী।

কূটনৈতিক এই অনিশ্চয়তার সমান্তরালে ঘুরঘুর করছে কিছু মানবিক বিষয়। প্রথমত, দেশের স্বার্থে এ যাবৎ অনুসৃত নীতির সঙ্গে আপস করার মতো ভারত কি শরণার্থীদের কিঞ্চিৎ স্বস্তি ও মঙ্গলে আরেকটু উদার হতে পারে? কিংবা রাষ্ট্রসংঘ? তারা কি পারে না আরও একটু তৎপর ও মানবিক হতে? দিল্লির বসন্ত বিহারে রাষ্ট্রসংঘের ‘হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস’-এর (ইউএনএইচসিআর) দপ্তরের সামনে সপ্তাহব্যাপী অবস্থানরত আফগানদের দেখে এই ভাবনা মন ছায়। কুড়ি বছরের বেশি কাবার হয়ে গিয়েছে। হতভাগ্য শরণার্থী আফগানদের ভবিষ্যৎ এখনও অন্ধকারে। পরভূমে আরও একটু সহানুভূতি, আশ্বাস ও আশার আলো দেখার আকুতি কী প্রবল!

একইরকমের ঝুঁঝকো আঁধার ও হতাশায় ডুবে রয়েছেন কাবুল থেকে সদ্য ফেরা দিল্লির তিলক নগরে আশ্রিত আফগানরাও। লাজপত নগর, ভোগল কিংবা মালভিয়া নগরে বসবাসকারী, বসন্ত বিহারে বিক্ষোভরত স্বদেশিদের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য স্রেফ ধর্মে। তিলক নগরের এই শিখ ও হিন্দু আফগানরা আপাতত বিভিন্ন গুরুদ্বারে আশ্রিত। লঙ্গরের কল্যাণে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নসংস্থানের চিন্তা এখন হয়তো নেই। কিন্তু কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর? উত্তর জানা নেই শিখ ও হিন্দু সম্প্রদায় থেকে নির্বাচিত একমাত্র সাংসদ, নরেন্দ্র সিং খালসা-র। নিজ দেশে কিছুদিন আগেও যিনি ছিলেন ক্ষমতাবান। নরেন্দ্রর বাবা অবতার সিংও ছিলেন আফগান সংসদের সদস্য। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে মানববোমা যে ১৮ জনের প্রাণ নিয়েছিল, অবতার ছিলেন তাঁদের একজন। নরেন্দ্র তবু দেশ ছাড়েননি। বাবার জায়গায় সাংসদ হয়ে মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন। আজ তাঁর একটাই কথা, “সব শেষ হয়ে গেল। আর কোনও আশা নেই।”

পঞ্চাশ বছর আগেও আফগানিস্তানে শিখ ও হিন্দুদের সংখ্যা ছিল দু’লাখ। দেশত্যাগের হিড়িক শুরু হয় নয়ের দশকে নাজিবুল্লা সরকারের পতনের সময় থেকে। প্রথমে মুজাহিদ, পরে তালিবানদের চোখে ‘বিধর্মী অপরাধী’ হিন্দু-শিখদের কেউ আসেন ভারতে, বাকিরা যান ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায়। আমেরিকার ভরসায় হামিদ কারজাই ও আশরফ গনির আমলে যাঁরা দেশে ফিরেছিলেন, এবার হয়তো তাঁরা চিরতরে ঠাইনাড়া হলেন। ভারতের হিসাবে উদ্ধারের অপেক্ষায় এখন বড়জোর শ’খানেক হিন্দু-শিখ। সরকার জানিয়েছে, তাঁদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনাই প্রধান কাজ।

রাজনীতির বাজারে এঁরা আচমকাই বড় পণ্য! কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী (শিখ) তো বলেই দিয়েছেন, “নতুন নাগরিকত্ব আইন এইসব হতভাগ্যের জন্যই।” বিজেপির কারও কারও দাবি, ওই আইনে নাগরিকত্ব পাওয়ার শর্ত ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে বাড়িয়ে ২০২১ সাল করা হোক। পাঞ্জাবের ভোটের আগে অকালি দলের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরসিমরত কৌরের কণ্ঠেও সেই সুর। সম্মিলিত সেই সরগমে নরেন্দ্র সিং খালসা-সহ গুরুদ্বারে আশ্রিত হিন্দু-শিখ আফগানরা আশার ফানুস না-ফুলিয়ে শুধু চান বেঁচেবর্তে থাকার মতো একটু সুযোগ। অনিশ্চয়তা ও অনটনে যেন ভেসে যেতে না হয়।

