Advertisement
Advertisement
Lok Sabha Poll 2024

ভোটে গ্রাউন্ড জিরোর সন্ধানে! জনগণেশের আলোচনায় বেজায় ধোঁয়াশা

জিতবে কে– মোদি না মমতা? বাংলায় বিজেপি ১৮-র উপর না নিচে?

Editorial on Lok Sabha Poll 2024
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:April 27, 2024 5:21 pm
  • Updated:April 28, 2024 12:04 am

জিতবে কে– মোদি না মমতা? বাংলায় বিজেপি ১৮-র উপর না নিচে? জনগণেশের আলোচনায় ধোঁয়াশা প্রকট। শ্রীরামেই আস্থাপ্রস্তাব? দারিদ্র, বেকারত্ব ও ক্ষুধা নিবারণের খোদার কাছে সমর্পণ? গরমের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাসপেন্সের ভোল্টেজও হাই। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেন গেটের সামনেই অতি প্রাচীন সনৎদার চায়ের দোকান। ভোর ছ’টায় স‌্যান্ডো গেঞ্জি আর একটা ন‌্যাতন‌্যাতে হাফ প‌্যান্ট পরে সনৎদা দোকান খোলেন। চায়ের জল বসান। কলেজের অধ‌্যাপক থেকে টোটো চালক, ছাত্রছাত্রী থেকে অবসরপ্রাপ্ত স্থানীয় বাসিন্দা– পাঁচমিশেলি জনগণেশ। বোটানিক‌াল গার্ডেন থেকে হেঁটে ফেরা মানুষ, আবার দলীয় মাতব্বর মোড়ল। এখন প্রতিদিন আলোচ‌্য বিষয়: ভোট আর ভয়াবহ গরম সহ‌্য করার অবর্ণনীয় কাহিনি।

Advertisement

–এই গরম তো আর সহ‌্য করা যাচ্ছে না বোসদা! বলছে আরও সাতদিন নাকি এরকম লু বইবে! এটাও সবাই বলছে, সবই আসলে ভোটের গরম। রাজনীতির গরম। ভোট শেষ হলে দেখবে গরমও চলে যাবে।
সনৎদা সর্বদাই নির্বাক চলচ্চিত্র। তবে মোবাইল ইউটিউব খুলে পুরনো হিন্দি গান চালান। কিশোর কুমার সনৎদার ফেভারিট। চলছে, ‘ইয়ে জীবন হ‌্যায়/ ইস জীবন কা, ইয়েহি হ‌্যায় রং-রূপ।’

Advertisement

সেনবাবু বললেন, ‘গরমে কি বিজেপি, কি তৃণমূল, সবারই তো কষ্ট। সবাই মিলে ঠিক করে জানুয়ারি মাসে ভোট করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত?’
–না না, বাচ্চাদের ওই সময় পরীক্ষা থাকে তো। মাধ‌্যমিক-উচ্চমাধ‌্যমিক।
–ধুস! আসলে তো জানুয়ারি মাসে ২২ তারিখে বালক রামের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার ছিল।

বেঞ্চিতে বসে সদ‌্য আসা খবরের কাগজে নিমগ্ন ছিলেন বাঁড়ুজ্যে। মুখ তুলে বললেন, “অত কাণ্ড করে কী হল? সংসদের ভিতরেই প্রধানমন্ত্রী স্লোগান তুলে দিলেন– আব কি বার চারশো পার। বিজেপির সাংসদেরা কোরাসে গাইলেন ‘জয় শ্রীরাম’। অতঃকিম্‌? এখন তো বিশ্বগুরু হিন্দু নারীর মঙ্গলসূত্র হারানোর শঙ্কা বিক্রিতে ব‌্যস্ত।”
–চ‌্যানেলগুলোও দেখছি একটু অন‌্য সুর গাইছে। রাহুল গান্ধীকেও একটু দেখাচ্ছে যেন। এত ভূতের মুখে মানে গদি মিডিয়ার রাবণ-নাম!
ঘোরতর সংঘবাদী স্কুলমাস্টার রথীনদা রে-রে করে প্রতিবাদ জানালেন, ‘বুঝতে হবে বুঝতে হবে। নরেন্দ্র মোদিকে বোঝা এত সহজ নয়। হি ইজ হাইলি আনপ্রেডিকটেবল্‌।’
–মানে? আপনি বলছেন পিকচার অভি বাকি হ‌্যায়? কিন্তু ২২ তারিখ রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল, ভগবান রামচন্দ্র মোদিজিকে কানে কানে বললেন, ভারতে স্বর্ণযুগ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রামনবমীর পর দেশে তাপপ্রবাহ তীব্র হলেও, রাম-লহর কই? আরে বাবা, ‘শোলে’ একবারই হয় বারবার কি শোলে হয়। রিপিট-শোতে বার্নিং ট্রেন– চায়না গেট হয়। শোলে হয় না।

