Advertisement
Advertisement
India

ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ কি নিছক কল্পনাপ্রসূত?

দেশজোড়া সাম্প্রতিক তাণ্ডব কীসের প্রমাণ?

India's track record on human rights deplorable | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:April 21, 2022 7:03 pm
  • Updated:April 21, 2022 7:03 pm

মানবাধিকার আন্দোলনকর্মীরা যে-অপরাধে ভারতকে কাঠগড়ায় তুলছেন, তা কি নিছক কল্পনাপ্রসূত? দেশজোড়া সাম্প্রতিক তাণ্ডব তাহলে কীসের প্রমাণ? হিজাবকে কেন্দ্র করে অসহিষ্ণুতার যে-আবহ সযত্নে তৈরি করা হল, হালাল ও আজান বিতর্ক পেরিয়ে তা পূর্ণতা পেল রামনবমীতে। প্রায় চার দশক দিল্লিবাসী। এবারই প্রথম দেখলাম রামনবমীর দিনগুলো বাধ্যতামূলক নিরামিষ করে তুলতে রাষ্ট্র, সরকার, পুলিশ ও প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচ্ছন্ন উদ্যোগ। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

মেরিকার বিদেশমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যেদিন প্রকাশ্যে ভারতে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, সেদিন তাঁর পাশে তাঁরই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ছাড়াও ছিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শংকর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। সেটা ছিল পারস্পরিক সম্পর্ক জোরাল করার বৈঠক, কূটনৈতিক পরিভাষায় ইদানীং যা ‘টু প্লাস টু ডায়লগ’। ব্লিঙ্কেন তাঁদের আপত্তির ফিরিস্তি লম্বা না করে জানান- ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে রয়েছে সরকার, পুলিশ ও জেলখানার কর্তারাও। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি তা এড়াচ্ছে না।

Advertisement

সফররত মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে এমন প্রকাশ্য সমালোচনা খুব একটা দেখা যায় না। সেদিক থেকে এই ঘটনা বিরল। জয়শংকর সেদিন এই কিল হজম করলেও পরের দিন মুখ খোলেন। বলেন, ভারতও আমেরিকা-সহ অন্য দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের উপর নজর রাখে। সেই সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দেন, মানবাধিকার নিয়ে অনেকের অনেক স্বার্থ আছে। ভোট ব্যাংকের রাজনীতিও আছে। আছে নানারকম লবি।

Advertisement

[আরও পড়ুন: এটিকে সরালে মোহনবাগানিদের হৃদয়ে থাকবেন সঞ্জীব গোয়েঙ্কা]

সেদিনই মার্কিন বিদেশমন্ত্রক মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত যে-রিপোর্ট প্রকাশ করে তাতে ভারতের চিত্রটি বেশ অনুজ্জ্বল। রাষ্ট্রীয় মদতে বেআইনি ও ইচ্ছাকৃত হত্যা, রাষ্ট্রযন্ত্রের যথেচ্ছাচার, পুলিশ ও জেল হেফাজতে হত্যা, অত্যাচার, নির্বিচার আটক, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, সাংবাদিকদের মারধর, হুমকি ও গ্রেপ্তার, সংখ্যালঘু নির্যাতন- সব ধরনের অপরাধের ফিরিস্তি তাতে লিপিবদ্ধ। শুধু রাষ্ট্রীয় লঙ্ঘনই নয়, জম্মু-কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জঙ্গি এবং মাওবাদীদের অত্যাচারের উল্লেখও রিপোর্টে স্থান পেয়েছে। সব মিলিয়ে ভারতের ছবি মোটেই সভ্য-ভব্য নয়।

মানবাধিকারের প্রশ্নে পশ্চিমি দুনিয়া বরাবর স্পর্শকাতর। ট্রাম্প প্রশাসন এসব নিয়ে যতটা উদাসীন ছিল, বাইডেনের সরকার ততটাই সরব। দুই দেশের সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে এই একটা কাঁটা বেশ খচখচে। হালে যোগ হয়েছে রাশিয়াকে নিয়ে টানাপোড়েন। নেহাত সবদিক থেকে ভারত অনুপেক্ষণীয়, তাই বিরক্তি ও উদ্বেগ ছাড়া বাড়তি কিছু প্রকাশ কারও পক্ষে করা কঠিন। এটাই ভারতের শক্তি, বিদায়বেলায় যা স্বীকারে বাধ্য হয়েছেন ইমরান খান পর্যন্ত।

