Advertisement
Advertisement

Breaking News

BJP

গুজরাটে ‘শিক্ষা’ কতটা ‘উচিত’ ছিল?

অমিত শাহ রাখঢাক না করেই বলেছেন, ২০০২ সালে ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়েছিলেন।

Amit Shah and 'lesson taught' in Gujarat | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:December 1, 2022 1:22 pm
  • Updated:December 1, 2022 1:22 pm

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচনী জনসভায় রাখঢাক না করে বলেছেন, ২০০২ সালে ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়েছিলেন বলেই গত দু’-দশক গুজরাটে দাঙ্গা হয়নি। আর, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, ‘কংগ্রেস আমলে রাজ্যে দাঙ্গা ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিভিন্ন জাত ও ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে কংগ্রেস প্ররোচনা দিত।’ তা, চিরস্থায়ী এই শান্তির নিকেতনে এত বছর পর হঠাৎ নির্বাচনের আগে অমিত শক্তিধরের মুখে নতুন করে কেন ‘উচিত শিক্ষা’-র চেতাবনি? তবে কি বিজেপি জয় সম্পর্কে চিন্তিত? কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

কার দাবি কতটা সত্যি, কতটাই বা জল মেশানো, এত দূর থেকে তা বোঝা কঠিন। গুজরাটে বসবাসকারী বন্ধুবান্ধবরা বলছেন, আরও একবার বিজেপির বিজয়রথ নিশ্চিতভাবেই রাজ্য দাপাতে চলেছে। এত বছর যে-লড়াই ছিল দ্বিমুখী, এবার তা ত্রিমুখী। পার্থক্য এটুকুই।

Advertisement

গুজরাট নামক নিস্তরঙ্গ দিঘিতে এবার যেটুকু ঢেউ দৃশ্যমান, নিঃসন্দেহে তার ষোলো আনা কৃতিত্ব আম আদমি পার্টির। অরবিন্দ কেজরিওয়াল কোমর বেঁধে নেমেছেন বলেই গুজরাটের ভোট-চালচিত্রে এবার নতুন রঙের পোঁচ লেগেছে। ভোটযুদ্ধর রসায়ন তিনি পাল্টাতে পারবেন কি না পরের কথা, ভোট-পাটিগণিত অবশ্যই কিছুটা হয়তো ঘেঁটে দেবেন। কংগ্রেসকে হটিয়ে আম আদমি পার্টি রুপো জিততে পারলে তাঁর কাছে সেটা হবে সোনা জেতার চেয়েও বেশি সাফল্যের! এতদিন ধরে মোদি-রাজ্যে এভাবে খবরের শিরোনামে থাকা, তাই-বা চাট্টিখানি কথা হয় কী করে?

Advertisement

তবে শেষরক্ষা হবে কি না সন্দেহ। কংগ্রেসের রাজ্য-নেতাদের দাবি, তাঁরা মিডিয়ায় হয়তো নেই, তবে ময়দানে আছেন। সেটা আছেন সংগঠনের জোরে। উল্টোদিকে কেজরিওয়ালের দলের উপস্থিতি যতটা জমিতে, তার বহুগুণ মিডিয়ায়। কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, ‘পাড়ায় অনূঢ়া কন্যা-সহ নতুন ভাড়াটে এলে পুরনো বাসিন্দাদের কৌতূহল বাড়ে। কেজরিওয়ালদের নিয়ে আগ্রহ তেমনই।’

[আরও পড়ুন: ইউক্রেন যুদ্ধে জটিল ভারসাম্যের খেলায় ভারত, কোন খাতে মোদির বিদেশনীতি?]

দাবি ও পাল্টা দাবির এমন কচকচানি থাকে বলেই ভোটের রং, রূপ ও জেল্লা খুলে যায়। এবার গুজরাতের চালচিত্রও তেমনই। সেই পটে নতুন রং চাপালেন স্বয়ং দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ভূমিপুত্র এবং এই যুদ্ধের প্রধান সেনানী অমিত শাহ নির্বাচনী জনসভায় রাখঢাক না করে শুনিয়েছেন, ২০০২ সালে ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়েছিলেন বলেই গত দু’-দশক গুজরাটে দাঙ্গা হয়নি। রাজ্যে চিরস্থায়ী শান্তি বিরাজমান।

