BREAKING NEWS

১৫ চৈত্র  ১৪২৯  বৃহস্পতিবার ৩০ মার্চ ২০২৩ 

READ IN APP

Advertisement

পথিক হারায়নি পথ, অবশেষে ‘সিরিয়াস’ রাহুল, বদলেছে রাজীব-তনয়ের ভাবমূর্তি

Published by: Sulaya Singha |    Posted: February 3, 2023 2:48 pm|    Updated: February 3, 2023 2:48 pm

Rahul Gandhi becomes mature during Bharat Jodo Yatra, Congress can see ray of hope | Sangbad Pratidin

‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ ভারতকে ‘দেশ’ হিসাবে কতটা ঘনসন্নিবিষ্ট করবে, সময় তার উত্তর দেবে। তবে এই যাত্রা কংগ্রেসকে চনমনে করেছে। বদলেছে রাজীব-তনয়ের ভাবমূর্তি। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নেতারা স্বীকার করছেন অবশেষে রাহুল ‘সিরিয়াস’। হতাশ কংগ্রেসিদের মনে তাঁকে ঘিরে জেগেছে আশার বাতি। ‘ভালবাসার দোকান’-এ রাহুল ভিড় বাড়াতে পারবেন কি না, এখন সেটাই দেখার।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্য়ায়: প্রবল তুষারপাতের মধ্যে ‘শের-ই-কাশ্মীর’ স্টেডিয়ামে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শেষ হওয়ার দিন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নিজের সন্দেহের কথাটি কবুল করেছেন। বলেছেন, ঘোরতর সন্দেহ ছিল এই দীর্ঘ পথ তাঁর দাদা হেঁটে পাড়ি দিতে পারবেন কি না। সংশয় শুধু প্রিয়াঙ্কার মনেই যে দানা বেঁধেছিল তা নয়, বহুজনের মন কু গেয়েছিল, মাঝপথে কোনও অজুহাত দেখিয়ে রাহুল যাত্রা বন্ধ করে দিলে কী হবে, তা ভেবে। কারণ, অনেকের চোখে, বিশেষ করে বিজেপির প্রচারে ও নজরে তখনও তিনি ‘পার্টটাইম পলিটিশিয়ান’। মতিগতির স্থিরতা নেই। ‘নন-সিরিয়াস’, ‘আর্মচেয়ার’ রাজনীতিক এবং ‘পাপ্পু’। কংগ্রেসেরও অনেকের কাছে তিনি ‘চপলমতি’। নিজের খেয়ালে ব্যস্ত। এই আছেন তো এই নেই। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা শেষের মধ্য দিয়ে রাহুল বোঝালেন, তিনি একাগ্র। দৃঢ়চেতা। নিজের খাড়া করা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা সফলভাবে করে বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির এক নতুন আখ্যান তিনি পেশ করেছেন। সেই আখ্যান নরেন্দ্র মোদির দল ও সরকারকে টক্কর দেওয়ার মতো মজবুত কি না, সেটাই পরবর্তী দ্রষ্টব্য। কংগ্রেসের নতুন চ্যালেঞ্জও সেটাই।

পাঁচমাস ধরে চার হাজার কিলোমিটার পথ হাঁটা অবশ্যই চাট্টিখানি কথা নয়। সেই পথচলার মধ্য দিয়ে রাহুল তাঁর সম্পর্কে গড়ে ওঠা অনেক ধারণাও ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেছেন। যেমন, তাঁর সঙ্গ পাওয়া সহজ নয় কিংবা তিনি পরিচিত গণ্ডির বাইরে মেলামেশায় আড়ষ্ট। এই পাঁচমাসে প্রতিদিনই দেখা গিয়েছে, কীভাবে আমজনতার সঙ্গে তিনি মিশেছেন। সবাইকে কাছে টেনে নিয়েছেন। মানুষের কথা শুনেছেন। মানুষের মন বোঝার চেষ্টা করেছেন। বারবার বলেছেন, এই পদযাত্রা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। দেশ ও দশকে আরও ভালভাবে চিনেছেন।

