Advertisement
Advertisement

Breaking News

Petrol price

সম্পাদকীয়: জ্বালানি তেল না শক্তিশেল?

আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠা-পড়ায় নাকি তেলের দৈনন্দিন দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। কিন্তু এটা কি আদৌ সত্যি?

Centre can't ignore Sky rocketing fuel prices | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:June 15, 2021 2:57 pm
  • Updated:June 15, 2021 2:57 pm

২০১০ সাল থেকে পেট্রল ও ২০১৪ সাল থেকে ডিজেলের দাম সরকারিভাবে পুরোপুরি বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তেল কোম্পানিগুলো প্রতিদিন রাতে দাম ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠা-পড়ায় নাকি এই দৈনন্দিন দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। কিন্তু এটা কি আদৌ সত্যি? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

ভারতের জ্বালানি তেলের ৮০ শতাংশ চাহিদা আমদানির মধ্য দিয়ে মেটানো হয়। ব্রেন্ট অশোধিত তেলের দাম ব‌্যারেল প্রতি যখনই উঁচুতে ওঠে, তখনই দেশে গেল-গেল রব তৈরি হয়। আমেরিকা ও চিনের পর ভারতই বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল ব‌্যবহারকারী দেশ। ভারত গড়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ কোটি ব‌্যারেল অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। ফলে বোঝাই যায়, এক ব‌্যারেল তেলের দাম এক ডলার বাড়লে বা কমলে, তার কী প্রভাব পড়ে ভারতের অর্থনীতিতে। এক ডলার দাম বাড়লে যেমন দেশের ১০ হাজার কোটি টাকার উপর ক্ষতি হয়, তেমন এক ডলার দাম কমলে দেশের হাতে ১০ হাজার কোটি টাকার উপর চলে আসে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: কংগ্রেস সিস্টেমের কী হল?]

কিন্তু আমরা দেশের সাধারণ মানুষ পেট্রল (Petrol)ও ডিজেলের (Diesel) খুচরো দাম থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ব‌্যারেল-প্রতি তেলের দাম সস্তা হওয়া কোনওভাবেই উপলব্ধি করতে পারি না। আমাদের কাছে রোজকার বাস্তব হল, পেট্রল ও ডিজেলের দামের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ। পেট্রল ও ডিজেলের দাম বেশ কিছুটা বাড়লে পণ্যের বাজারে তার প্রভাব পড়ে। যখন অল্পদিনের ব‌্যবধানে জ্বালানির দাম অনেকটা বেড়ে যায়, তখন বাজারে পণ্যের জোগান কমে। কারণ, পণ‌্য উৎপাদন ও তার পরিবহণ- দুটো খরচই বাড়তে থাকে। রাতারাতি পণ্যের চাহিদা কমানো যায় না। ফলে দেখা দেয় মুদ্রাস্ফীতি। এই এখন যেমন, পেট্রল ও ডিজেলের দাম দেশে সেঞ্চুরি হাঁকাচ্ছে, তখন জিনিসপত্রের দামও কিন্তু রেকর্ড বৃদ্ধির পথে। মে মাসে পাইকারি মূল‌্যবৃদ্ধির সূচক প্রায় ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একধাক্কায় পাইকারি মূল‌্যবৃদ্ধির সূচক ১৩ শতাংশে বৃদ্ধি পাওয়া মোটেই চাট্টিখানি কথা নয়। খুচরো পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি ছ’-শতাংশের বেশি। কোভিড পরিস্থিতিতে এই ঘটনা যে সাধারণ মানুষের উপর কতখানি চাপ, তা বলা বাহুল‌্য। কোভিডে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে। বহু চাকরিজীবীর বেতন কমেছে। যারা স্বনিযুক্ত বা ব্যবসা করে, তাদের সিংহভাগেরই আয় কমেছে। এই অবস্থায় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার অর্থ হল, প্রকৃত আয় আরও কমে যাওয়া।

