কিংশুক প্রামাণিক: সারা রাত তিনি পথেই। রাস্তার ওপারে মেট্রো সিনেমার পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ করে চলে যাচ্ছে বড় বড় ট্রাক। সত্যাগ্রহের মঞ্চ দুলছে। বেশ শীত, শীত। এতক্ষণ গায়ে ছিল হালকা শাল। ছোট্ট একটি কম্বল জুটল শেষরাতে। জেগেই তিনি। ভোর হয়ে আসছে। মঞ্চের একপাশে একজন শোয়ার মতো অস্থায়ী বিছানা। বালিশের উপর বালিশ চাপিয়ে হেলান দিয়ে তিনি বসে। মুখে চেনা হাসি। অদ্ভুত এক তৃপ্তি। বুঝতে পারছিলাম, নিজের আন্দোলনের দিনে ফিরতে পারার আনন্দ। প্রতিবাদী-রূপে তাঁকে বেশ মানায়। খোলা মঞ্চে তাঁর দিকে তাক করা অনেক ক্যামেরা। সবাই ফলো করছে। মনে হচ্ছিল, তিনি ঘুমোবেন কি না, চা খাবেন কি না, সেটাও আজ খবর। এক সিদ্ধান্তে দেশের সব ক্যামেরার মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। প্রচারের সার্চলাইট তীব্র। রসায়ন যা-ই হোক, রাজনীতির মাস্টারস্ট্রোক বুঝি এমন হয়।
দু’টো রাত এভাবেই কাটল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। লম্বা মঞ্চ। দু’পাশ ঘেরা। সোমবার সকালে লাগানো হয় ‘সেভ ইন্ডিয়া’ স্লোগান ফ্লেক্স। দিনভর নানা জগতের মানুষের ভিড়। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এই মঞ্চ তাঁর দলের নয়। সবাই স্বাগত। বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক জগতের কর্মীরা তাই ভিড় করে এলেন। বক্তৃতায়, গানে প্রতিবাদ। ধরনা যেন সবাইকে একজোট করার উৎসব। মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন, তাই এদিনও মঞ্চের পাশেই দেখা গেল ডিজি বীরেন্দ্র, নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ, পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার-সহ পদস্থ কর্তাদের।
[শীর্ষ আদালতে সম্মুখ সমরে সিবিআই-পুলিশ, ধরনা মঞ্চে বিরোধী ঐক্যের ছবি]
সর্বদা নিজেকে ‘নিট অ্যান্ড ক্লিন’ ও ফিট রাখেন মমতা। অফুরন্ত এনার্জি। পরিমিত আহার। দিনে পনেরো, ষোলো কিলোমিটার না হাঁটলে মেজাজ বিগড়ে যায় তাঁর। পৃথিবীর যে প্রান্তে যাবেন, তাঁকে হাঁটতেই হবে। একদা অনশন মঞ্চ এই শিক্ষা দিয়েছে। পণ করেছেন নিজের প্রতিবাদ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ধর্মতলা ছাড়বেন না। সেই কারণে হাঁটাহাঁটির কাজটা দিনভর মঞ্চে করলেন চরকিপাকের মতো এদিক ওদিক ঘুরে। ব্যস্ত দিনে নবান্নে নিজের চেম্বারে গোল হয়ে হেঁটেই কোটা পূর্ণ করেন। এদিনও তেমন চেষ্টা। কিন্তু অত ভিড়ভাট্টার মধ্যে কি আর হাঁটা হয়! সকাল থেকে রাত, মঞ্চে নানামহলের মানুষের ভিড়। কেউ জানে না কতদিন এই ধরনা চলবে। কিন্তু সবাই জানেন, দিদি আছেন যখন, তখন তাঁরাও আছেন।
[শহিদ স্বামীর হয়ে মমতার হাত থেকে পুরস্কার নিলেন বিউটি মালিক]
মনে পড়ছিল বারো বছর আগের কথা। দিনটা ছিল ৪ ডিসেম্বর, ২০০৬। এমনই আচমকা তিনি বসে পড়েছিলেন অনশনে। এই ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলে। প্রথম রাতে তাঁকে যেমন দেখেছিলাম আজও তেমন। কোনও ফারাক নেই। সেদিন ছিলেন বিরোধী নেত্রী। একা একজন সাংসদ। এত প্রচার ছিল না। ছিল না এত গুরুত্ব। কিন্তু আজ তিনি মুখ্যমন্ত্রী। অনেক শক্তি। অনেক সাংসদ। হাজার হাজার জনপ্রতিনিধি তাঁর। অন্য অনেক বড় বড় দলের সমর্থন পাশে।
বারো বছরে কত পরিবর্তন। যদিও মমতার কোনও বদল নেই। তিনি সেই এক মেজাজে। ধর্মতলার ফুটপাথেই স্বচ্ছন্দ। সেই পঁচিশ বছর আগে লক আপে মৃত্যুর প্রতিবাদ থেকে আজ ‘সেভ ইন্ডিয়া’র ধরনা – মমতা আছেন মমতাতেই। দেখলাম পাশে রাত জাগছেন দোলা সেন। সিঙ্গুরের সময় অনশন ও সত্যাগ্রহ মঞ্চে যিনি ‘লড়াই করো’ বা ‘যত হামলা করো’ গেয়ে মাতিয়ে দিতেন। মমতা তাঁকে বোঝালেন, এবার আর ধানের গান নয়, ‘মান’-এর গান গাইতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর পাশে বিশ্বস্ত সৈনিক মেয়র ববি হাকিম, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস কুমার, মহুয়া মৈত্রও। এঁরাও কেউ রাতে বাড়ি গেলেন না। মঞ্চের নিচেও অনেক মুখ। যাঁদের দেখেছিলাম বারো বছর আগে। সাংবাদিকদের প্রতি বরাবর সহৃদয় মমতা। তাই তাঁদের জন্য রাতে খাবারের ব্যবস্থা করা, একটু বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হোক বা মোবাইলে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা– সব করলেন।
[‘রাজীবের পাশে আছি’, পুলিশদের সম্মান প্রদান অনুষ্ঠানে বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর]
ফোনে অনর্গল কথা বলা স্বভাব। খবর দেখা, মেসেজ পড়া। দু’টো মোবাইলের উপর অত্যাচার কম হয় না। চার্জ চলে যাওয়া স্বাভাবিক। ভরসা পাওয়ার ব্যাঙ্ক। কিন্তু রবিবার সন্ধ্যায় ধরনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এত ফোন, এসএমএস এসেছে যে পাওয়ার ব্যাঙ্কও ফেল। কে না ফোন করেছেন? মঞ্চের পিছনে কলকাতা পুলিশের একটি বিশ্রামের স্টল আছে। ওটাই এখন ফ্রেশ হওয়ার একমাত্র জায়গা। এমনিতেই খাবার কম খান। দিনভর শুধু চা আর চা। রাতেই সামান্য কিছু মুখে দেওয়া। রবিবার অফিস ছিল না। হঠাৎ ধরনা। রুটিন তাই এলোমেলো।
সকাল হতেই গাড়ির শব্দে ধর্মতলায় টেকা দায়। প্রায় না ঘুমিয়ে বা আধোতন্দ্রায় কেটে গেল রাত। ভোরের রোদ এসে পড়ে তাঁবুর মতো করে টাঙানো সামিয়ানায়। আর কী! এবার উঠে পড়া। আসতে লাগল মিছিলের পর মিছিল। মানুষের কলরবে উদ্ভাসিত ধর্মতলা দেখে মনে হচ্ছিল, আজ কি একুশে জুলাই!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.