Advertisement
Advertisement
Shantiniketan

উৎসবে না কেন?

শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীকে ঘিরে যদি আদিবাসীদের দু’-মুঠো অন্নর ব্যবস্থা হয়, তাহলে আপত্তি কী?

Shantiniketan falling prey to nefarious agenda | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:March 7, 2023 11:21 am
  • Updated:March 7, 2023 11:21 am

রবীন্দ্রনাথ দোলের দিন শান্তিনিকেতনে উৎসব চাইতেন না, এ-কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়। অথচ তাঁর বসন্তোৎসব বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে এমনই ইঙ্গিত করছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীকে ঘিরে যদি পর্যটন ব্যবসা বিকাশলাভ করে ও আদিবাসীদের দু’-মুঠো অন্নর ব্যবস্থা হয়, তাহলে আপত্তি কী? কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী

 

Advertisement

শান্তিনিকেতনের আকাশ এখন চোখে পড়ার মতো নীল। পলাশ গাছের সংখ্যা কমলেও বিরল নয়। রাঙামাটির এই জনপদে যে ফাগুনের হাওয়ায় হাওয়ায় ফুলের আগুন লেগেছে, তা বলা বাহুল্য। ১০০ বছর আগে এরকম একটি বসন্তের দিনে বিদেশ থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির রূপ দেখে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। সেবারই তাঁর দোলের দিন বসন্তোৎসব করার পরিকল্পনা মাথায় আসে। আম্রকুঞ্জে শুরু হয় বসন্তোৎসব- ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকতেই শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। একবার তাই আম্রকুঞ্জ থেকে বসন্তোৎসব সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল কোপাই নদীর কাছে গোয়ালপাড়ায়। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ দোলের দিন শান্তিনিকেতনে উৎসব চাইতেন না, এ-কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়। অথচ তাঁর বসন্তোৎসব বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে এমনই ইঙ্গিত করছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

সাতের দশকে আমার শৈশব কেটেছে এই শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে হোস্টেলের ছাত্র হিসাবে। তখনও আম্রকুঞ্জেই বসন্তোৎসব হত। শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে বলতে পারি, সারা বছরের ওই দিনটিই ছিল সবচেয়ে আনন্দের। শান্তিনিকেতনের বাতাসে তখন রবীন্দ্রনাথের গানের সুর ভাসত। প্রতিটি ঋতুর পরির্বতন আমরা টের পেতাম দু’ভাবে। একদিকে শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিতে বদল আসত। কোন ঋতুতে কোন গাছে কোন ফুল আর ফল আসবে- সেসব আমাদের মুখস্থ থাকত। অন্যদিকে প্রতিটি ঋতুকে আবাহন করত শান্তিনিকেতনের বাতাসের সুর। বসন্তকে সবচেয়ে রাজকীয় কায়দায় জানান দিত শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি। আজও দেয়। আর দোলের কয়েক দিন আগে থেকে নানা রঙের মানুষের পায়ে পায়ে ভরে উঠত শান্তিনিকেতনের পথঘাট। সেটাই ছিল সবচেয়ে আনন্দের। আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম মানুষের ওই ভিড়ের জন্য। তখন শান্তিনিকেতনে হোটেল মাত্র একটা- ‘পৌষালী’। বোলপুরে ট্যুরিস্ট লজ, বোলপুর লজ- এইরকম কয়েকটি হোটেল লজ ছিল। দোলের দিন এত অতিথিকে জায়গা করে দিতে শান্তিনিকেতন ও বোলপুরের বাসিন্দারা আক্ষরিক অর্থেই তাদের দ্বার খুলে দিত। আমাদের হস্টেলেও মেঝেতে, স্টাডি রুমে ঢালাও বিছানা হত। সবার বাড়ির লোক ও অতিথিরা ওই সময় আসত। কিচেনে খাবার ফুরিয়ে যেত। কত মানুষ আম্রকুঞ্জে গাছের নিচে, তিন পাহাড়ের সবুজ উদ্যানে খোলা আকাশের নিচে দোলের আগের রাতটা কাটাত। সূর্যের আলো ফোটার আগে থেকেই তিল ধারণের জায়গা থাকত না আম্রকুঞ্জে। গাছের ডালগুলিতেও জায়গা পাওয়া যেত না।

