Advertisement
Advertisement

Breaking News

শিক্ষা নীতি

বেহাল অর্থনীতিতে শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণই বিকল্প পথ

ছ’বছরের শাসনকাল অতিবাহিত করার পর নয়া শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে মোদি সরকার।

Private investment in education sector is must
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:August 8, 2020 7:14 pm
  • Updated:August 8, 2020 7:14 pm

জয়ন্ত ঘোষাল: কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ‍্যক্ষ বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের, কিছু ভারতীয় সাংবাদিককে বলেছিলেন, তাঁরা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারীকরণ করেছেন বহু বছর আগেই। নতুন নতুন বাড়ি ও ফ‍্যাকাল্টি নির্মাণ করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের বিপুল খরচ জোগাতে তখন এগিয়ে এসেছে বহু বেসরকারি সংস্থা। আমরা, ছোট্ট এক প্রতিনিধি দল গিয়েছিলাম ব্রিটেন সরকারের আমন্ত্রণে। ওদের রাজনৈতিক ব‍্যবস্থা, সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সংবাদমাধ‍্যমকে কাছ থেকে দেখার জন্য।

[আরও পড়ুন: করোনা আবহে দুর্গাপুজোর ভবিষ্যৎ কী? বিকল্প পন্থার নিদান দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা]

সেই অধ‍্যক্ষ মহাশয় সেদিন আর-একটি কথাও স্বীকার করেছিলেন, তা হল: বেসরকারি পুঁজি অনেক বেশি আসে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার বিজ্ঞান এমনকী, অর্থনীতির জন্য। কিন্তু অত টাকা ইতিহাস, দর্শন বা সাহিত্যপাঠের জন্য তারা দিতে চায় না। আমি এটা শুনে সেদিন কিঞ্চিৎ দুঃখিতই হয়েছিলাম। বলেছিলাম, তাহলে হিউম‍্যানিটিজের ভবিষ্যৎ?

Advertisement

ভদ্রলোক সাদা গোঁফের নিচে মুশকিল-আসান একটা হাসি উপহার দিয়ে বলেছিলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট তো অখণ্ড। আমরা বেসরকারি পুঁজির শর্ত মানি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বরাদ্দ থেকে একটা ভরতুকি দিই এই সমস্ত বিভাগকে।

Advertisement

আমার এ অভিজ্ঞতা অনেক দিন আগের। সম্প্রতি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রশাসক জানিয়েছেন যে, আর্থিক উদারবাদের প্রথম অধ‍্যায়ে রাজস্ব যতটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমুখী ছিল, এখন কিন্তু এই নিউ-এজ ডিজিটাল দুনিয়ায় বেসরকারি রাজস্ব আসছে দর্শন, ইতিহাস ও কলাবিদ‍্যার জন্য। তবু এখনও তুলনামূলকভাবে কলা ও দর্শনের জন্য বেসরকারি রাজস্ব সংগ্রহ অনেক কম।

ভারতে নরেন্দ্র মোদির সরকার ছ’বছরের শাসনকাল অতিবাহিত করার পর এক নয়া শিক্ষানীতি ঘোষণা করল। ১৯৬৫ সালে ‘কোঠারি কমিশন’ গঠিত হয়। নেহরুর মৃত্যুর ৫০ দিন পর এই কমিশন গঠন হয়, যদিও শিক্ষানীতি প্রণয়নের ভাবনাটি ছিল নেহরুর। ’৮৬ সালে রাজীব গান্ধী নিয়ে এসেছিলেন নতুন শিক্ষানীতি। ‘শিক্ষা দপ্তর’ হয়ে গিয়েছিল ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ’। ’৮৪ সালের নভেম্বর মাসে রাজীব প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তখন তাঁর সরকারের বিপুল সংখ‍্যাগরিষ্ঠতা। ব‍্যবসার ক্ষেত্রে বলা হয়, কোনও কর্পোরেট সংস্থা যদি শক্তিশালী লাভজনক হয়– তবে সে সংস্থার পক্ষে সংগঠনে নীতিপ্রণয়ন সোজা হয়। তাই রাজীব গান্ধী ’৮৫ সালের ৫ জানুয়ারি নিজে ঘোষণা করেন যে, নতুন শিক্ষানীতি তিনি করবেনই। তাঁর অগ্রাধিকার শিক্ষানীতি হলেও অন্যতম লক্ষ্য ছিল, অতীতের ভারতীয় ঐতিহ্য এবং পাশ্চাত্য আধুনিকতার মিলন। সেই শিক্ষানীতি দেশের সর্ব ধর্ম, সর্ব জাতির সমন্বয়সাধন করবে– রাজীব চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শিক্ষানীতিও বাস্তবায়িত হয়নি। ’৮৭ সালের এপ্রিল মাসে বোফর্স কেলেঙ্কারির ফলে নবোদয় মডেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের নতুন সিলেবাস অথবা মুক্ত বিশ্ববিদ‍্যালয়– সবই এলোমেলো হয়ে গেল।