‘উচিত শিক্ষা’ তাঁরা কাদের দিয়েছেন এবং কীভাবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা ব্যাখ্যা করেননি। কোথায় কতটুকু কীভাবে বলা উচিত, পোড়খাওয়া রাজনীতিকরা তা জানেন। শাহ তাই ‘ওদের’ বলতে কাদের বুঝিয়েছেন, সেই ব্যাখ্যায় যাননি। যদিও বুঝতে অসুবিধে নেই, ২০০২ সালে গুজরাটে কী ঘটেছিল, তার ফল কী হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য ভাষণে চিরশত্রু কংগ্রেসের নামোল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘কংগ্রেস আমলে রাজ্যে দাঙ্গা ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিভিন্ন জাত ও ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে কংগ্রেস প্ররোচনা দিত। উসকানি দিত। একের সঙ্গে অন্যের লড়াই বাধিয়ে দিত। এইভাবে কংগ্রেস তার ভোট ব্যাংক বাড়িয়ে সমাজের এক বিরাট অংশের মানুষের প্রতি অবিচার করেছে।’ অমিত শাহ এরপর বলেন, ‘২০০২ সালে ওদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়। তারপর থেকে ওরা সমঝে গিয়েছে। মারদাঙ্গার রাস্তা ছেড়ে দিয়েছে। দাঙ্গাকারীদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে বলেই ২০ বছর ধরে গুজরাটে শান্তি স্থায়ী হয়েছে।’

সেই শিক্ষা কতটা ‘উচিত’ ছিল, ২০০২-এর দাঙ্গার বীভৎসতা তার প্রমাণ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ১ হাজার ৪৪ জন নিহত হয়েছিল, আহত আড়াই হাজার এবং নিখোঁজ ২২৩ জন। বেসরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা ২ হাজারেরও বেশি। হত্যা ও ধর্ষণ ছাড়াও অগ্নিসংযোগ, লুঠপাট এবং সম্পত্তি ধ্বংসের আর্থিক পরিমাপ কত- সেসব এখনও হিসাবনিকাশের বাইরে। গোটা দেশ ও সভ্যসমাজ সেই হিংসার স্বরূপে শিউরে উঠেছিল। নরেন্দ্র মোদি তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। অমিত শাহ তাঁর সুগ্রীব দোসর।

২০ বছর আগের সেই ‘উচিত শিক্ষা’ সত্যি সত্যিই এত মোক্ষম ছিল যে, বাস্তবিকই আজ পর্যন্ত সংখ্যাগুরুদের বিরুদ্ধে গুজরাটে (Gujarat) ট্যাঁফো করার সাহস কেউ পায়নি। কিন্তু চিরস্থায়ী এই শান্তির নিকেতনে এত বছর পর হঠাৎ নির্বাচনের মুখে অমিত শক্তিধরের মুখে নতুন করে কেন সেই চেতাবনি? তবে কি বিজেপি তার জয় সম্পর্কে চিন্তিত? রাজ্যজুড়ে দলের অন্দরমহলের অসন্তোষ ধামাচাপা দিতে বিজেপি জেরবার? বিদ্রোহী প্রার্থীদের মোকাবিলায় ব্যতিব্যস্ত? বিব্রতকর এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হিসাবেই কি বিজেপি তবে ধর্মীয় মেরুকরণকে নতুনভাবে মুশকিল আসান ধরে নিচ্ছে? প্রশ্ন অনেক। ব্যাখ্যাও। উদ্দেশ্য যাই হোক, এই একটি মন্তব্যই মুখোশের আড়ালের প্রকৃত মুখের যাবতীয় ক্রূরতা ও হিংস্রতা দর্শন করিয়েছে। গণতন্ত্রর আবডালে থাকা স্বৈরাচারীর অবয়বের অবগুণ্ঠন সরিয়ে দিয়েছে।

গুজরাটের গণ্ডি পেরিয়ে এমন ‘উচিত শিক্ষা’-র নমুনা আজ রাজ্যে রাজ্যে। গত বছর মার্চ মাসে পার্লামেন্টে পেশ করা সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ৫ বছরে ‘ইউএপিএ’-তে ধরা হয়েছে ৫ হাজার ১২৮ জনকে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী দণ্ডাদেশের হার অবিশ্বাস্য কম। মাত্র ৩ শতাংশ! ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’ দেখাচ্ছে, ২০১৪ থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৩৯৯টি দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু হয়েছে। দণ্ড পেয়েছে মাত্র ৬ জন। ‘উচিত শিক্ষা’-র আবার অনেকগুলো স্তর। শিক্ষকও বিস্তর। ইডি, সিবিআই, পিএফআই, সিভিসি- শিক্ষালয়ের নাম ও চরিত্র ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য এক- ‘উচিত শিক্ষাদান’। বিশ বছর আগে গুজরাটে যে-শিক্ষা ছিল শুধু মুসলমানদের ঢিট করতে, ক্রমে ক্রমে তার ব্যাপ্তি বেড়েছে। উঁচু ক্লাসে বইয়ের বহর বাড়ার মতো জাত ও ধর্মের গণ্ডি টপকে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে সমাজের সর্বস্তরে। যেখানে যেটুকু প্রতিবাদ, চিরতরে কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টায় সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিক্ষালয়। রাজ্যে রাজ্যে। এলাকায় এলাকায়। মহল্লায় মহল্লায়।

