Advertisement
Advertisement

Breaking News

Ukraine

যুদ্ধের মর্মান্তিক ছবি কি যুদ্ধবাজের সিদ্ধান্ত বদলাতে সক্ষম হয়?

আমরা সবাই দাঁড়িয়ে থাকব কোনও স্টেশনে অনিশ্চিত নিরাপত্তার দিকে, স্বজনহারা, স্বপ্নহীন।

Russia-Ukraine war may spell doom for the world | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:March 14, 2022 3:02 pm
  • Updated:March 14, 2022 3:02 pm

এই মুহূর্তে রাশিয়া ও ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সামনে যে বিপর্যয়, তা অনেক বেশি ধ্বংসমুখী। শুধু ইউরোপ কেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে গড়ালে, সারা পৃথিবীই হয়ে যাবে রিফিউজি ক্যাম্প, আমরা সবাই দাঁড়িয়ে থাকব কোনও স্টেশনে অনিশ্চিত নিরাপত্তার দিকে, স্বজনহারা, স্বপ্নহীন, বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকার অভিমুখে। লিখছেন তিলোত্তমা মজুমদার

সে এক যন্ত্রণার ছবি! অথবা বিষাদ ও দুঃখের। সেসব ছবি বিচ্ছেদ-বেদনায় ভারাতুর, যা কারও কাম্য ছিল না। যুদ্ধের মর্মান্তিক সেসব ছবি কি যুদ্ধবাজের সিদ্ধান্ত বদলাতে সক্ষম হয়?

Advertisement

নিরাপত্তার সন্ধানে স্ত্রী ছেড়ে যাচ্ছে স্বামীকে, বাবা-মা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সন্তানের থেকে, এমত অশ্রুময় ছবি প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। ইউক্রেনীয় পুলিশকর্মী তাঁর শিশুসন্তানকে বুকে জড়িয়ে আদর করছেন, স্ত্রী ভেঙে পড়ছেন কান্নায়, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্তানের জীবন রক্ষার্থে স্ত্রী চলে যাবেন অন্য কোনও দেশে। কত আশঙ্কা, কী হৃদয়ভাঙা ব্যাকুলতা! আবার দেখা হবে তো? সন্তানের উষ্ণতা অনুভবের এই শেষ ক্ষণ নয় তো?

Advertisement

[আরও পড়ুন: ভারতীয় রাজনীতির ভাষ্য নতুন করে লিখেছে বিজেপি]

ইউক্রেনের ইরপিন শহরে যেদিন আক্রমণ হানল রাশিয়া, তার পরদিন ‘বিবিসি’ ওই শহরের অসহায় মানুষগুলির যে সংবাদ পরিবেশন করে, তা এক করুণ ইতিহাস। শত-শত মানুষ হেঁটে চলেছে নিরাপত্তার সন্ধানে। নারী, শিশু, বালক-বালিকা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। ঝুঁকে পড়া লাঠিনির্ভর বৃদ্ধার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে একজন তুলনায় কম-বয়স্ক মানুষ। শিশু কোলে মায়েরা, এক হাতে ঠেলছে সংসারের টুকিটাকি সমেত ব্যাগ, সুটকেস, ঠেলাগাড়ি, কোনওটা বাচ্চার খেলনায় ঠাসা, কোনওটা অতি প্রয়োজনীয় কিছু। একাধিক সন্তান যাদের, তারা সকলকে সামলে চলতে নাকাল হয়ে যাচ্ছে। সংসার ছেড়ে আসার যন্ত্রণায় কেউ কাঁদেছে, কেউ সাজানো সুন্দর শহরের ধ্বংস দেখে বিলাপ করছে। মানুষের মধ্যে শুধু ভয়, আতঙ্ক, উদ্বেগ। নিরাপত্তার সন্ধানে যাওয়ার খানিক তাড়া। সব মিলিয়ে শব্দের মধ্যেও এক নিঃসীম নৈঃশব্দ্য। অধিকাংশ নাগরিক ভাষা হারিয়েছে।