প্রকৃত রাজনীতিককে মানুষের নাড়ি বুঝতে হয়। সেজন্য মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়। দুঃখ, কষ্ট, বেদনা বা অন্যান্য অনুভূতি বোঝার মতো মন তৈরি করতে হয়। ভারতকে জানতে, বুঝতে, তার বৈচিত্রের স্বাদগ্রহণে স্বামী বিবেকানন্দ তাই পদব্রজে দেশ চষেছিলেন। গান্ধীজি মানুষকে নিয়ে মানুষের মধ্যে হেঁটেছেন। এই প্রজন্ম চন্দ্রশেখরের পদযাত্রারও সাক্ষী। রাহুলও হাঁটলেন। সেই হাঁটার মধ্য দিয়ে দেশ, জনগণ, রাজনীতির মারপ্যাঁচ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বাধ্যবাধকতা, মানুষের চাহিদা, মন ও নিজের দলের মানসিকতা বুঝতে চেয়েছেন। কতটা বুঝেছেন, কতটা জেনেছেন, রাজনীতিক হিসাবে কতটা ঋদ্ধ হয়েছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে আগামী দিনে। যাত্রা শেষ হলেও রাজনীতির আতস কাচের নিচে সেই পরীক্ষা তাঁকে দিয়ে যেতেই হবে।

[আরও পড়ুন: আশঙ্কায় কাঁপছে শেয়ার বাজার! আদানিরা ডুবলে বিরাট ধাক্কা খাবে দেশের অর্থনীতি]

শুধু রাহুল নন, কংগ্রেসের সব নেতাই বলেছেন, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-র উদ্দেশ্য দলীয় সংকীর্ণ রাজনীতির উত্তরণ ঘটানো নয়, বরং উদ্দেশ্য বিজেপির নীতি ও আদর্শের বিপরীতে এক পালটা ‘ন্যারেটিভ’ সৃষ্টি করা। সেটা কীরকম, রাহুল নিজেই তা অতি সংক্ষেপে জানিয়ে বলেছেন, ‘ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলেছি’। ঘৃণা, হিংসা, ধর্মীয় ভেদাভেদ ও কট্টর হিন্দুত্ববাদে দেশকে চুবিয়ে আবহমানকালের সহিষ্ণুতা ও বৈচিত্রপূর্ণ একতার ভিত নড়িয়ে ‘নতুন ভারত’ নির্মাণের যে-রথ মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি গড়িয়ে দিয়েছে, রাহুল তার গতি রোধ করতে চাইছেন এই বিকল্প আখ্যান দিয়ে। সেই আখ্যানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে অগুনতি মানুষ, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, ট্রেড ইউনিয়ন, অরাজনৈতিক নাগরিক, মুক্তমনা, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ ও রাজনৈতিক দল রাহুলকে সঙ্গ দিয়েছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বাড়িয়ে তুলেছে পদযাত্রীদের বহর ও পদযাত্রার ব্যাপ্তি। সৃষ্টি করেছে এক অন্য উন্মাদনা। সরকারি নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত অনুগত গণমাধ্যম উপেক্ষা করলেও সামাজিক মাধ্যম তুলে ধরেছে যাত্রার রূপ। যাত্রা যত উত্তরপানে এগিয়েছে ততই মনে পড়েছে মজরু সুলতানপুরীর লেখা সেই অমর শের, ‘ম্যায় আকেলা হি চলা থা জনিব-এ-মঞ্জিল/ মগর লোগ সাথ আতে গ্যয়ে, অউর কারওয়া বনতা গ্যয়া’।

সন্দেহ নেই, এই যাত্রা কংগ্রেসকে চনমনে করেছে। রাহুলেরও ভাবমূর্তি বদলে দিয়েছে। বিজেপি তাঁকে ‘পাপ্পু’ বলা বন্ধ করেছে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নেতারা স্বীকার করছেন, অবশেষে রাহুল ‘সিরিয়াস’। হতাশ কংগ্রেসিদের মনে তাঁকে ঘিরে জ্বলেছে আশার বাতি। বিজেপি-র তিনটি বিষয় নিয়ে আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে।

প্রথমত, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র পর কংগ্রেসের পরবর্তী কর্মসূচি কী এবং তা কেমন সাড়া পায়, দল কতটা উজ্জীবিত হয়। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন রাজ্যে দলীয় কোন্দল মেটাতে কীভাবে তারা সচেষ্ট হয়। কতটা সফল হয়। এবং তৃতীয়ত, বিজেপি-বিরোধী ঐক্য স্থাপন কতটা সম্ভবপর হয়। বিশেষ করে সেই দল, যারা এখনও কোনও না কোনও বাধ্যবাধকতার দরুণ বিজেপিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে অথবা কিছুটা নিরাপদ দূরত্ব থেকে রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিরীক্ষণ করছে। এদের মধ্যে কেউ বিকল্প রাজনৈতিক আখ্যানকে আঁকড়ে ধরে কি না, সেদিকে তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে।