কিন্তু তাই বলে এটা নয় যে, অভিযোগ সব কাল্পনিক ও মনগড়া। এমনও নয় যে, এহেন সমালোচনা এই প্রথম। আমেরিকা আগেও ভারতকে সতর্ক করেছে। অন্য দেশও। বিভিন্ন সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রিপোর্টেও ভারত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। রাজনৈতিক পালাবদলের পর উগ্র হিন্দুত্ববাদী নয়া জমানায় সমালোচনার সংখ্যা ও তীব্রতা দুটোই বেড়েছে। কিন্তু কোনও কিছুকে তোয়াক্কা না-করার এক অদ্ভুত প্রবণতা এই প্রথম এই জমানায় পরিলক্ষিত। বরং পরিকল্পিতভাবে যা কিছু ঘটানো হচ্ছে- যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠের যথেচ্ছাচার, গণহত্যার হাঁক কিংবা ঘৃণার বিষ ছড়ানো- তা বুক ফুলিয়ে করা হচ্ছে এবং শীর্ষ পর্যায়ে অনুমোদিতও হচ্ছে! বলা হচ্ছে, নতুন ভারতের নতুন রাজনীতি এটাই। সেই রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভোটব্যাংকের চিরায়ত কৌশল প্রত্যাখ্যান করছে। অপকর্মের সমালোচকদের বলা হচ্ছে তাঁরা ‘দেশের আত্মায় আঘাত হানছেন’। গণতান্ত্রিক সমাজে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা কীভাবে কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়ে ওঠে সেই চর্চায় এখনকার ভারত বিস্ময়করভাবে নিজেকে তুলে দিয়েছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের এই বিবর্তন আগে চোখে পড়েনি।

সেই বিবর্তনের একটা ঝলক দেখা গেল সোনিয়া গান্ধীর লেখা সাম্প্রতিকতম নিবন্ধে। পি. চিদম্বরম, শশী থারুর কিংবা জয়রাম রমেশের মতো নিবন্ধকারের পরিচিতি সোনিয়া কোনও দিন পাননি। সচেতনভাবে চেষ্টা করেছেন বলেও শোনা যায়নি। ক্ষীয়মাণ দলের সভানেত্রী হলেও নিখাদ বিজেপি বিরোধিতা তাঁকে এই নিবন্ধ লিখতে সাহসী করে তুলেছে। তাঁর কলমে উঠে এসেছে শাসক বিজেপির ‘ঘৃণা, ধর্মান্ধতা, অসত্যভাষণ, অসহিষ্ণু ও বিভেদকামী’ রাজনীতির আখ্যান, যা ‘দেশকে ক্রমশ গ্রাস করছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘মিথ্যা জাতীয়তাবাদের যূপকাষ্ঠে শান্তি ও বহুত্ববাদের বলি আমরা নীরব দর্শক হয়ে দেখে যেতে পারি না।’ এই লড়াইয়ে সোনিয়া আশ্রয় খুঁজেছেন রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনায় যেখানে চিত্ত ভয়শূন্য এবং শির উচ্চ।

ভারত যে অতি দ্রুত এক ‘চিরস্থায়ী মেরুকৃত’ দেশে পরিণত হচ্ছে সেই আশঙ্কা কংগ্রেস সভানেত্রী গোপন করেননি। সেই আশঙ্কাই ১৩টি দলের নেতা-নেত্রীর খোলা চিঠি লেখার তাগিদ। ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক হিংসায় উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর বিস্ময়কর মৌনর সমালোচনা করে তাঁরা বলেছেন, একটিবারের জন্যও দেশের প্রধান সেবককে ঘৃণা উদ্রেককারীদের বিরুদ্ধে একটি শব্দ ব্যয় করতে দেখা গেল না! এই বিস্ময়কর নীরবতা বুঝিয়ে দেয় দাঙ্গাবাজ ও ঘৃণার কারবারিরা কীভাবে শাসক ও সরকারের প্রশ্রয় পাচ্ছে।

মানবাধিকার আন্দোলন কর্মীরা যে-অপরাধে ভারতকে কাঠগড়ায় তুলছেন, তা কি নিছক কল্পনাপ্রসূত? দেশজোড়া সাম্প্রতিক তাণ্ডব তাহলে কীসের প্রমাণ? হিজাবকে কেন্দ্র করে অসহিষ্ণুতার যে-আবহ সযত্নে তৈরি করা হল, হালাল ও আজান বিতর্ক পেরিয়ে তা পূর্ণতা পেল রামনবমীতে। কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, কেরল, তেলেঙ্গানা, পশ্চিমবঙ্গে জ্বলল অশান্তির আগুন। যত অশান্তি, তত লাভ। কারণ, ততটাই মেরুকরণ!