নরেন্দ্র মোদির শিক্ষানীতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি কমিটি গঠন করে আগে নীতিটি পর্যালোচনা করতে আগ্রহী। এ তো প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত! মমতা শিক্ষানীতি নিয়ে কোনও ‘knee jerk’ প্রতিক্রিয়া দেননি। বিতর্ক তো সবসময়ই ভাল।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ‍্যক্ষ যা বলেছিলেন, সে ঘটনাটা আজ কেন মনে পড়ল? মনে পড়ার একটাই কারণ, সেটা হল– শিক্ষানীতিতে বেসরকারীকরণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে বামপন্থী বিদ্বৎসমাজ ‘গেল-গেল’ রব তুলছে, তারা যতই ভাল ভাল নীতিকথা বলুক না কেন, শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে গেলে আজ তা বেসরকারি সূত্র ছাড়া আদৌ কতখানি সম্ভব? কেন্দ্রের রাজকোষের অবস্থা তো সকলেরই জানা। রাজ‍্য সরকারগুলিরও নুন আনতে পান্তা ফুরয়। মনমোহন সিংয়ের সময় কপিল সিবাল মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী হিসাবে (২০০৯-২০১২) বেসরকারীকরণ চেয়েছিলেন। তাছাড়া, ‘ন‍্যাশনাল কাউন্সিল অফ হায়ার এডুকেশন রিসার্চ’ নামের এক সুপার-রেগুলেটরি গঠন করতে চান এবং ব‍্যর্থ হন।

তাই বেসরকারীকরণ মানেই ‘গেল-গেল’ রব তুলতে হবে, তার কোনও অর্থ নেই। আবার মাতৃভাষাকে প্রাথমিক স্তরে গুরুত্ব দেওয়ায় সেক্ষেত্রে হিন্দি জাতীয়তাবাদের সংঘ-দর্শন চাপিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এদেশে ‘হিন্দি মাতৃভাষা নয়’ এমন রাজ্যের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। বরং বাংলার ক্ষেত্রে প্রশ্নটা অন‍্যত্র। অশোক মিত্র কমিশন ‘মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’– রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যের ভিত্তিতে বাংলা ভাষাকে প্রাথমিক স্তরে পঠনপাঠনের প্রধান মাধ‍্যম করে তুলেছিল, তাতে কি রাজ্যে লাভ হয়েছে? বরং ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলি থেকে গিয়েছিল। সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা মূলত শহুরে এক ভিন্ন শ্রেণিভুক্ত হয়। আর গ্রামীণ বাংলার সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আর একটি প্রজাতি তৈরি হল। রাজ্যে শহর ও গ্রামের মধ্যে আর্থ-সামাজিক দূরত্ব বাড়ল। তিনটি প্রজন্ম এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এরপর দেখা যায়, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সিবিএসসি আর আইএসসি-তে পড়ার চল মাধ‍্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের চেয়ে বেড়ে গেল। প্রথমে ক্লাস ফোরের বৃত্তি পরীক্ষা উধাও হল। তারপর দেখলাম, কোথায় গেল সেই স্কুলওয়ারি টেস্ট পেপারের দিনগুলো। এখন বাংলা বাধ‍্যতামূলক মিডিয়াম, তবে কি দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজি গুরুত্ব পাবে? না কি পাবে না?

