Advertisement
Advertisement
Modi

কূটনৈতিক ট্রাপিজ

নরেন্দ্র মোদির মার্কিন সফরে ‘নির্ভরযোগ্য সঙ্গী’দের একজন হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছে ভারত।

India walking a tight rope as Delhi gets closer to Washington | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:June 28, 2023 5:38 pm
  • Updated:July 6, 2023 3:59 pm

নরেন্দ্র মোদির মার্কিন সফরে ‘নির্ভরযোগ্য সঙ্গী’দের একজন হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছে ভারত। সাড়ে ন’-বছর আগে গণতন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রর চোখে যিনি ছিলেন অবাঞ্ছিত ও খলনায়ক, আজ তাঁকে নিয়ে মাতামাতির মধ্য দিয়ে আমেরিকা এই সত্যিই স্পষ্ট করে দিল, রাষ্ট্রের স্বার্থই সবার উপর। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ভারতের অবস্থান ও গুরুত্ব কতটা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদির আমেরিকা সফর তা স্পষ্ট করে দিল। আমেরিকার সব সুরে সুর না-মিলিয়েও ভারত সমীহ আদায় করেছে। নিজের চাহিদা পূরণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রর ‘নির্ভরযোগ্য সঙ্গী’দের একজন হিসাবে নিজেকে প্রতিপন্ন করেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এমনিই এমনিই নরেন্দ্র মোদির জয়গান করছেন না। তিনি ও তাঁর আন্তর্জাতিক বন্ধুরা বিলক্ষণ বুঝেছেন– চিন, রাশিয়া ও ইরানের পাশাপাশি সৌদি আরব পুরোপুরি গা এলিয়ে দিলেও গণতন্ত্রর আধিপত্য রক্ষায় ভারতের সাহচর্য না হলেই নয়। সেই প্রয়োজন মেটানোর মূল্য প্রধানমন্ত্রী মোদিও কড়ায়গণ্ডায় উসুল করছেন। এটা তাঁর কৃতিত্ব।

Advertisement

এই সফরে এটাও স্পষ্ট, ভূ-রাজনীতি ও কূটনীতিতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নয়। নীতি বা আদর্শের স্থান পরে। বাইডেন ও মোদি দু’জনেই তা বুঝিয়ে দিলেন। মোদি তো দেখালেন কূটনৈতিক ট্রাপিজের ভারসাম্য রক্ষায় ভারত অনায়াসে ‘বরের ঘরের মাসি, কনের ঘরের পিসি’ সাজতে পারে। সাপ ও ব্যাঙ উভয়ের মুখে চুমু খাওয়ার সাহস ও ক্ষমতা সবার হয় না। সেদিক থেকে মোদির এই সফর ও ভারতের সামগ্রিক কূটনীতির সাফল্য প্রশ্নাতীত।

Advertisement

যদিও কিছু বিশাল ‘কিন্তু’ অবশ্যই ঝুলে থাকছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও তা বিলক্ষণ বোঝেন। সে প্রসঙ্গ পরে।বাইডেন চেয়েছেন, চাপও সৃষ্টি করেছিলেন, ইউক্রেনের পক্ষ নেওয়ার পাশাপাশি
‘যুদ্ধবাজ’ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভারত তার অবস্থান স্পষ্ট করুক। ভারত তা করেনি। একবছর কেটে গেল, ভারত একবারও রুশ আগ্রাসনের নিন্দা করেনি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার শরিকও হয়নি। উল্টে সস্তায় বিপুল তেল কিনে অর্থনীতি সচল রাখতে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সাহায্য করছে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে‘এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম’ কেনার সিদ্ধান্তেওঅটল। যুক্তরাষ্ট্রকে সোজাসাপটা জানিয়েছে, সম্পর্ক একদিনে তৈরি হয় না। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক সেই সোভিয়েত আমল থেকে। কালের নিয়মে সেই বন্ধন পোক্ত হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার অর্থ রাশিয়াকে ত্যাগ করা নয়।

