নবকুমার বসু: ‘পৃথিবীটা আগের থেকে অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে’- ইদানীং এটা বেশ প্রচলিত কথা। আসলে যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম সহজে এবং সুলভে হাতের মুঠোয় চলে আসার জন্যই এমন অনুভূতিসঞ্জাত তুষ্টির কথা বলে মানুষ।
মোবাইল, টেলিফোনের দৌলতে প্রায় আক্ষরিক অর্থেই তো পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে যোগাযোগ, কথা বলা, এমনকী, চাক্ষুষ দেখাদেখিরও কোনও বাধা নেই। ব্যাপারটা শারীরিক হতে গেলে নেহাত উড়ানের উপর নির্ভর করতে হয় বলেই সময়কে একটু গুরুত্ব দিতে হয়। আর কী ভাগ্যিস, সেই ব্যবধানটুকু এখনও অস্তিত্বহীন হয়ে যায়নি! তা নয়তো মোবাইল ফোনের অনুষঙ্গে যে ‘ভাইরাস’-এর নাম শোনা যায়, করোনার জাতগোত্রও যদি তেমন হত? ফোনাফুনির মাধ্যমেই যদি ছড়িয়ে যেত ধরণীর পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে? তাহলে আর কিছু না, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগেই বোধহয় উজাড় হয়ে যেত মানব সম্প্রদায়ের অনেকখানি। ঠাকুর বাঁচিয়েছেন! করোনা-ভাইরাস ছড়ানোর জন্য পৃথিবীকে অন্তত ততটা ছোট করে দেননি এখনও। আমাদের চেনা হোক, কিংবা অ-চিন, ইউহান হোক বা হনলুলু, বন্য বাদুড় তথা পশুপাখির মাংসের বাজার কিংবা গোপন গবেষণাগার, যেখান থেকেই উদ্ভূত হোক, করোনাকে উড়ান ধরতে হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে ঢুকে (কিংবা চতুর পরিকল্পনামাফিক ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েপন’ হিসাবে ঢুকিয়ে দিয়ে), তাকে পারাপার করতে হয়েছে, ছড়াতে হয়েছে এ-মহাদেশ থেকে ও-মহাদেশে। ধরাশায়ী হওয়ার আগে আমরা কিছুটা সময় পেয়েছিলাম বইকি! সেই সময়ও অবশ্য অামাদের কতটা মারল কিংবা কতটা বাঁচাল, এখন তা নিয়েই কথা।
মনে আছে এক বছর আগে যখন ‘করোনা’ নামটা জনপরিসরে সদ্য পরিচিত হওয়ার জন্য নানা মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে (এবং আসল অদৃশ্য ভাইরাস অবশ্যই দেশ থেকে দেশান্তরে), আমরা তখন ঠাট্টা করেছি এই বলে যে, করোনা নিয়ে আমাদের কোনও চাপ নেই, কারণ আমরা ছোট থেকেই ‘এটা করো-না, ওটা করো-না’ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত অথবা ইমিউনড হয়ে গিয়েছি। হায় রে কপাল, তখন যদি এই করোনা (ভাইরাস) আর তার ইমিউনিটি নিয়ে খানিকটা ধারণা থাকত, তাহলে পৃথিবীব্যাপী এই ২২ থেকে ২৩ লাখ (পরিসংখ্যানের সত্যতা যাচাইযোগ্য বলে লেখকের মত) মানুষের মৃত্যুর অনেকটা ঠেকানো সম্ভব হত। কিন্তু দোষ দেব কাকে? আমরা অনেক দিন থেকেই গাইছি: ‘অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে…’!
পরের লাইনে যদিও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘অচেনাকেই চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে…’ এই বাণীতে নিশ্চয়ই সাবধান করার ইঙ্গিত ছিল না! তবে অচেনাকে চিনে নিতে গিয়ে আমাদের যে বারবার চিনে ছুটতে হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তার মধ্যেই জীবন ভরে ওঠার বদলে কিছুটা খালি হয়ে গেল, সেটাও সত্যি। এখনও হচ্ছে। তাহলেও অচেনা-(ভাইরাস)কে বছরখানেকের মধ্যে আমরা অনেকটা চিনতে পেরেছি। ইতিমধ্যে করোনা নিয়ে কথার কচকচি কখনও ক্লান্তিকর হয়ে উঠলেও, কিছু তথ্য নিজেদের স্বার্থেই আমাদের জানা দরকার।
ভাইরাস কী? সূক্ষ্মতম নিষ্ক্রিয় এমন বস্তু, যা পছন্দমতো সজীব কোষের সংস্পর্শে এলে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ধারাবাহিকভাবে সংক্রমণ এবং ধ্বংস করে যেতে থাকে। করোনাভাইরাস তথা ‘কোভিড ১৯’-এর কাছাকাছি চরিত্রের ভাইরাস ইতিপূর্বে আমাদের চেনা থাকলেও, এই বিশেষ আক্রমণাত্মক-আচরণের জীবাণু আমাদের পরিচিত ছিল না। ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা যখন তাকে চিহ্নিত করলেন, ততদিনে উড়ানে-উড়ানে ছোট হয়ে যাওয়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশের বাতাসেই করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। চিন ছাড়া ইউরোপ আর আমেরিকা- দু’টি মহাদেশেই প্রবলভাবে মানুষ আক্রান্ত হতে শুরু করল। চিনের পরিসংখ্যান ধোঁয়াশায় থেকে গেলেও, আক্রমণের তালিকায় উপরের দিকে নাম উঠে এল কয়েকটি দেশের। আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র), ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া, ব্রিটেন, মেক্সিকো, ইটালি ইত্যাদি।