২০ শতাংশের বিরুদ্ধে ৮০ শতাংশের ইচ্ছাকেই শুধু প্রাধান্য দেওয়া নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠদেরও একছাঁচে টেনে আনা হচ্ছে! আমি প্রায় চার দশক দিল্লিবাসী। এবারই প্রথম দেখলাম রামনবমীর দিনগুলো বাধ্যতামূলক নিরামিষ করে তুলতে রাষ্ট্র, সরকার, পুলিশ ও প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচ্ছন্ন উদ্যোগ। গাজিপুরের মাছ-মাংসের আড়তকে বন্ধ রাখার অলিখিত হুকুম জারি হল। নবমীর দিনে মাংস খাওয়ার অপরাধে পেটানো হল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের। মেরুকরণের এই রাজনীতির নবতম আকর্ষণ ‘বুলডোজার’ ও ‘দাঙ্গা কর’। যোগী আদিত্যনাথের দাওয়াই ক্রমে সর্বজনীন হতে চলেছে। মোদির শিখর ছুঁই-ছুঁই জনপ্রিয়তার ভাগীদার এখন তিনিও।

অপরাধী দমনে বুলডোজারের ব্যবহার এবং ব্রিটিশ আমলের ‘পিটুনি কর’-এর ধাঁচে ‘দাঙ্গা কর’ চালু করে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আজ হিন্দু হৃদয়ের নতুন সম্রাট। তাঁকে দেখে উৎসাহী হয়েছেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও। রামনবমীর দাঙ্গায় প্রশাসন-চিহ্নিত অপরাধীদের বাড়ি ধূলিসাৎ করতে ব্যবহৃত হয়েছে বুলডোজার। বসানো হয়েছে ‘দাঙ্গা কর’। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীও সমগোত্রীয় হবেন বলে হুংকার দিয়েছেন। ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ‘হেট স্পিচ’ ও ‘বুলডোজার’ নীতি। বিষ ওগরানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে গেরুয়াধারী অপরাধীদের। অথচ প্রধানমন্ত্রী ‘স্পিকটি নট’! আট বছর ধরে মৌন অবলম্বনের রেকর্ড তাঁর আস্তিনে। ১৩ কেন, ২৩ মুখ্যমন্ত্রীর খোলা চিঠিতেও তাঁর হুঁশ ফিরবে না।

কিন্তু তিনি না হয় রাজনীতিক। আদালত তো তা নয়? সময় সময় সর্বোচ্চ আদালতের মৌন তবে কেন ভ্রম উদ্রেক করে? তিন বছর কাটতে চলল, সুপ্রিম কোর্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের সাংবিধানিক বৈধতা বিচারের সময় পেল না। এনআরসি, সিএএ, ধর্মান্তরণ আইনের চ্যালেঞ্জ এখনও অমীমাংসিত। নির্বাচনী বন্ড মামলার রায় আসেনি। হিজাব মামলা গৃহীত হলেও দ্রুত নিষ্পত্তির আরজি অগ্রাহ্য হয়েছে। ‘বুলডোজার বিচার’-এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে কড়া নেড়েছে জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দ। এ-ও কি হবে আরও এক শবরীর প্রতীক্ষা?

এই জমানায় কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থার আপাত নিস্পৃহতা গণতন্ত্রের ‘তৃতীয় স্তম্ভ’-র নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। ফলে প্রসারিত হচ্ছে ৮০-২০-র ফাটল। ১১ বছর আগে লেখা নিবন্ধের জন্য কাশ্মীরি গবেষকের গ্রেপ্তারি নিয়ে পশ্চিমি দুনিয়া প্রশ্ন তুললে জয়শংকররা ক্ষুণ্ণ হতেই পারেন। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন, আইনের এমন শাসন পশ্চিমি গণতন্ত্রে আছে কি না? ‘শিবঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন সর্বনেশে।’ আদ্যিকালের ‘একুশে আইন’ আজ আওড়ালে কে জানে কাকে কোন দুর্ভোগ পোহাতে হবে?

[আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অর্থনীতিবিদরা, ভারতও কি দেউলিয়া হওয়ার পথে?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