ভারতের এই অবস্থান মানতে বাধ্য হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও বলা ভাল, বাইডেনকে তা মানতে বাধ্য করেছেন চিনা প্রেসিডেন্টশি জিনপিং। দক্ষিণ চিন সাগরে শি জিনপিংয়ের আগ্রাসী মনোভাব, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের জবরদস্তি আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা, ‘বিআরআই’ কর্মসূচি দিয়ে এশিয়া ঘেরার ইচ্ছা যত প্রকট হয়েছে, ভারসাম্য রক্ষায় আমেরিকা তত কাছে টেনেছে ভারতকে। ভারতও হাত বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।এবারের সফরে সামরিক চুক্তির দিক থেকে ভারতের যা প্রাপ্তি, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব শি জিনপিংয়েরই প্রাপ্য।

পূর্ব লাদাখে থাবা মারার পর অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত লাল ফৌজ পল্লবিত না হলে ভারতও হয়তো এত মরিয়া হত না। জিনপিংয়ের প্রতিটি পদক্ষেপ আমেরিকা ও ভারতের জন্য বিপদঘণ্টি বাজিয়েছে বলেই দুই দেশের এই যুগলবন্দি আজ দৃশ্যমান।

ভারতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধসত্ত্বেও রাজনৈতিক পালাবদল বিদেশনীতির পরিবর্তন ঘটায় না। নীতির ধারাবাহিকতা অটুট রাখা কূটনীতির বৈশিষ্ট‌্য ও সৌন্দর্য। ‘কোয়াড’-এর শরিক হওয়া সত্ত্বেও চিনা উদ্যোগে গঠিত ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’ (এসসিও) ও ‘ব্রিকস’-এর সদস্য হিসাবেভারত সক্রিয়। জিনপিংয়ের প্রাণের প্রকল্প ‘বিআরআই’-এর শরিক ভারত হয়নি। দূরে থেকেছে, বিরোধিতাও করছে, যেহেতু প্রকল্প এগচ্ছে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে। আবার, ভারত ‘ব্রিকস ব্যাংক’-এরসদস্য। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকেরও। গালওয়ানের তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও চিনের জন্য সংলাপের দরজা ভারত বন্ধ করেনি।

যে রাহুল গান্ধী বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কট্টর সমালোচক, যুক্তরাষ্ট্র সফরে তাঁকে দেশের চিনা-নীতির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। রাহুলের উত্তর ছিল, ক্ষমতাসীন থাকলে তাঁরাও এই নীতি নিয়ে চলতেন।

মোদির ভারতের উপলব্ধি, যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের যতটা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্রেরও ভারতকে প্রয়োজন ততখানিই। দুই শক্তির কাছেই ‘কমন’ ফ্যাক্টর চিন। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তি হস্তান্তরে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করানো তাই সহজ হয়েছে। একদিকে লগ্নি, অন্যদিকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ লক্ষ্যপূরণ দু’জনকেই লাভবান করবে। সাড়েন’-বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি য়াঁর ছিল না, গণতন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রর চোখে যিনি ছিলেন অবাঞ্ছিত ও খলনায়ক, আজ তাঁকে নিয়ে মাতামাতির মধ্য দিয়ে আমেরিকা এই সত্যিই স্পষ্ট করে দিল, রাষ্ট্রের স্বার্থই সবার উপর। তার উপর অন্য কিছুই নয়।

স্বার্থসিদ্ধি এবং সার্থক সফর সত্ত্বেও বিশাল ‘কিন্তু’ হিসাবে ঝুলে রইল ‘ভারতের সংখ্যালঘু নির্যাতন, মানবাধিকার হরণ, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, রাজনৈতিক বিরোধের মোকাবিলায় রাষ্ট্রশক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার কিংবা সার্বিকভাবে গণতন্ত্রর অধোগমন’-এর অভিযোগ সংক্রান্ত বহু চর্চিত বিষয়টি। এসব বিষয়, ডেমোক্র‌্যাটদের কাছে যা গণতন্ত্রের ধ্রুবতারা, মোদি জমানায় যা ভূলুণ্ঠিত বলে সে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন বারবার অভিযোগ করে চলেছে, যে-কারণে গণতন্ত্রী ভারত আজ ‘গণতন্ত্রী স্বৈরতন্ত্র’-এ পরিণত, মোদির সঙ্গে আলোচনার সময় সে বিষয়গুলোর উপস্থাপন করতে অনেকেই বাইডেনকে চাপ দিয়েছেন। ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর সম্পাকদীয়তে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে মনে করিয়ে লেখা হয়েছিল, রাষ্ট্রীয় স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রর অবশ্যই উচিত ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা। কিন্তু মোদি জমানায় গণতান্ত্রিক ভারতের উদ্বেগজনক ক্রমাবনতিতে যুক্তরাষ্ট্র নীরব থাকতে পারে না। ভারতকে বলা দরকার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া ভারতের ভাবমূর্তি বাড়াবে। গণতন্ত্র দুর্বল হওয়া দুর্বল ভারতেরই পরিচায়ক।