 

[আরও পড়ুন: তিরন্দাজি বিশ্বকাপে সোনা জয়ের হ্যাটট্রিক, ফের বিশ্বমঞ্চে ভারতের জয়জয়কার]

–না, মোদিজি সব জানেন। আপনি বুঝছেন, আমি বুঝছি আর উনি বুঝতে পারছেন না? মোদিজির কাছে ২০২৪ ভোট হল একটা প‌্যাকেজ। মিক্সড প্ল‌্যাটার। বুফেতে সব আছে। পোলাও-কালিয়া আছে, আবার শসা-টমেটো-স‌্যালাড থেকে রসমালাই সব আছে। প্রধানমন্ত্রী শুধু বিজেপি দল অথবা গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে স্ট্র‌্যাটেজি তৈরি করেন না। তিনি জানেন, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদিই বিজেপি। বিজেপি ও মোদি সমার্থক। এই চরম ব্র‌‌্যান্ড ইকু‌্যইটি সাফল‌্য আনলে সিকন্দর, আবার খারাপ হলেও তার দায়ও তো মোদির উপরই বর্তাবে। দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও অ‌্যান্টি-ইনকামবেন্সি হবে না, তা কী করে হয়? তবু এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মোদি রামলালা প্রতিষ্ঠার পর ওই আবেগমথিত ঐতিহাসিক সময়ে বলেছেন, আব কি বার চারশো পার। সেটা হল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। ক‌্যাডাররা চাঙ্গা। হিন্দু জনমানস চাঙ্গা। হিন্দি বলয়ে অ‌্যাড্রিনালিন ক্ষরণ।

–কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের দেশ এই ভারত। ভোটার ৯০ কোটি। সুদীর্ঘ সাতদফার ভোট। বিরাট দেশ। ২৮টা রাজ‌্য, ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন স্থানীয় সমস‌্যা। বিশ্বগুরু ভারতের শক্তিশালী জনপ্রিয় নেতৃত্ব মোদি। এদিকে রাজে‌্য রাজে‌্য জাতপাতভিত্তিক ভোট ব‌্যাঙ্ক, সংখ‌্যালঘুদের অসন্তোষ, রাজে‌্য আর্থিক বঞ্চনা স্থানীয় জনপ্রিয় নেতাদের প্রভাব এখনও থেকে গিয়েছে। কর্মহীনতা, বেকারত্ব, মূল‌্যবৃদ্ধি, বিনিয়োগের ঘাটতি। সবই আছে। সবই তো বাস্তব! সেজন‌্যই কি প্রচারের কৌশল বদল? মুসলমানদের নাম না করে বলা ‘যাদের বেশি বাচ্চাকাচ্চা হয়’? সংরক্ষণ ইসু‌্য জাতপাত ইসু‌্যতে আবার ফিরে আসা?

অধ‌্যাপক সরকার গ্রাউন্ড জিরোর এই তপ্ত আলোচনায় অংশ নিয়েছেন ইতিমধে‌্য। চায়ের ভঁাড়ে চুমুক দিতে-দিতে প্রজাপতি বিস্কুট খাচ্ছিলেন। এবার বললেন, “একে বলা যায় রিস্ট্র‌্যাটেজাইজেশন। যস্মিন দেশে যদাচার। নদী পার করতে হবে কাছা খুলে। শুধু রামলালা ডোজও কাজ করছে না। মূল আক্রমণের লক্ষ‌্য রাহুল গান্ধী এবং কংগ্রেস প্রথম থেকেই। কারণ, কংগ্রেস ১০০-র নিচে থাকলে বিকল্প সরকার গঠনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়। এজন‌্য বহু রাজে‌্য সিটিং-এমপিকেও টিকিট দেওয়া হয়নি। স্থানীয় এমপি-র অ‌্যান্টি-ইনকামবেন্সির হাত থেকে বঁাচতে নতুন প্রার্থী এবার অন‌্য দল থেকে আসা। এজন‌্য ভোটকাটুয়াদের উপর এত নির্ভরশীলতা। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা আক্রমণ ছিল, পাকিস্তান বিরোধিতা ছিল। এখন তো পাকিস্তান-ই মরতে বসেছে! উল্টে চিনের সঙ্গে সন্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন মোদি ‘নিউজ উইক’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে। আর্থিক উন্নয়নের কারণে।”