একটি মেয়ে, তরুণী এক, ব্যাকপ্যাকে ভরে নিয়েছে সামান্য সম্বল। নিরাপত্তার নিরুদ্দেশ যাত্রায় এই স্বল্পতাই তার সঙ্গী। ইরপিন শহরের উপান্তে, যেখান থেকে নিরাপত্তার সন্ধানে যাত্রার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেখানে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের কাছে বিবৃতি দিচ্ছিল সে অতি দ্রুততায়, ‘আলো নেই। বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস, ইন্টারনেট, কিচ্ছু নেই। তিনদিন এভাবেই ছিলাম। এখনও বহু লোক বাচ্চাদের নিয়ে বেসমেন্টে দিন কাটাচ্ছে।’

এক কৌতুকশিল্পী বলছেন, ‘এই মুহূর্তে আমার কাজ ফুরিয়েছে। আমি তুলে নিয়েছি অন্য কাজ। মিনিবাস চালিয়ে নগরবাসীকে নিয়ে যাচ্ছি নিরাপদ আশ্রয়ে।’

ইরপিনের হাসি স্তব্ধ। ইরপিন কাঁদছে। কিয়েভ নগরের খুব কাছে হওয়ায় ইরপিন দখলের প্রতি পুতিনের আগ্রহ বেশি। ইতোমধ্যে অর্ধেক রুশ সেনার দখলে। বাকি অর্ধেক অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া কথা রাখেনি। ইউক্রেনের ভিতর সাধারণ জনজীবনে আঘাত হেনে দেশটা ধ্বংস করে দিতে চায় তারা। প্রত্যক্ষদর্শী এক সাংবাদিক বলছেন, ইরপিন শহরের অবস্থা দেখে তাঁর মনে হচ্ছিল, তিনি যেন একটি নগরীর মৃত্যু দেখছেন।

ওই সাংবাদিকের মনে পড়ছিল আফগানিস্তানের কথা, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ধ্বস্ত নগরী আলেপ্পোর কথা। প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী বড় বড় সৌধগুলি থেকে বেরিয়ে আসছে আগুন আর ধোঁয়া। আলেপ্পোর মতোই ইরপিন। সারাক্ষণ গোলাগুলির শব্দ। আগুন। মৃত্যু। রক্ত। গোলার আঘাতে শহরের মেয়রের চোখের সামনে উড়ে গেল দুই নারী ও তাদের দু’টি শিশু- যারা শহর ছাড়েনি, প্রতি মুহূর্তে এভাবেই মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। এক নিরাপত্তা সন্ধানী বলছে, সে শহর ছেড়ে যেতে চায়নি। গোলাগুলির শব্দে কেঁপে উঠেছে, ঘুমাতে পারেনি, খেতে পারেনি। সকালে দরজা খুলে দেখে, অনতিদূরে রুশ ট্যাঙ্ক। কিছু পরে শুরু হল গোলাবর্ষণ। ধ্বংস হয়ে গেল আশপাশের কয়েকটি বাড়ি। বিবরণ দিতে দিতে সে বলছে, ‘আমি ভাগ্যবান, এই এখানে দাঁড়িয়ে আছি, কথা বলছি, বড়ই ভাগ্যবান আমি। কিন্তু সৌভাগ্যের আয়ু কতখানি?’