[আরও পড়ুন: আমাদের বঙ্কিম ভাগ্যবান, ব্রিটিশ লেখক ডালের মতো ছুরি-কাঁচি চলেনি তাঁর লেখায়]

এটাই তো শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের ঐতিহ্য! রবীন্দ্রনাথ তথা গুরুদেবের সময় থেকেই ঠিক এইভাবে শান্তিনিকেতনে দোলের দিনটি উদ্‌যাপিত হয়ে এসেছে। হঠাৎ এর মধ্যে বিদ্যুৎবাবু তাণ্ডব কোথায় খুঁজে পেলেন, তা অতি ক্ষুদ্র একজন প্রাক্তনী হিসাবে আমাকেও ভাবাচ্ছে। উঁচু ক্লাসে উঠে পাঠভবন ছাড়লেও শান্তিনিকেতনের সঙ্গে প্রায় ৫০ বছরের সম্পর্ক অটুট। বছরে অন্তত এই একটা দিন শান্তিনিকেতনে থাকা চাই-ই চাই। আম্রকুঞ্জ থেকে গৌরপ্রাঙ্গণ হয়ে খেলার মাঠ- বসন্তোৎসবের এই কলেবর বৃদ্ধির সাক্ষী আমিও। কখনও তো কোনও তাণ্ডব চোখে পড়েনি! লক্ষ-লক্ষ মানুষের ভিড়ে একটু-আধটু বিশৃঙ্খলা সেই সাতের দশকেও ছিল। আশ্রমের মাঠে বোলপুর হাই স্কুলের সঙ্গে পাঠভবনের ফুটবল ম্যাচেও রক্তারক্তি সংঘর্ষ দেখেছি। কেন্দ্র ও প্রান্তের এই টানাপোড়েন বরং আজ থেকে ৫০ বছর আগে অনেক তীব্র ছিল বলে আমার মনে হয়। আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের বঞ্চনার ক্ষোভ ছিল। বিশ্বভারতীর আলোর তুলনায় পিলসুজের ওই অন্ধকার অনেক বেশি গাঢ় ছিল।

শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক প্রভাব আজ আশ্রমের গণ্ডি ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে বিস্তৃত হয়েছে। তার বড় কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক। প্রান্তিক এলাকাগুলির উন্নয়নের একটা নিজস্ব গতি আছে। যার সঙ্গে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা ও প্রকল্পের যোগসূত্র রয়েছে। এর পাশাপাশি শান্তিনিকেতনকে ঘিরে একটা দ্রুত উন্নয়ন ঘটেছে। যেখানে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জমি-বাড়ির ব্যবসার একটা ভূমিকা রয়েছে। বিদ্যুৎবাবু তাঁর খোলা চিঠিতে যাকে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের সঙ্গে তুলনা করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে দেখলাম। ওঁর এই বক্তব্য খুব অশালীন শুনতে লেগেছে। আজ যদি শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীকে ঘিরে এই এলাকায় এক বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়, পর্যটন ব্যবসা বিকাশলাভ করে, প্রোমোটিং হয়, এই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষ, আদিবাসীদের দু’মুঠো অন্নের ব্যবস্থা হয়, তাহলে আপত্তির কী আছে?