কলেজের ছাত্র বিপ্লব। তার বক্তব‌্য, ‘অতি দর্পে হতা লঙ্কা। ভারতের রাজনীতিতে এটাই বারবার হয়েছে। আচ্ছা মেসোমশাই, আপনিই বলুন, কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করার দরকার ছিল। এতে তো হিতে বিপরীত হয়ে গেল। কেজরিওয়াল ভিক্টিম স্ট‌্যাটাস পেয়ে গেল।’

থাকতে না-পেরে এবার আমি বললাম, “পশ্চিমবঙ্গে তো ‘সিএএ’ করতে গিয়ে একইরকম উল্টো বিপত্তি হল বিজেপির। রাজে‌্যর প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ মুসলমান সমাজ পাকিস্তান ফেরত চলে যাওয়ার আশঙ্কায় নিরাপত্তার অভাববোধে আরও বেশি করে মমতা বন্দে‌্যাপাধ‌্যায়ের ছাতার তলায়। আর, হিন্দু বাঙালিদের সবাই তো আর উগ্র-সাভারকারপন্থী হিন্দুত্ববাদী নয়। বেলুড় মঠে এমন মুসলমান সন্ন‌্যাসী আছেন যিনি এখনও মঠে থাকেন, নিয়মিত নমাজও পড়েন।

চৈতন‌্য-রামকৃষ্ণর হিন্দুধর্মে হিন্দুরা নাস্তিক হয়েও হিন্দু। লখনউ দাওয়াই দিয়ে কলকাতায় কার্যসিদ্ধি হয়? তাছাড়া মোদি বুঝতে পারছেন, হিন্দুত্বই হোক আর মোদিত্ব– বার্তাটি গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিতে আপনার চাই স্থানীয় নেতৃত্ব ও সংগঠন। বলা যায় স্থানীয় যানযন্ত্র। ভেহিকেল। কমিউনিকেটর ভেক্টর।”
রোদ চড়ছে। ‘গ্রাউন্ড জিরো’ সনৎদার দায়ের দোকান থেকে এবার ভিড় পাতলা হচ্ছে। বাড়ি ফিরতেই দিল্লি থেকে এক বন্ধুবর আমলার ফোন। বললাম, ‘সকালে চায়ে পে চর্চায় আরও কনফিউজড। জিতবে কে– মোদি না প্রতিপক্ষ? মোদি জিতলেও বাংলায় কী হবে– মোদি না মমতা? বিজেপি ১৮-র উপর না নিচে?’

 

[আরও পড়ুন: ‘কল্যাণদার জন্যই আমাদের বিয়েটা হয়েছে’, কাঞ্চনকে ‘অপমান’ নিয়ে মুখ খুললেন শ্রীময়ী]

তা, ওই বিচক্ষণ আমলাটি বললেন, ‘১৪০ কোটি মানুষের মধে‌্য তুমি কোথায় দঁাড়িয়ে? অতি ধনী শতকরা ১০ ভাগে তুমি নেই। তারপর ৩০ ভাগের মধ‌্যসত্বভোগী গোষ্ঠীতে হয়তো আছো। কিন্তু ৬০ ভাগ গরিব মানুষ জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে কী ভাবছে কাকে ভোট দেবে কে জানে! এখনও গোটা জনসংখ‌্যার ঠিক কতজন মোবাইল ফোন ব‌্যবহার করে? ফেসবুক, এক্স হ‌্যান্ডেল বা ইনস্টাগ্রাম করে?’
আমি মাথা চুলকাচ্ছি।
–আচ্ছা, তোমার দেখা বা আলাপ হওয়া সবচেয়ে গরিব মানুষটি কে, যাকে তুমি চেনো?
ভাবতে লাগলাম। আমাদের পরিচারিকা? পাশের বস্তির লরিচালক? এরা সবাই মাসে প্রায় দশ হাজার টাকা রোজগার করে। সাংবাদিকরা যাকে ‘গ্রাউন্ড জিরো’ বলছে সেখানে সতি‌্যকারের খেতে না-পাওয়া গরিব মানুষ ক’জন?

গ্রামে গ্রামে এই মানুষেরা অর্থনীতির যন্ত্রণা, অসাম‌্যর কষ্ট ভুলে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে গর্বিত হিন্দু হিসাবে ভোট দেবে, না কি দেবে না? সতি‌্য বলছি, আমি জানি না।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