সাম্প্রতিক ‘অসুখ’ ইনস্টাগ্রাম ‘রিল’। মিনি পর্নসাইট যেন! কেউ শরীরের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছে, কেউ ক্যামেরার সামনে পোশাক বদলাচ্ছে, কারও শরীরের ঊর্ধ্বাংশ খোলা, কারও নিম্নাংশ। কেউ-বা ভিউয়ারের উদ্দেশে উত্তেজক কথাবার্তা বলছে। কেউ ফোন সেক্সের আহ্বান জানাচ্ছে নাম্বারের মাধ্যমে। হলটা কী এ প্রজন্মের! লিখছেন রিংকা চক্রবর্তী।
তিন জ্ঞানী বানরকে মনে পড়ে?
এই তিনটি বানর আসলে একটি প্রবচনের সচিত্র রূপ। প্রবচনটি হল, ‘See no evil, hear no evil, speak no evil.’ মর্মার্থ দঁাড়ায়– ‘খারাপ কিছু দেখো না, খারাপ কিছু শুনো না, খারাপ কিছু বলো না।’
যা শালীনতার পরিপন্থী, তা দেখো না, শুনো না, বলো না। আমরা যখন কোনও পচা বা নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার খাই, অসুস্থ হয়ে পড়ি। অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে এই পচা খাবার যত দ্রুত সম্ভব আমাদের শরীর যে কোনও উপায়ে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই দর্শন অনুসারে, খারাপ কোনও কিছু ঠিক পচা খাবারের মতো কাজ করে। যখন আমরা কোনও খারাপ জিনিস দেখি, তখন তার কুপ্রভাব আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে। কোনও না কোনওভাবে সেই নেতিবাচক প্রভাবের একটি নেতিবাচক বহিঃপ্রকাশ আমরা ঘটিয়ে ফেলি। টিভিতে কিংবা সিনেমায় এবং অবশ্যই এখনকার ক্রাইম সিরিজগুলোয় যেসব অপরাধ, খুন, খুনের নিত্যনতুন কৌশল দেখানো হচ্ছে, তা বাস্তবেই মানুষকে এসব অপরাধ করতে অনুপ্রাণিত করছে। অল্পবয়সিদের মধে্য এই প্রবণতা বেশি। মারামারি, যুদ্ধ, নিষ্ঠুর ভিডিও গেম খেলে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
‘ব্লু হোয়েল’-এর কথা মনে আছে? যার ফঁাদে পা দিয়ে অকালে ঝরে গিয়েছে কত প্রাণ। সাম্প্রতিক ‘অসুখ’ ইনস্টাগ্রাম ‘রিল’। অশ্লীলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। মিনি পর্নসাইটে পরিণত হয়েছে বলা যায়। হয় সেই অশ্লীল রিল ফিডে চলে আসবে, না হলে সার্চ অপশনে ক্লিক করলেই দেখা যাবে– কেউ শরীরের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছে, না হয় কেউ পোশাক পরিবর্তন করছে ক্যামেরার সামনেই, কারও হয়তো শরীরের ঊর্ধ্বাংশ এবং নিম্নাংশ অনেকটাই অনাবৃত, কেউ-বা ভিউয়ারের উদ্দেশে উত্তেজক কথাবার্তা বলছে। ফোন সেক্সের আহ্বান জানাচ্ছে বিশেষ একটি নাম্বারের মাধ্যমে। এই প্রজন্মর হলটা কী! কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে তারা? সহজে সাফল্য আর চটজলদি বিপুল টাকার সম্মোহনে কোন অন্ধকার গলিতে হারিয়ে যাচ্ছে এই প্রজন্ম? যত বেশি নগ্নতা, তত বেশি সাফল্য! শরীর আমার, কী পোশাক পরব, কতটা উন্মুক্ত করব নিজেকে, সেটা যেমন সমাজ ঠিক করে দেবে না, সেটা আমার ‘চয়েজ’, তেমনই ‘রিল’ বানানোর নামে বিকৃত রুচির পরিচয় দেব, সেটাও কি কাম্য?
ছোট থেকে আমরা শুনে আসছি, শর্টকাটে সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সাফল্য অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। অথচ এরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে কম সময়ে টাকা আর সাফলে্যর লোভে ‘রিল’ বানানোকেই ‘পেশা’ হিসাবে বেছে নিয়েছে। এমনও দেখা গিয়েছে এই করে বেশ গাড়ি-বাড়িও করে নিয়েছে কেউ কেউ। অন্যদিকে যে মেয়েটি নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে পড়াশোনা করছে বা চাকরির পরীক্ষার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছে, তার তো মনে হতে পারে– কী লাভ এত পড়াশোনা করে, টাকা যদি এতই সহজে কামানো যায়!