Advertisement

গত বছর যখন বিশ্বজুড়ে অতিমারী নেমে আসে, তখন প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছিল। কারণ হঠাৎ করে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি থমকে যাওয়ায় জ্বালানি তেলের চাহিদা স্বাভাবিক নিয়মেই কমে যায়। ভারতে গত বছর মার্চের শেষে যখন প্রথম লকডাউন শুরু হয়, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমতে কমতে ২০ ডলার প্রতি ব‌্যারেলে নেমে গিয়েছিল। অথচ সেই সময়, আমরা কিন্তু
পেট্রল-ডিজেল সস্তা হতে দেখিনি। কারণ, এটা সাধারণ মানুষের দৃষ্টির গোচরে ছিল না যে, যখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম সর্বনিম্ন বিন্দুতে পৌঁছেছিল, তখন রাতের অন্ধকারে কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রল ও ডিজেলের উপর রেকর্ড কর বসিয়ে দিয়েছিল। ওই সময় একরাতে পেট্রলের উপর লিটার পিছু ১৩ টাকা এবং ডিজেলের উপর লিটার পিছু ১০ টাকা আন্তঃশুল্ক চেপে যায়। সাধারণ মানুষের কাছে পেট্রল ও ডিজেলের দাম যা ছিল, মোটের উপর তাই থেকে যায়। এটাই আমরা গত ছ’-সাত বছর ধরে দেখে আসছি। ২০১০ সাল থেকে পেট্রল ও ২০১৪ সাল থেকে ডিজেলের দাম সরকারিভাবে পুরোপুরি বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তেল কোম্পানিগুলো প্রতিদিন রাতে দাম ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠা-পড়ায় নাকি এই দৈনন্দিন দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে। কিন্তু এটা কি আদৌ সত্যি? তাহলে যেদিন ব্রেন্ট অশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ২০ ডলার হয়ে গেল, সেদিন কেন পেট্রল-ডিজেলের দাম দেশের বাজারে তলানিতে গেল না?

আসলে পেট্রল-ডিজেলের দাম নামেই বাজার নির্ধারিত। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও সরকার নিজের আয় ঠিক রাখতে আগেই কর চাপিয়ে দেয়। একইসঙ্গে তেল কোম্পানিগুলো নিজেদের মুনাফা ঠিক রেখে তবেই দাম ঘোষণা করে। ফলে সাধারণ ক্রেতারা দামে কোনও হেরফের দেখতে পায় না। কেন্দ্রীয় কর কখন কীভাবে বাড়ছে বা কমছে, কেউ টের পায় না। গত বছর মে মাসে যে-রাতে কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রলে লিটার পিছু ১৩ টাকা ও ডিজেলে লিটার পিছু ১০ টাকা আন্তঃশুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেদিন কিন্তু খুচরো দামে কোনও হেরফের হয়নি। সেই সময় অপরিশোধিত তেলের বাজারে দাম অনেক কম। সেই দাম একরাতে পড়েনি। আন্তর্জাতিক বাজারে তখন ধারাবাহিকভাবে অপরিশোধিত তেলের দাম কমলেও ক্রেতারা তার সুবিধা পাচ্ছিল না। সরকার কর বাড়ানোর আগে পর্যন্ত মুনাফা বাড়াচ্ছিল তেল কোম্পানিগুলো। কেন্দ্রীয় সরকার ও তেল কোম্পানিগুলোর জাঁতাকলে পড়ে এইভাবেই হাঁড়ির হাল হচ্ছে সাধারণ মানুষের।