১৯৯৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ মধ‍্যশিক্ষা পর্ষদ’-এর সচিব উজ্জ্বল বসু লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ৫০ বছর ধরে শিক্ষায় ইংরেজির স্থান নিয়ে ভেবেছেন। শিশু বয়সে ইংরেজি ভাষাশিক্ষাকে শিশু-মনের পুষ্টিসাধনের পক্ষে ঘোরতর ক্ষতিকর বলে রায় দেন। আবার বহু শিক্ষাবিদ বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি সম্পর্কিত মনোভাবকে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। আমি নিজে শিক্ষাবিদ বা পণ্ডিত নই। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান থেকে মনে হয়, চাকরিবাকরির জন্য ইংরেজি শিক্ষা প্রয়োজন। এই শিক্ষানীতিকে বাস্তবায়িত করা হলে প্রাক্‌-প্রাথমিক, প্রাথমিক, এমনকী, ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষাটার পরিণতি ঠিক কী হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, ১০+২ বদলে যে পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে, তাতে প্রাথমিকের আগে প্রি-নার্সারি-নার্সারি থেকে প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাও পর্ষদের অধীনে আসবে। এটা ব‍্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইংরেজি স্কুলগুলির উপর প্রত‍্যাসন্ন আঘাত বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে যাঁরা এসব স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, তাঁদের কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেও তো প্রশ্ন। আবার আজকাল শুনি, এই শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেকেই প্রাইভেট টিউশনি করে অর্থোপার্জন করেন। সরকার যদি শিশুদেরও পর্ষদের আওতায় আনতে চায়, তবে সেটি কি মাধ‍্যমিক পর্ষদের আওতায় হবে, না কি নতুন পর্ষদ গঠন হবে? নতুন পর্ষদ গঠন করলে নতুন করে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ করলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বাড়বে। আর এজন্য নতুন ভবন নির্মাণ করতে হবে, নতুন শিক্ষক নিয়োগ হবে। এই পরিকাঠামোর জন্য মূল প্রশ্ন হল: প্রয়োজনীয় টাকাটা আসবে কোথা থেকে?

এরপর প্রশ্ন হল, শিক্ষা তো সংবিধানের যুগ্মতালিকায়। যদি কোনও রাজ‍্য সরকার এই শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে এবং রাজ্যে এটি বাস্তবায়িত করতে রাজি না হয়, তবে তার সাংবিধানিক পরিণতি কী হবে? শিক্ষা যুগ্মতালিকায়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অভিযোগ, এ নীতি নিয়ে তাদের সঙ্গে কোনও আলাপ-আলোচনাই করা হয়নি। সেক্ষেত্রে কী হবে?

যদি বিজেপি-শাসিত রাজ‍্যগুলিতে শিক্ষানীতি কার্যকর হয়, আর অ-বিজেপি রাজ্য তা না করে– তবে তো ভারতেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দু’টি পৃথক শ্রেণি, পৃথক দুনিয়া তৈরি হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলির পরীক্ষা বা বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রশ্নেও যদি ভেদাভেদ হয়ে যায়, তাহলে কি দেশে সংশয় আরও বাড়বে না?

আর সবচেয়ে বড় কথা হল, এই শিক্ষানীতিকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে যদি আরও টাকা লাগে, তবে তার জন্য বেসরকারীকরণের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহের চেষ্টা কোথায় কোথায় হবে, তা নীতিতে স্পষ্ট নয়। বাস্তবে এই পুঁজি কতটা আসবে? দেশের অর্থনীতি শোচনীয়। বৃদ্ধির চিত্র হতাশার। করোনা দেশের কর্মসংস্থান, উৎপাদন বা বিদেশি লগ্নির চিত্রকে আরও দুঃখের গর্ভে নিমজ্জিত করেছে। এ অবস্থায় লাগে টাকা তো দেবে কোন গৌরী সেন?

কোঠারি কমিশনের সুপারিশে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয় যে, জিডিপির শতকরা ৬ ভাগ সরকারকে শিক্ষাক্ষেত্রে খরচ করতে হবে। সেটা কিন্তু সেদিনও হয়নি। পরবর্তীকালে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই তা হয়নি। মোদির শিক্ষানীতি থেকে জানা যায়নি জিডিপির শতকরা কতভাগ অর্থ শিক্ষাক্ষেত্রে বলিপ্রদত্ত। আর টাকাটা আসবে কোথা থেকে? তাই দপ্তরের নাম রাজীবের দেওয়া ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন’ বদলে আবার নেহরু যুগের ‘শিক্ষা’ শব্দে ফিরে যাওয়া আমার কাছে কোনও রোমহর্ষক পরিবর্তন নয়! তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হল আর্থিক। যে-দেশে স্কুলে ড্রপ আউট সমস্যা চরমে, যে দেশে স্কুলে মিড-ডে মিল দিতে হয় গরিব ছাত্রছাত্রীদের কল‍্যাণে, যে দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে গ্রাম-শহর বিরোধ আজও ভয়ংকর, যে দেশে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য শিক্ষার আলোকে সমাজের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে দিতে পারে না– সে দেশে শিক্ষানীতির অগ্রাধিকার হওয়া প্রয়োজন অখণ্ড ভারতের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে দেওয়া।

[আরও পড়ুন: ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে কম-বেশি হতে পারে করোনা সংক্রমণের মাত্রা, সাড়া ফেলেছে নয়া গবেষণা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