বর্তমান লেখক ব্রিটেনপ্রবাসী। বিশেষ করে খেয়াল করলাম, ‘কোভিড ১৯’-এ মৃত্যুসংখ্যা এদেশেই সবথেকে বেশি। দেশ হিসাবে মৃত্যুতালিকার পঞ্চমে নাম থাকলেও, রানির দেশের সকুল্যে সাড়ে ছ’-কোটি জনসংখ্যার অনুসারে ১ লক্ষ ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু (৭ ফেব্রুয়ারি মাফিক), করোনায় মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড। অন্য কয়েকটি দেশে মৃত্যুসংখ্যা আরও বেশি হলেও সেখানে জনসংখ্যাও অনেক বেশি। আমাদের দেশে (ভারতে) ১ লক্ষ ৫৫ হাজার মৃত্যু হলেও (সরকারি হিসাব যদিও), জনসংখ্যা ১৩০ কোটিরও বেশি, সুতরাং…।
আমরা এখনও জানি না, আবহাওয়া কিংবা তাপমাত্রা, না কি মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি, না কি গাত্রবর্ণ কিংবা দেশের দূষণ অথবা দূষণহীনতা, কোনটি করোনা প্রাদুর্ভাবের উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্তত বিলেতের মতো ছোট অথচ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দেশে স্বাস্থ্য এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এত বড় ধাক্কা আগে আর আসেনি। বস্তুত, করোনাক্রান্ত মানুষের মৃত্যুসংখ্যা এদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মৃত্যুসংখ্যাকে অনেকটাই অতিক্রম করে গিয়েছে।
অথচ পৃথিবীর মধ্যে এখনও ব্রিটেন দেশটির স্বাস্থ্যদপ্তর এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা যে অন্যতম, তাতে সন্দেহ নেই। এদেশের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা বা ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’ সংক্ষেপে ‘এনএইচএস’ জনসংখ্যার শতকরা ৯৫ শতাংশকেই যাবতীয় (শারীরিক-মানসিক-সামাজিক) চিকিৎসা দিয়ে থাকে। অসুখের চিকিৎসা-সংক্রান্ত ব্যাপারে রোগী-চিকিৎসক ও হাসপাতালের মধ্যে কোনও টাকাপয়সা দেওয়া-নেওয়ার নিয়ম নেই। দেশের সব মানুষের চিকিৎসার মান এক। রানির দেশকে এখনও ‘মরা হাতি লাখ টাকা’ বলা যায় এই সুবিন্যস্ত, সুপরিকল্পিত এবং আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা আয়োজনের নিরিখে। তা সত্ত্বেও ওই বিপুল সংখ্যক মৃত্যু এবং তার থেকে বহুগুণ বেশি আক্রান্ত মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা দিতে গিয়ে ব্রিটেনের এনএইচএস বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। যাবতীয় রুটিনমাফিক চিকিৎসা, অপারেশন, সব বন্ধ। বেড ভরতি হয়ে আছে করোনা রোগীতে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেক ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, অ্যাম্বুল্যান্স চালক। দেশজুড়ে চলছে কঠোর লকডাউন।
তার মধ্যেই অবশ্য আশার সঞ্চার হয়েছে টিকা তথা ভ্যাকসিনের ব্যবহারে ছাড়পত্র পাওয়ায়। ব্রিটেনের মতো ছোট দেশটিকে কৃতিত্ব দিতে হবে সেক্ষেত্রেও। আমেরিকা থেকে ফাইজার কোম্পানি প্রথমেই ‘কোভিড ১৯’ ভ্যাকসিন ব্যবহার শুরু করলেও, তার দাম (২৬ পাউন্ড, তথা ২৫০০ টাকা) এবং সংরক্ষণের জন্য যে-তাপমাত্রা প্রয়োজন (-৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড), তার জন্য হিমশিম খেতে হচ্ছিল। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় একই সময়ে যে টিকা অ্যাসট্রাজেনেকা কোম্পানির মাধ্যমে নিয়ে এল, তার দাম ফাইজারের ১০ শতাংশ; সংরক্ষণের জন্য সাধারণ ফ্রিজের তাপমাত্রাই যথেষ্ট এবং সর্বোপরি কর্মক্ষমতায় প্রায় কোনও তফাত নেই ফাইজারের সঙ্গে।
পৃথিবীজুড়েই এই মুহূর্তে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় (এমনকী, ভারতে যে ভ্যাকসিন ব্যবহৃত হচ্ছে, তাও এই ফরমুলা অনুযায়ী)। তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণে এবং উপকারিতাও প্রমাণিত হয়ে চলেছে। তবু অশান্তির মেঘ যেন কাটতে চাইছে না, ভাইরাসের নতুন স্ট্রেন বা চারিত্রিক গঠনের আচরণের জন্য। ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞরাও বসে নেই এবং প্রশাসনও। এই যৌথ উদ্যোগের ফলাফল জানাবে সময়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.