বাইডেনকে ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ মনে করিয়ে দিয়েছিল, মোদির সঙ্গে নিভৃত আলাপচারিতায় নিশ্চয়ই তিনি এসব উত্থাপন করবেন। কিন্তু কিছু কথা প্রকাশ্যেও বলা প্রয়োজন। বন্ধুকে সত্য কথা শোনানোর বাধ্যবাধকতা বন্ধুরই থাকে।

এই দাবিই আরও স্পষ্ট, আরও খোলামেলা ও আরও জোরালোভাবে বাইডেনের কাছে রেখেছিলেন মার্কিন কংগ্রেসের ৭৫ জন সদস্য। চিঠির সঙ্গে তাঁরা নিজের দেশের স্বাধীন গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির প্রতিবেদনের নমুনাও জুড়ে দিয়েছিলেন। কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে মোদির ভাষণ বয়কট করেন পাঁচ সদস্যও। হোয়াইট হাউসের আশপাশে সফর চলাকালীন ছোট-মাঝারি বহু শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। প্রচারের আলো যদিও ঠিকরে পড়েছে মোদির ‘জয়যাত্রা’-র উপর। প্রকাশ্যে বাইডেনকে এমন একটি শব্দও বলতে শোনা গেল না, যাতে মনে হয় সংবাদপত্রর সম্পাকদীয় মেনে তিনি ‘বন্ধুকৃত্য’ পালন করেছেন।

কিন্তু তাই বলে গণতন্ত্র-বিতর্কের অকালমৃত্যু হয়নি। বরং মোদির ‘নতুন ভারত’-এর স্বরূপ আমেরিকার কাছে প্রকট হয়ে গিয়েছে। মোদির দল ও তঁার সরকার যেভাবে বারাক ওবামাকে খলনায়কে পরিণত করেছে, যেভাবে ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকিকে হিন্দুত্ববাদীরা ‘পাকিস্তানি এজেন্ট’ প্রতিপন্নর চেষ্টা করে চলেছে, তাতেই স্পষ্ট মোদি জমানায় ভারতে সরকারের সমালোচকদের হাল কীরকম হয়।

ওবামার অপরাধ, মোদির সঙ্গে আলোচনায় বাইডেনকে তিনি ভারতের মুসলমানদের নিরাপত্তার বিষয়টি উত্থাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মোদির সঙ্গে কথা হলে আমি বলতাম, সংখ্যালঘুর স্বার্থ না-দেখলে দেশটা ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। তাতে হিন্দু ভারতেরও মঙ্গল হবে না।

সাবরিনার অপরাধ, ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ সংক্রান্ত প্রশ্নটা বাইডেন ও মোদিকে তিনিই করেছিলেন। গণতন্ত্রর অধোগমন নিয়ে মোদির সঙ্গে বাইডেন আলোচনা করেছেন কি করেননি আজ আর তা বড় কথা নয়। বড় কথা এটাই, মোদির ইশারা ছাড়া তঁার দল, মন্ত্রী ও কুখ্যাত ট্রোল বাহিনী বারাক ওবামা ও সাবরিনা সিদ্দিকির ব্যান্ড এভাবে বাজাতে পারতেন না। ভারতীয় গণতন্ত্র কীভাবে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’-এ পরিণত হয়েছে, সেই গণতন্ত্রর ডিএনএ-ই বা কেমন, তা আর প্রমাণের অপেক্ষায় রইল না।

([email protected])

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