Advertisement
Advertisement

Breaking News

অস্ত্রের বেসাতিতে ঢাকল সাংবাদিকের মরণযন্ত্রণা

মানবাধিকারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র চুক্তি!

Arms deal eclipses Jamal Khashoggi murder probe
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:October 23, 2018 10:42 am
  • Updated:October 23, 2018 10:42 am

সুতীর্থ চক্রবর্তী: সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগ্গির-র হত্যা বিশ্ব রাজনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতির জন্ম দিতে চলেছে। সাংবাদিকদের উপর নৃশংস আক্রমণের ঘটনা দুনিয়া জুড়ে বাড়ছে। তথ্য বলছে, শুধু বর্তমান বছরেই ৪০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন নানা জায়গায়। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের উপর আক্রমণ নতুন কোনও ঘটনা নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারী শাসকদের উত্থান ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ জরুরি। সেক্ষেত্রে সাংবাদিকরাই হন ‘প্রথম’ নিশানা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রশক্তি বা কর্পোরেট সংস্থার বিরোধিতা করে আক্রান্ত হয়েছেন সাংবাদিকরা। জামাল খাশোগ্গির ক্ষেত্রেও যেটা ব্যতিক্রম নয়।

তবুও জামাল খাশোগ্গির হত্যাকাণ্ডের মাত্রা ভিন্ন। তিনি ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর কলমচি ছিলেন। তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুলে সৌদি আরবের কনসুলেটের ভিতরে তাঁর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এরকম ঘটনা সচরাচর শোনা যায় না। বিদেশে নিজের দেশের কনসুলেটে গিয়ে কাউকে খুন হতে হচ্ছে, এটা কল্পনারও অতীত। কিন্তু ইস্তানবুলের মাটিতে ওই নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। খাশোগ্গিকে কনসুলেটের ভিতরে শেষবারের জন্য ঢুকতে দেখা গিয়েছিল। এক তুরস্কের বান্ধবীকে তিনি বিয়ে করতে চান, সেই কারণে বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত কাগজপত্র জোগাড় করতে খাশোগি কনসুলেটে গিয়েছিলেন। এরপর আর তাঁর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। তুরস্কের সরকারই প্রথম আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করে দেয় যে, কনসুলেটের ভিতরে সৌদি আধিকারিক ও কর্মীরা খাশোগিকে হত্যা করেছে।

Advertisement

[ঐতিহাসিক রুশ-মার্কিন পরমাণু অস্ত্র চুক্তি বাতিল, ঘোষণা ট্রাম্পের]

Advertisement

তুরস্ক খবরটি ফাঁদ করার পরে সৌদি আরবের সরকার ঘটনাটির কথা অস্বীকার করেছিল। হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন সপ্তাহ পর সৌদি সরকার স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, খাশোগ্গি কনসুলেটের ভিতরেই খুন হয়েছেন। সৌদির রাজতন্ত্র এবং বর্তমান যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমনের প্রবল সমালোচক ছিলেন খাশোগ্গি। এই সলমনের হাতেই এখন কার্যত সৌদির প্রশাসনের যাবতীয় ক্ষমতা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের গোড়া থেকেই অভিযোগ- যুবরাজ সলমনের নির্দেশেই খাশোগ্গিকে হত্যা করা হয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই সৌদি ও তুরস্কের বিরোধ সুবিদিত। ফলে এরদোগানও দুনিয়ার সামনে সৌদি যুবরাজের ভাবমূর্তিতে কালি লাগানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। খাশোগ্গি-হত্যার অভিযোগে সৌদি প্রশাসন ১৮ জন দূতাবাস কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। সৌদি সরকারের ব্যাখ্যা হল, দূতাবাসের কিছু দুর্বৃত্তের কাজ এটা। এর মধ্যে কোনও পরিকল্পনা ছিল না। যুবরাজ সলমনের কোনও নির্দেশও ছিল না। খাশোগ্গি দূতাবাসে গিয়ে বচসায় জড়িয়ে পড়েন। তার জেরেই দুর্বৃত্তরা তাঁকে হত্যা করে।

গল্পটা অবশ্য তাতেই শেষ হয়ে যায়নি। বা, শুধুমাত্র একজন সাংবাদিককে তাঁর কলম বন্ধ করার জন্য হত্যার ঘটনাতে বিষয়টি ফুরিয়ে যাচ্ছে না। খাশোগ্গি-হত্যা ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে ঝড় উঠেছে, তার রেশ বহুদূর যেতে পারে। এর একটা প্রেক্ষিত অবশ্যই ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। ভারতের মতো যেসব দেশ তাদের প্রয়োজনীয় জ্বালানির অর্ধেক ইরান থেকে আমদানি করে, তাদের উপর মার্কিন-ফতোয়া হল ৪ নভেম্বরের মধ্যে ইরান থেকে তেল কেনা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। ইরানের তেল রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হলে, মার্কিন মদতে সেই জায়গাটা পূরণ করার কথা সৌদি আরবের। সেইরকম একটা পরিস্থিতিতে খাশোগ্গি-হত্যা ঘিরে যদি সৌদি আরবের তেল বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা চাপে, তাহলে তা বিশ্বজুড়ে অভূতপূর্ব এক জ্বালানি সংকট তৈরি করবে। ভারতে পেট্রল ও ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ১০০ টাকা ছুঁতে চলেছে। বিশ্ববাজারে নতুন করে সংকট ঘনীভূত হলে এই দাম কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে, তা কেউ বলতে পারে না! ফলে আমরা নতুন করে এক আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছি।