২০১০ সালে মনমোহন সিংয়ের সরকার পেট্রলের দাম বাজারের উপর ছেড়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রলের দাম ছিল বেশ চড়া। ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলারের উপরে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম এর অনেক কম। অথচ দেখা যাচ্ছে, অভ‌্যন্তরীণ বাজারে পেট্রলের দাম সেই সময়ের চেয়ে এখন অন্তত লিটারে ২০-২৫ টাকা বেশি।
পেট্রল-ডিজেলের দাম যদি আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠা-নামা তথা ব্রেন্ট অশোধিত দাম দ্বারা নির্ধারিত হয়, তাহলে তখন কেন পেট্রলের দাম কম ছিল? এর উত্তর খুব সহজ। কেন্দ্রীয় আন্তঃশুল্ক অনেক কম থাকাতেই তখন দাম কম ছিল। তেল কোম্পানিগুলোর মুনাফাও হয়তো তখন কম ছিল। মনমোহন সিংয়ের সরকার সেই সময় তেল কোম্পানিগুলোকে নিয়মিত ভরতুকিও দিত। যে ভরতুকি ব‌্যবস্থা এখন উঠে গিয়েছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার এসেছে। সেই সময় পেট্রলে লিটারে ৯ টাকা ৪৮ পয়সা এবং ডিজেলে লিটারে ৩ টাকা ৫৬ পয়সা কেন্দ্র আন্তঃশুল্ক নিত। সাত বছর পর এখন কেন্দ্রের শুল্ক পেট্রলে লিটার পিছু ৩২ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ডিজেলে লিটার পিছু ৩১ টাকা ৮৩ পয়সা। আন্তর্জাতিক বাজারের মূল‌্য ধরলে এখন পেট্রলের দাম হওয়া উচিত লিটারে ৩১ টাকা ৪৮ পয়সা। সেই পেট্রল অভ‌্যন্তরীণ বাজারে কোথাও লিটারে ১০০ টাকা পেরিয়েছে, কোথাও ১০০ ছুঁইছুঁই। মূল দামের থেকে প্রায় ২৬০ শতাংশ বেশি। এর কারণ পুরোটাই সরকারের কর ও তেল কোম্পানিগুলোর মুনাফা। সিংহভাগই কেন্দ্রের শুল্ক, কিছুটা রাজ্যের কর। সম্প্রতি লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, পেট্রল ও ডিজেলকে জিএসটির আওতায় আনার ক্ষেত্রে রাজ‌্যগুলোর আপত্তির জায়গা হল, মিলিতভাবে তারা পেট্রল ও ডিজেল থেকে বছরে ২ লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে। কেন্দ্র একা নিঃসন্দেহে তার বেশি টাকা তোলে।

কেন্দ্রীয় পেট্রলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান বলেছেন, ভ‌্যাকসিনের ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার খরচের এক লক্ষ কোটি টাকা পেট্রল ও ডিজেলের উপর চাপানো কর থেকেই নাকি আসছে। ভ‌্যাকসিনের খরচ তো গত বছর ছিল না। কিন্তু পেট্রল ও ডিজেলের দাম তো গত বছরও আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কম হওয়া সত্ত্বেও একইরকম ছিল। তাহলে কেন্দ্রের সেই বর্ধিত আয় গেল কোথায়? মনমোহনের জমানায় ভরতুকি ছিল। এখন সেসবও নেই। জ্বালানির জন‌্য যখন রোজ বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে, তখন গত বছরের সেই বর্ধিত আয়ের টাকা কেন্দ্র কেন ভরতুকি হিসাবে দেবে না? কেন্দ্রীয় পেট্রলিয়াম মন্ত্রী যেভাবে ভ‌্যাকসিন ও রেশনের খরচ দেখিয়ে পেট্রপণ্যের মূল‌্যবৃদ্ধির সাফাই দিয়েছেন, তা সাধারণ মানুষের দ্রব‌্যমূল‌্য বৃদ্ধিজনিত সমস‌্যার প্রতি নির্মম উদাসীনতা ছাড়া কিছু নয়। পৃথিবীর কোনও দেশেই জ্বালানির উপর শুল্ক এত চড়া নয়। এমনকী, আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তানেও জ্বালানি তুলনামূলকভাবে সস্তা। দেশের সরকারের এই উদাসীনতা এবার বন্ধ হোক।

[আরও পড়ুন: মোদি-যোগী দ্বৈরথের ভবিষ্যৎ কী?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