এই ক্যাটেগরিতে যে শুধুমাত্র অল্পবয়সিরা পড়ছে তা নয়, অাপনি সকালে ইনস্টাগ্রাম ফিড স্ক্রোল করতে গিয়ে হয়তো দেখলেন ‘সাজেশন’ হিসাবে যে-রিল এল, তাতে অর্ধনগ্ন হয়ে পাশের বাড়ির কাকিমাই নাচছে! কিংবা এমন সব কামোদ্দীপক কথা বলছে, যেটা দেখে বা শুনে আপনিই লজ্জিত হবেন। সেই কাকিমা কিন্তু বিন্দাস। স্বামী কাজে, ছেলেমেয়ে
স্কুল-কলেজে চলে গেলে হাতখরচের মোক্ষম উপায় হিসাবে এই পথ সে বেছে নিয়েছে। কারও হয়তো যৌনজীবন তেমন সুখের নয়। তাই সে ‘রিল্স’-এর মাধ্যমে বিকৃত কাম চরিতার্থ করছে। অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য কখনও স্নান করার মিনি ভ্লগ, ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ভিডিও, ডাব্ল মিনিং কথাবার্তা– কিচ্ছু বাকি নেই আর। স্তন্যদান নিয়ে বক্তব্য থাকতে পারে না কখনওই। কিন্তু শিশু এবং স্তন ইচ্ছা করে ‘এক্সপোজ’ করে ক্যামেরার দিকে কামোদ্দীপক অঙ্গভঙ্গি– এটা কি খুব সুস্থ রুচির পরিচয়? এমনকী, চরম ঘনিষ্ঠ মুহূর্তও রিলবন্দি হচ্ছে। কিছু
ক্ষেত্রে উৎসাহিত করছে সেই মহিলার স্বামী। কেন এমন হচ্ছে বলুন তো?
যা ছিল ফোটো শেয়ারিংয়ের নিরীহ মাধ্যম, এখন সেই ইনস্টাগ্রাম জুড়ে ‘নগ্ন সভ্যতা’। আমরা যারা দেখে ফেলছি ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে– কী প্রভাব পড়ে আমাদের উপর? মিশরের একজন সুলতান বলেছিলেন, যদি কোনও দেশ বা জাতিকে ধ্বংস করতে চাও, তাহলে সেই দেশের যুব সম্প্রদায়ের মধে্য নগ্নতা ছড়িয়ে দাও। দু’দিন পরে সেই জাতি বা দেশ এমনিই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এখন সেটাই হচ্ছে। রিল্সের নেশা একটা প্রজন্মকে শেষ করে দিচ্ছে। অশ্লীলতাকে ‘নর্মালাইজ’ করার চেষ্টা চলছে। আগে ছিল ‘টিকটক’। ব্যান্ড হওয়ার পর ‘টিকটক’-এর জায়গা নিয়েছে ইনস্টাগ্রাম। একটা সময় যে ধরনের ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যাওয়ার ভয় থাকত, এখন সেসব ভিডিওই স্বেচ্ছায়, নির্ভয়ে বানাচ্ছে মহিলারাই। একজনকে দেখে শিখছে অন্যজন।
আবার, এমন একটা ‘বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’ তৈরি করে দিচ্ছে এসব রিলের দুনিয়া, বাস্তবের সঙ্গে যা কখনওই মেলে না। সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে ‘সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফাই’ করা হচ্ছে জেনে-বুঝে। ইনস্টাগ্রাম এমন একটা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই ‘ইউজার’। নেই কোনও বয়সের বাধা, না আছে কনটেন্টের উপর কোনও কড়া নিষেধাজ্ঞা। অপ্রাপ্তবয়স্কর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে অশ্লীল রিলের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এমনিতেই রিল স্ক্রলের নেশা যে কোনও কাজে মনোনিবেশে ব্যাঘাত ঘটায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রিল বানানোর দুঃসাহস কেড়ে নিয়েছে কত প্রাণ। এরপরেও মানুষের শিক্ষা নেই। যে-বয়সে পড়াশোনা বা কেরিয়ারে মন দেওয়ার কথা, সে-বয়সে মন চালিত হচ্ছে অন্যপথে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে।
এর থেকে বঁাচার উপায় একটাই– যখনই ফিডে এই ধরনের অশ্লীল ভিডিও আসবে, তাকে ‘নট ইন্টারেস্টেড’ করে দেওয়া। অ্যালগরিদ্ম অনুযায়ী এসব ভিডিও আসতে থাকে। একটা ভিডিও দেখে ফেলা মানেই সেই ধরনের ভিডিও ফিডে আসতেই থাকবে। তাই প্রথম ধাপেই সেই সুযোগ নস্যাৎ করে দিন। বারবার যদি এইভাবে বাতিল করা যায়, তবেই কার্যসিদ্ধি। আপনার যদি ঘর সাজানোর রিল দেখতে ভাল লাগে বা মজার কিছু, তাহলে অ্যালগরিদ্ম অনুযায়ী সেই পছন্দের ভিডিওই আপনি দেখতে পাবেন। আর এসবে বেশি সময় নষ্ট করে লাভও নেই। রিল আর রিয়েলের তফাত বুঝুন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.