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার কেন্দ্রে তো মানবসমাজের উন্নতির কথাই বলা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তো বিশ্বভারতীকে কোনও এলিট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বানাতে চাননি। বা একটা তপোবন বানানোও তাঁর লক্ষ্য ছিল না। এটা ঠিক যে, আমাদের শৈশবে পাঠভবনে বা বিশ্বভারতীতে বিদেশি ছাত্রের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। তখন আমরা হস্টেলের ছাত্ররা নিজেদের ভিনগ্রহের বাসিন্দা মনে করতাম। সেটা তো রবীন্দ্র শিক্ষাচিন্তার অনুসারী নয়। পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলির আর্থিক উন্নয়ন এবং বিশ্বভারতীর একাংশের শিক্ষক ও কর্মীদের বিভিন্নরকম সাংস্কৃতিক উদ্যোগ গত ৫০ বছরে কেন্দ্র ও প্রান্তের এই দূরত্ব অনেক কমিয়েছে। যা রবীন্দ্র আদর্শের পরিপন্থী নয়।

বস্তুত এখন শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর গণ্ডির বাইরের সাংস্কৃতিক উদ্যোগ বেশি দেখতে পাই। আগে যেটা ছিল না বললেই হয়। শান্তিনিকেতনের এই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বিস্তার লাভ করাটাই তো বিশ্বভারতীর আসল সাফল্য। আইআইটি, আইআইএমের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তো বিশ্বভারতীর লক্ষ্য হতে পারে না। কেরিয়ার-সর্বস্ব ব্যবস্থার বিপ্রতীপে এক ভিন্ন ধরনের শিক্ষার লক্ষ্যেই তো আমাদের অভিভাবক শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন! বিশ্বভারতীর অসংখ্য প্রাক্তনী সেই শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান বছরের পর বছর দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে চলেছে। শান্তিনিকেতন ও তার আশপাশের এলাকায় তার ধারাবাহিক প্রভাব পড়ে চলেছে। বিশ্বভারতীর অবদান কি শুধু ক’জন বিদেশি ছাত্র পড়তে আসছে, তা দিয়ে পরিমাপ করা যায়? এখনও শান্তিনিকেতনে নানা উৎসবে, অনুষ্ঠানে যে লাখ-লাখ মানুষ আসে, তারাও একটা চেতনা নিয়ে ফিরে যায়। সমাজে কি তার অবদান কম?

২০১৮ সালে প্রথমবার যখন দোলের দিন বেলা ১২টার সময় আশ্রম চত্বর ফাঁকা করে দেওয়া হল, তখনই মনে হয়েছিল, বিশ্বভারতীতে কিছু একটা ঘটছে। সংগীত ভবন, কলা ভবন চত্বরে অনেক বেলা পর্যন্ত নাচ-গান-আড্ডাই বরাবরের দস্তুর। হঠাৎই শৃঙ্খলার নামে তাতে বেড়ি পড়ানো হল। ২০২০-তে উৎসবের সব প্রস্তুতি ছিল। লাখো লোকও এসে পড়েছিল। শেষ মুহূর্তে কোভিডের জন্য সব বাতিল। সেটা যে এইরকম একটা চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় চলে যাবে, তা কল্পনাতেও ছিল না। এবার প্রায় ফাঁকা শান্তিনিকেতনে টোটো চালক থেকে ভুবনডাঙার দোকানি, হোটেল ব্যবসায়ী সবার মাথায় হাত! উপরন্তু উপাচার্যের সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে মেরে ফেলার কটাক্ষ!

[আরও পড়ুন: ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ যেন ‘টিকটক ওয়ার’, প্রচারযুদ্ধে মস্কোকে টেক্কা কিয়েভের]

বাগানপাড়ায় প্রতিবেশী প্রবীণ আশ্রমিক স্বপনকুমার ঘোষ আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী বলতে কখনও শুধু ছাত্র ও শিক্ষকদের বুঝতেন না। তিনি বিশ্বভারতীর সব অনুষ্ঠানে এখানকার বাসিন্দাদেরও যুক্ত করতেন। তাঁর ভাবধারায় যারা আকৃষ্ট হয়ে আসত, তাদেরও নিতেন।’ বিদ্যুৎবাবু আশ্রমিক ও প্রাক্তনীদেরও ব্রাত্য করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। শান্তিনিকেতনে দাঁড়িয়ে এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে! কারও কোনও গোপন অ্যাজেন্ডা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য ছাড়া কি এটা সম্ভব? এই প্রশ্নটাই কিন্তু মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ তো রবীন্দ্রনাথকে আঘাত করা ছাড়া কিছু নয়!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