এই তিন সম্ভাবনার সাফল্য-ব্যর্থতার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে চলতি বছরের দশ (জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে) রাজ্যের বিধানসভা ভোটে বিজেপি ও বিরোধীদের লাভ-লোকসানের খতিয়ান। এবং অবশ্যই পরের বছরের লোকসভা ভোটের ভাগ্য। শ্রীনগরে রাহুলের মন্তব্যে স্পষ্ট, আঞ্চলিক দলগুলির রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও বিরোধী জোট গঠন নিয়ে তিনি আশাবাদী। কে জানে, বিজেপির বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ে রাহুল ময়দানে নেমেছেন, তাতে সফল হতে আস্তিনের আড়ালে নতুন কোনও চমক তিনি লুকিয়ে রেখেছেন কি না।

বিজেপির বলিরেখা গাঢ় হয় এমন কোনও কারণ এখনও রাহুলের কংগ্রেস উপস্থাপন করতে পারেনি। তাদের হিসাবে পাঁচমাসের যাত্রায় কংগ্রেস কিছুটা উজ্জীবিত হয়েছে এই যা। নির্দলীয় এবং রাজনীতি সচেতন কিছু মানুষ, যারা নরেন্দ্র মোদির জন্য বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল, তাদের একাংশ নানা কারণে বিরূপ– এটাও বিজেপি মেনে নিচ্ছে। ধরে নিচ্ছে, তাদের সমর্থন হয়তো কংগ্রেস পাবে। কিন্তু বিজেপিকে নিশ্চিত রাখছে দু’টি বিষয়। কংগ্রেসের অন্তর্কলহ, বিশেষত ভোটমুখী দুই বড় রাজ্য কর্ণাটক ও রাজস্থানে। এবং টিডিপি, টিএমসি, টিআরএস, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, বিজেডি, এসপি ও বিএসপি-র মতো দলের ‘একলা চলো’ মনোভাব ও কংগ্রেস নিয়ে অনীহা। কংগ্রেসের হাতে বিরোধী ঐক্যর হাল তুলে দিতে এই দলগুলো কিছুতেই যাতে রাজি না হয়, সেই চেষ্টায় বিজেপিও খামতি রাখছে না। রাজনীতির ধর্মই এমন!

এখনও পর্যন্ত বিজেপির নিশ্চিন্ত থাকার সবচেয়ে বড় কারণ নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা। শাসক হিসাবে এখনও তিনি সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। সমীক্ষার প্রতিফলনেও তা স্পষ্ট। এখনও মোদির মাথা সবার চেয়ে উঁচু। এখনও জনসংখ্যার অর্ধেকের কাছে তিনিই সেরা প্রধানমন্ত্রী। তাঁর উপর আস্থা এখনও অটুট। সমীক্ষা অবশ্য এটাও দেখিয়েছে, রাহুলের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে অনেকটাই। আর দেখিয়েছে, এখনই ভোট হলে বিজেপি জোট পাবে ২৮৪ আসন, কংগ্রেস জোট ১৯১। পাঁচমাস আগে বিরোধী শিবিরের ছবি কিন্তু এতখানি উজ্জ্বল ছিল না।

[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: ১ শতাংশের হাতেই ৪০% সম্পদ, কেন দেশে বাড়ছে বৈষম্য?]

পরবর্তী কর্মসূচি কী হওয়া উচিত, সেই আলোচনা রাহুল ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন। বিকল্প আখ্যানের সার্থকতার জন্য তা জরুরিও। কিন্তু এর পাশাপাশি নিজেদের ঘর সামলানোর দিকেও রাহুলকে মনোযোগী হতে হবে। কর্ণাটকে সিদ্দারামাইয়া-শিবকুমার এবং রাজস্থানে অশোক গেহলট-শচীন পাইলটকে একছাতার তলায় নিয়ে আসতে না পারলে ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে ভালবাসার দোকান খোলা কঠিন। রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের দুর্গ অটুট রেখে কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশ বিজেপির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারলে কংগ্রেসের ভালবাসার দোকানে ভিড় বাড়বে। ২০২৪-এর লড়াইটা সেক্ষেত্রে একপেশে নাও হতে পারে। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-র সাফল্যর পর এটাই কিন্তু রাহুল ও তাঁর দলের নতুন পরীক্ষা।

Sangbad Pratidin News App: খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে লাইক করুন ফেসবুকে ও ফলো করুন টুইটারে