অথচ, বসন্ত বিহারে অবস্থানরত আফগানি মুসলমান শরণার্থীদের সেই ভরসাটুকুও নেই। কারণ, তাঁদের প্রতি ভারত সরকারের কোনও আনুষ্ঠানিক দায়বদ্ধতাই নেই। ১৯৫১ সালের রাষ্ট্রসংঘের উদ্বাস্তু কনভেনশনে ভারত সই করেনি। ফলে শুধু আফগানরাই নন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের মান্যতা না-পাওয়া অন্য কোনও দেশের শরণার্থীই ব্রিটেন-আমেরিকার মতো অধিকারের দাবি এদেশে করতে পারেন না। এদেশে আফগান শরণার্থীদের উপস্থিতিও নয়-নয় করে বিশ-পঁচিশ বছর হয়ে গেল। দীর্ঘমেয়াদি ভিসায় তাঁদের টিকে থাকা। সপরিবার রাষ্ট্রসংঘের অফিসের সামনে তাঁরা অবস্থান করছেন বেঁচে থাকার সামান্য অধিকারের দাবিতে। ভারতের প্রতি তাঁরা কৃতজ্ঞ। নিরুপদ্রবে থাকা ও পুলিশি হয়রানি সইতে হচ্ছে না বলে। দাবি যতটুকু, তা রাষ্ট্রসংঘের কাছে। অধিকারের। রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী হাই কমিশনার আফগানিদের বিশেষ ‘উদ্বাস্তু কার্ড’ দিয়েছে। সামান্য সাহায্যও করেছে, প্রয়োজনের তুলনায় যা বিন্দুসম। কিন্তু ভারতে তাঁদের কাজের অধিকার নেই। শিক্ষার অধিকার নেই। স্বাস্থ্যের অধিকার নেই। এমনকী, যে-দেশ শরণার্থীদের আবাহন করছে, রাষ্ট্রসংঘের অনুমতি-বিনা সেখানে যাওয়ার অধিকারও নেই।

দিল্লিতে আফগান মুসলমান শরণার্থীদের আগলে রেখেছেন তালিবানদের (Taliban) হাতে অত্যাচারিত এবং দশ বছর আগে আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত আহমদ জিয়া গনি। অবস্থানরত ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে তাঁর আকুতি, “আমাদের জীবন তো শেষ। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্তত শিক্ষা ও কাজের সুযোগটুকু
কি পেতে পারে না? কিংবা বিদেশে যাওয়ার অনুমতি?”

কী করে চলছে তাহলে এতগুলো বছর? গনি সাহেব বললেন, “এতদিন তবু চলছিল। রেস্তরাঁ লিজ নিয়ে, গেস্টহাউস চালিয়ে, অন্যের লাইসেন্সে দোকান দিয়ে, দোকানের কর্মী হিসাবে, গেস্টহাউসের কেয়ারটেকার হয়ে, বিনা লাইসেন্সে ট্যাক্সি চালিয়ে অথবা চিকিৎসার জন্য আসা আফগান, তাজিক, উজবেক, তুর্কি বা কাজাখদের জন্য দোভাষী হয়ে। এখন সব বন্ধ। সুড়ঙ্গজুড়ে শুধুই অন্ধকার।”

সরকারের চিন্তার সিংহভাগজুড়ে যেখানে তালিবানদের স্বীকৃতিদানের দ্বন্দ্ব, চিন-পাকিস্তান অক্ষের মোকাবিলা, আইএসআই ও হাক্কানি গোষ্ঠীর সম্ভাব্য বেয়াদপি, ৩০০ কোটি লগ্নির ভবিষ্যৎ অথবা কাশ্মীর- শরণার্থী মঙ্গলকাব্যের স্থান সেখানে কতটুকু? সেই উত্তর আফগান শরণার্থীদের এখনও অজানা।

[আরও পড়ুন: তালিবানের উত্থান থেকে বিরোধী ঐক্যে চাপে কেন্দ্রীয় সরকার, তবুও বিলাসিতা দেখাতে পারেন মোদি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