উচিত শিক্ষাদানের এই প্রক্রিয়া নিয়ে শোরগোল যে হয়নি, তা নয়। পশ্চিমি দুনিয়া তেরছা চোখে তাকিয়েছে শিক্ষালয়ের আচার্য-উপাচার্যদের প্রতি। ভিসা না-দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবাদ- পশ্চিমি দুনিয়ার সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নিন্দাস্রোত, খামতি ছিল না কোথাও। একের পর এক বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তির্যক দৃষ্টি মেলে বুঝতে চেয়েছে ‘গণতন্ত্রী’ ভারতের কর্ণধারদের মতিগতি। তাতে ‘উচিত শিক্ষালয়’-এর কান্ডারিদের কিছু যায়-আসেনি। দিন যত গিয়েছে, ধর্মীয় মেরুকরণ যত বেশি সমর্থনের ঝুলি উজাড় করেছে, ততই লাগামহীন হয়ে উঠেছে শাসক। রাষ্ট্র পরিচালনায় এতকাল যা ছিল অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রম, ‘উচিত শিক্ষালয়’-এর বাড়বাড়ন্ত এবং পাঠ্যক্রম প্রণেতাদের গৌরবান্বিত করার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্তরে সেই মানসিকতার গ্রহণযোগ্যতা আজ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। সেটা হয়েছে বলেই সাংবিধানিক পদাধিকারীদের পক্ষে এমন ধরনের ‘শিক্ষা’-র খুল্লমখুল্লা গুণগান সম্ভবপর। ‘নতুন ভারত’-এ এই ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে ক্রমেই স্বাভাবিক ও সর্বজনীন হয়ে গিয়েছে। ‘উচিত শিক্ষা’-র সাফল্য ও গৌরবগাথা এটাই।

সাফল্য মানুষকে উৎসাহিত করে। সেই উৎসাহে আজকের ‘নতুন ভারত’ টগবগ করে ফুটছে। গুজরাটের গণ্ডি পেরিয়ে ‘উচিত শিক্ষালয়’-এর শাখা-প্রশাখা আজ ভূভারতে প্রসারিত। ‘উচিত শিক্ষাপ্রাপ্ত’ পড়ুয়ারা আজকের শিক্ষক। তাঁদের কেউ ‘গদ্দার’দের ‘গোলি মারো’ নিদান দেন, কেউ ‘গণহত্যা’-র, কেউ ‘হিজাব-আজান’-এর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত, কেউ আমিষ নিয়ন্ত্রণের গণ্ডি টানেন, কেউ বা বিক্ষোভ-জমায়েতে গাড়ি হাঁকান। ‘উচিত শিক্ষা’-র নতুন সিলেবাসে বিপুল উৎসাহ আজ ‘বুলডোজার নীতি’ ঘিরে, দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে পিটুনি করের প্রয়োগ ঘিরে, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তি ঘিরে। মাদ্রাসা বন্ধে বেজে উঠেছে কাড়া-নাকাড়া-দুন্দুভি। তোড়জোড় শুরু হয়েছে ওয়াকফ সম্পত্তির তদন্ত প্রক্রিয়ার। নতুনের দাপাদাপিতে পুরনো সিলেবাসের গোরক্ষকদের তাণ্ডব আজ কিছুটা রংচটা। ফিকে। নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টিতে উৎসাহ জুগিয়েছে শিক্ষকদের নতুন সংকল্প। গুজরাটের পুণ্যভূমি থেকেই শুরু হবে সিলেবাসের নতুন অধ্যায়ের যাত্রা।

নির্বাচনী ইস্তাহারের প্রতিশ্রুতি, উগ্রবাদী, মৌলবাদী, সন্ত্রাসবাদী নিকেশ করতে রাজ্যে তৈরি করা হবে ‘উগ্রবাদ বিরোধী সেল’। চুঁইয়ে পড়বে দেশপ্রেম। ‘উচিত শিক্ষা’ পল্লবিত হচ্ছে। সারা দেশ ‘শিক্ষিত’ হচ্ছে। ভারত হয়ে উঠছে গুজরাট। মাভৈ।

[আরও পড়ুন: সংরক্ষণের সমীকরণ, দেশকে ফের নয়া সন্ধিক্ষণে দাঁড় করাতে পারে ‘ইডব্লিউএস’]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