বিগত ১২ বছর ধরে ইউক্রেনের প্রতি রাশিয়ার মনোভাবে প্রকাশ পায়, এই দেশটির প্রতি তার দখলদারি প্রবণতা। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত ইউক্রেনীয় সরকারকে রাশিয়া বলছে ‘নাৎসি-শাসিত’। সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান পুতিনের কথা অনুযায়ী, ইউক্রেনের নির্বিচার রক্তক্ষয় এবং গণনিধন রুখতে তিনি দেশটিকে নাৎসিমুক্ত করতে চান। যদিও ইউক্রেনের ইহুদি রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি ক্ষমতায় আসার পর এই দেশে কোনও গণহত্যা সংঘটিত হয়নি। অর্থাৎ, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মূল কারণ অন্যান্য। সে-দেশের গণতান্ত্রিক সরকার অনেক বেশি স্বাধীনতাকামী, যারা নিজের দেশের বিষয়ে রাশিয়ার মতো অন্য কোনও দেশের হস্তক্ষেপ চায় না। লেনিনের শাসনকালে ইউক্রেনকে বৃহত্তর রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা সহজ হয়নি। সে দেশের বিশাল সংখ্যক জনগণ টানা তিন বছর স্বাধীন ইউক্রেনের স্বপ্ন নিয়ে লেনিনের সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।

জেলেনস্কি সরকারে আসার আগে পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের উপর নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ মনে করছে, রাশিয়া ইউক্রেন ভেঙে দু’-টুকরো করতে চায়। কোনও দেশ দুর্বল করা এবং দীর্ঘকালীন যুদ্ধবিগ্রহ জিইয়ে রাখতে এ এক পন্থা বটে। অনেকের আবার ধারণা, রাশিয়া ফিরে পেতে চায় পুরনো ‘ইউএসএসআর’ (ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক)। সেই উদ্দেশ্যে অধিকার করতে চায় বেলারুশ, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার অঙ্গীভূত ছিল এমন আরও কিছু দেশ।

কিছুকাল মাত্র আগে পুতিন বলেছেন রুশি এবং ইউক্রেনীয়রা এক জাতি। এই এক জাতির কাছে পুতিনের দাবিগুলি খুব অদ্ভুত। যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য, যাকে আবার পুতিন ‘যুদ্ধ’ না বলে আখ্যা দেন ‘সংশোধনের জন্য সৈনিক প্রেরণ’, সেই যুদ্ধ-কিন্তু-যুদ্ধ-নয় বন্ধ করার জন্য ইউক্রেনকে মেনে নিতে হবে ক্রিমিয়া রাশিয়ার অংশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ক্রিমিয়া সম্পূর্ণ অধিকার করতে পারলে জলপথের উপর রাশিয়ার অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে অনেক বাড়িয়ে তোলা যাবে। ইউক্রেনের উপর জবরদস্তি করা যাবে। তাই পুতিনের দ্বিতীয় দাবি, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী অধিকৃত ইউক্রেনের পূর্বভাগকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে হবে। সেই সঙ্গে, ইউক্রেন তার সংবিধান পালটে এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে যে, তারা ‘ন্যাটো’ এবং ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’-এ যোগ দেবে না।

এই আবদারগুলো না মানলে কী হবে? ইতিমধ্যে পুতিনীয় সন্ত্রাস তা প্রদর্শন করেছে। তারা ইউক্রেন ধ্বংস করছে। হত্যা করছে সাধারণ মানুষ। ভেঙে যাচ্ছে সমাজ, পরিবার, অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে শৈশব ও কৈশোরের ভবিষ্যৎ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ভালবাসা, সমাদর ও স্বাধীনতার বাতাবরণে সুন্দর ও সুখী জীবনের অধিকার হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকে ভাবছেন, ইউক্রেন একটি পদক্ষেপ মাত্র। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ স্কল্‌জ বলেছেন, পুতিন সমগ্র ইউরোপের দখল নিতে চান।

রাশিয়ার মদতপুষ্ট পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাকামী গোষ্ঠীর সঙ্গে বিগত প্রায় দশ বছর যাবৎ ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন, রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার লড়াই। সেই লড়াইয়ে ডাক পড়েছে ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সি সংরক্ষিত সৈন্যদের। প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকে যুদ্ধে যাবে কেউ না কেউ। কী হবে তাদের পরিণতি? পরিবারের পরিণতি?