সৌদি আরবের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর জন্য চাপ তৈরি হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপর। ইউরোপীয় দেশগুলিও এই চাপের শরিক। সৌদি প্রশাসন অবশ্য ইতিমধ্যে ওয়াশিংটনের উপর পালটা চাপ দিতে শুরু করেছে। ১১০ বিলিয়ন ডলারের (টাকায় আট লক্ষ কোটি) অস্ত্র কেনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ সৌদি আরব। যদি খাশোগ্গিকে ঘিরে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবত করার বিষয়ে ওয়াশিংটন উদ্যোগী হয়, তাহলে এই অস্ত্র সরবরাহ চুক্তিও বন্ধ হবে বলে পালটা হুমকি সৌদি আরবের। এতেই বিপাকে পড়েছেন ট্রাম্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই সৌদির এই অস্ত্রের বরাতটি হারাতে চায় না। ট্রাম্প বলছেন, বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের সমস্যাটি জড়িয়ে রয়েছে। যদি সৌদির অস্ত্রের বরাত হাতছাড়া হয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু মানুষ কাজ হারাবেন। ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সৌদি আরব আগামী ১০ বছর ধরে আমেরিকার কাছ থেকে কিনবে। এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের খুব সামান্যই এখনও পর্যন্ত আমেরিকা জোগান দিতে পেরেছে। মাঝপথে বরাত বন্ধ হলে বহু মার্কিন কোম্পানি সংকটে পড়বে। অন্যদিকে, সৌদি আরব ইয়েমেনের সঙ্গে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সেখানে নিয়মিত অস্ত্রের জোগান প্রয়োজন। সৌদি বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত। এই অবস্থায় মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হলে তা সৌদি সেনাবাহিনীর পক্ষেও সমস্যা তৈরি করবে। যদিও সৌদি প্রশাসনের তরফে বলা হচ্ছে মার্কিন অস্ত্র বন্ধ হলে রাশিয়া ও চিনের অস্ত্র বিকল্প হিসাবে তাদের সামনে রয়েছে। কিন্তু যারা এতদিন ধরে মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত তারা হঠাৎ করেই কি চিন, রাশিয়ার অস্ত্রে সেনাবাহিনীকে সাজাতে পারবে? এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন যদি খারাপ হয়ে যায়, তাহলে সেখানে কি রুশ ইঞ্জিন লাগানো সম্ভব?

[দূতাবাসেই মৃত্যু হয় খাশোগ্গির, অবশেষে স্বীকারোক্তি সৌদি আরবের]

ইয়েমেনের সঙ্গে যুদ্ধে সৌদির যে অর্থব্যয় হয়, তার জোগান আসে তেল বিক্রির টাকা থেকে। এই অবস্থায় সৌদির তেল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা চাপলে সেটাও সৌদি সরকারের উপর এক ধরনের চাপ তৈরি করবে। সেই বিষয়টিও সৌদির প্রশাসনকে মাথায় রাখতে হচ্ছে। তবে সবকিছুর বাইরে আমেরিকার অস্ত্রের বরাতটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মর্কেল ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, তঁারা সৌদি আরবকে অস্ত্র বিক্রি করবেন না। একই ধরনের অঙ্গীকার করতে চাইছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্য দেশ। কিন্তু আমেরিকার তাতে খুব একটা সায় নেই। খাশোগ্গির নৃশংস হত্যা নিয়ে গোড়ায় সেই কারণে ট্রাম্প চুপ করেছিলেন। উলটে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বস্ত করা হচ্ছিল, রিয়াধের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট থাকবে। মার্কিন প্রশাসন প্রাথমিকভাবে এটা মানতে প্রস্তুত ছিল না যে, খাশোগ্গিকে পরিকল্পিতভাবে সৌদি দূতাবাসের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে। এখন সৌদি সরকার নিজেরাই সেটা স্বীকার করে নেওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন বলছে এতে সৌদি রাজপরিবারে তথা যুবরাজ সুলেমানের হাত নাও থাকতে পারে। তদন্ত করে সেই বিষয়টিতে স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন।

‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর একজন প্রবীণ কলমচির নৃশংস হত্যার পরও ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে ঘটনাটি নিয়ে লুকোচুরি খেলার চেষ্টা করছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এখন টাকার জোরটাই শেষ কথা। আমেরিকার কাছে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তির বিষয়টি। এই ধরনের পরিস্থিতিতে দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্র নিশ্চিত করেই বিপন্ন। দেখা যাচ্ছে, টাকা দিয়ে স্বৈরাচারী শাসকরা সমস্ত সমালোচনার কণ্ঠ বন্ধ করে দিতে পারে। আর সবচেয়ে অসহায় রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সাংবাদিকরা।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