চিন্ময় গুহ: যেন জীবনের গায়ে একটি তির বিঁধে আছে, যা অনিঃশেষ ভালবাসায় নীল। মৃণাল সেনের মৃত্যু এক চূড়ান্ত শূন্যতার দিকে আমাদের পতন ত্বরান্বিত করল। আর মাত্র কয়েকটি দীপ বাকি। তারপর শেষ হয়ে যাবে আমাদের আধুনিকতার এক অসামান্য ইতিহাস, যা জীবনবাদিতার ভিতের উপর দাঁড়িয়ে ছিল। চুড়িদার ও সাদা পাঞ্জাবি পরা ওই দীর্ঘকায় মানুষটি ছিলেন আপসহীন মানবিক ঋজুতার অন্যতম শেষ প্রতীক।
একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন, মৃণাল সেন না থাকলে ভারতীয় চলচ্চিত্র কতটা অসম্পূর্ণ থেকে যেত! আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে, ইতিহাসের এক ব্রাহ্মমুহূর্তে সত্যজিৎ ও ঋত্বিকের সঙ্গে তিনি ধনুক ধরেছিলেন! ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর নির্মেদ তীক্ষ্ণতা তাঁকে করে তুলেছিল মানবমুখী চলচ্চিত্রের এক অগ্রনায়ক, যিনি সকলের চেয়ে আলাদা। ব্যাকরণ ভাঙার উদাহরণ তিনি তৈরি করেছেন, ভাঙার জন্য ভাঙা নয়, পুরনো বয়ান ছিঁড়ে নতুন আধুনিকতাকে খুঁড়ে বের করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। ‘ভুবন সোম’, যা ভারতীয় ছবিতে ‘নবতরঙ্গ’-র সূত্রপাত করে, এই নতুন আধুনিকতার মাইলফলক।
আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে তিনি দু’হাতে পরদা ছিঁড়ে ফেলেছেন বারবার। ‘ওকা উরি কথা’-র শেষ দৃশ্যে ফিল্ম পুড়ে যাওয়া এ যুগের অনেক ভঙ্গিসর্বস্ব, জীবনপাঠহীন, অন্তঃসারশূন্য চলচ্চিত্র চালিয়াতের মুখোশ খুলে দিতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, তা গুরুতর নান্দনিক ও সামাজিক প্রশ্ন তোলে। ‘আকাশ কুসুম’ থেকে ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘কোরাস’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘খারিজ’, ‘জেনেসিস’, ‘মহাপৃথিবী’ – ছবিগুলি যেন একটি নির্মীয়মাণ ভাষ্য মাত্র, ভাঙা রাস্তায় একটি প্ল্যাকার্ড, ‘work in progress’। যা আমাদের ভাবায়, মস্তিষ্ককোষকে উত্তেজিত করে।
অশ্রুপাত তাঁর প্রবলভাবে অপছন্দ ছিল, আমাকে একাধিকবার বলেছেন, ‘দাদা, আমি বাঁচতে চাই’ তিনি পরিহার করতেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’ তার প্রমাণ। নতুন ঢেউ ছবিগুলির কথা আর নাই-বা বললাম, সেগুলিতে যে alienation effect আছে, তা বাঙালিসুলভ আবেগকে অতিক্রম করতে চেয়েছে। তিনি জানতেন ‘দাদা, আমি বাঁচতে চাই’ বাঙালির বেশি ভাল লাগবে, তবু তিনি তাকে তর্কের বয়ানে উপস্থাপন করেছেন। বিতর্কই ছিল তাঁর ছবির প্রাণ, অক্ষররেখা। তাঁর ভাষায়, কখনও তিনি frivolous, কখনও তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। গ্রহণ-নন্দনের এ এক তীক্ষ্ণ, জীবন্ত, মানবিক অভিব্যক্তি।
তাই আমি সেগুলি বারবার দেখি, বিশেষত ‘পদাতিক’ ছবির শেষাংশ। প্রশ্ন একটা তিরের মতো আমাকে ছিন্ন করে। অন্ধকারের ভিতর তঁার ছবির নিঃশব্দ চিৎকার আমাকে ঘিরে ফেলে, তারপর এক হিমশীতল বাঙ্ময় নৈঃশব্দ্য! ইতিহাস তাঁর হয়ে কথা বলছে।
২০০৮ সালে একবার দক্ষিণ ফ্রান্সে ফরাসি চিন্তকদের এক বৃহৎ আড্ডায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিন্তা-উদ্দীপক পরিচালকদের তালিকায় সবচেয়ে উঁচুতে রাখা হল মৃণাল সেনকে। আড্ডার কেউ জানতেন না, আমি বাঙালি ও মৃণাল সেনের দর্শক। আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এই মুক্তমনা জীবনশিল্পীর প্রশ্নচিহ্নগুলি চলচ্চিত্রের পরদা অতিক্রম করে তাঁকে করে তুলেছে মানবতার এক দিশারি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.