রাশিয়ার সাধারণ জনগণ এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না আদৌ। লক্ষাধিক রাশিয়ান যুদ্ধের বিরোধিতায় দেশ ছেড়েছে, অন্তত সহস্রাধিক প্রতিবাদ মিছিল ও সভা হয়েছে। যুদ্ধবিরোধী রাশিয়ান সংবাদমাধ্যমগুলিকে নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে। যুদ্ধে ব্যাপৃত সন্তানের বৃদ্ধা মা কাঁদছে এই আশঙ্কায়, ছেলে কি ঘরে ফিরতে পারবে আর? যে পরিবারগুলিতে রুশ ও ইউক্রেনীয় মিশ্রণ ঘটেছে, তাদের অবস্থান করুণ ও বিভ্রান্তিকর। এরকমই একজন, ব্রিটেনবাসী রাগবি খেলোয়াড় জ্যাক ওউলেট। তাঁর বৃহত্তর পরিবার পশ্চিম ইউক্রেনে রয়েছে। সেখানে যুদ্ধের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু এ এমন আগুন, যা পৌঁছে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। তাঁর পরিবার ইউক্রেন ত্যাগ করতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, ‘এখানে জন্মেছি, এখানেই মরব।’

যে নাৎসি শাসনের কথা পুতিন ইউক্রেন সম্পর্কে বলছেন, তা আসলে তাঁর ঘরের গল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরও অনেক যুদ্ধ দেখেছে পৃথিবী। দেখেছে ইউএসএসআর ভেঙে যাওয়া, যুগোস্লাভিয়ার ভাঙন, চেকোস্লোভাকিয়ার দ্বিখণ্ডন, দেখেছে কমিউনিস্ট শাসনের পতন, চিনের নিও-কমিউনিজম, যা কিনা ঠিক মাওইজম নয়, ঠিক মার্কসিজম নয়, লেনিনিজমও নয়, বরং কমিউনিজমের আধারে সাম্রাজ্যবাদী ও নাৎসিজিমের ককটেল, দেখেছে অসম্ভব সম্ভব করে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মিলন, দেখেছে ‘ই ইউ’ (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন) থেকে বেরিয়ে আসা ব্রিটেনের ‘ব্রেক্সিট’। কিন্তু এই মুহূর্তে রাশিয়া ও ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সামনে যে বিপর্যয়, তা অনেক বেশি ধ্বংসমুখী। শুধু ইউরোপ কেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে গড়ালে, সারা পৃথিবীই হয়ে যাবে রিফিউজি ক্যাম্প, আমরা সবাই দাঁড়িয়ে থাকব কোনও স্টেশনে অনিশ্চিত নিরাপত্তার দিকে, স্বজনহারা, স্বপ্নহীন, বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকার অভিমুখে।

শোনা যায়, সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পর দয়ানদীতে বয়ে চলা রক্তস্রোতের বীভৎসতায় কাতর হয়ে অহিংসার ব্রত গ্রহণ করেন। চণ্ডাশোক থেকে হয়ে ওঠেন মহামতি। কিন্তু হিংসা থেকে অহিংসার যাত্রাপথে যখন তিনি মানবদরদী হলেন, ততদিনে তাঁর সাম্রাজ্য প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হত্যা, অত্যাচার, নিপীড়ন, লুণ্ঠন, যা কিছু হয় যুদ্ধকালে, সমস্ত সম্পন্ন হয়েছে আক্রান্ত রাজ্যগুলিতে। দয়ানদী দিয়ে জলের মতো রক্ত বয়েছিল, সে কি শুধু উভয়পক্ষের হতাহত সৈনিকের? না কি যুদ্ধ মানুষকে এমন দশায় নিয়ে যায়, যখন জীবিতের অশ্রুও রক্তাক্ত।

[আরও পড়ুন: যুদ্ধের হাতে-গরম ছবি যেন তুলে ধরছে নির্মমতার উৎকট নিদর্শন]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