Advertisement
Advertisement

Breaking News

কিং হতে চাননি, ছিলেন কিংমেকার

ফ্যাকাসে তামিল রাজনীতি।

The journey of M Karunanidhi
Published by: Sayani Sen
  • Posted:August 8, 2018 1:20 pm
  • Updated:August 8, 2018 1:20 pm

তামিলভাষীদের উন্নয়ন আর পিছিয়ে-পড়া সমাজের অগ্রগতিই ছিল এম. করুণানিধির স্বপ্ন। জাতীয় স্তরে কংগ্রেস-বিরোধী ফ্রন্ট হোক বা বিজেপি-বিরোধী ফ্রন্ট, তিনি বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। অান্দোলনে জড়িয়ে বারবার ফেল করেছেন। ‘এলটিটিই’-কে সমর্থন করেছেন। অাবার, এই মানুষটিই ঘটি-বাটি বিক্রি করে নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। তাঁর অবর্তমানে তামিল রাজনীতি পাণ্ডুর ও থ্যালাসেমিক হতে বাধ্য। লিখেছেন শংকর ভট্টাচার্য

২০০৭। গরম কাল। চেন্নাইয়ের গোপালপুরমের বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম সাতসকালেই। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস মুথুভেল করুণানিধির। সাধারণত সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করেন না। আগে থেকে প্রশ্ন লিখে পাঠাতে হয়। সেইসব আনুষ্ঠানিকতা সেরে মুখোমুখি হতে হয়েছিল ‘কলাইনর’-এর। না, তিনি ইংরেজিতে কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিলেন না। এক নেতার সাহায্যে অতিরিক্ত দু’-একটি কথা। তামিল না জানলে পাত্তাই দেন না। বলেছিলাম, অল্প অল্প পড়তে পারি। একটি কাগজ পড়ে শুনিয়েছিলাম। ‘তালাইভা’ খুশি হয়ে চা খাইয়েছিলেন। কিন্তু একটা কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তামিল ছাড়া আর কোনও ভাষায় তিনি কথা বলা পছন্দ করেন না। সেই ভাষা আর দ্রাবিড় সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্যই তাঁর সারা জীবনের সংগ্রাম।

Advertisement
[প্রমাণ কই যে কান্দাহার থেকে আসোনি…]

ছোটবেলা থেকে করুণানিধি এরকমই। চাঁচাছোলা। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করলেও স্কুলে নেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। ক্লাস ফাইভে উঠেছে ছেলেটি গ্রামের স্কুল থেকে। বাবার সঙ্গে তিরুভারু-র শহরে এসেছে। ফিরে যাওয়া কোনওমতেই সম্ভব নয়। তাই মরিয়া চেষ্টা। সোজা হেডমাস্টারের ঘরে ঢুকে গেল সে। দারোয়ানের বাধা না মেনেই। সেই হেডমাস্টারমশাই তো কোনওভাবেই ভরতি করবেন না। রেগে আগুন! কেন বিনা অনুমতিতে ঢুকল সে। ছাত্র অনড়। শেষে বলল, দেখতে পাচ্ছেন স্কুলের সামনে একটা বড় পুকুর আছে। আমি সাঁতার জানি না। ওই পুকুরেই ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হব। আমাকে স্কুলে নিতেই হবে। চললাম। একটু বোধহয় ভয় পেয়েছিলেন সেই হেডমাস্টারমশাই। একরকম বাধ্য হয়েই ভরতি করেছিলেন সেই ছোট্ট মুথুকে। সেই বছর ক্লাস ফাইভে ফার্স্ট হয়েছিল মুথু। পুরো নাম মুথুভেল করুণানিধি। সেই শুরু। তামিল ভাষায় ‘নেনজুক্কু নিধি’  শিরোনামে আত্মজীবনীতে নিজেই লিখেছেন এ কথা। মুথুর বয়স তখন মাত্র ১২। সেই ১৯৩৬ সালের কথা। আসলে, জীবনে কোনও বাধা মানতে চাননি মুথুভেল। অন্যায়ের সঙ্গেও আপস করেননি তামিলনাড়ুর পাঁচবারের মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement
[জাতীয় রাজনীতি ও মেরুকরণের মডেল]

রাজনৈতিক আর ব্যক্তিগত জীবনে বহুবারই তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তাঁর দল ‘ডিএমকে’-র বহু নেতাকেই জেলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তিনি ব্যক্তিজীবনে নিষ্কলুষ থেকেছেন। পুত্র-মিত্র-কলত্র নিয়ে বড় সংসার চালিয়েছেন। বলতেন, আমার দলটাই আমার পরিবার। তাই পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ ধোপে টিকত না পার্টির সমর্থকদের কাছে। তাঁদের কাছে তিনি তামিল সমাজের পিতৃসম।তিনটে বিয়ে। গোল বেঁধেছিল তৃতীয় বিয়ে নিয়ে। ১৯৬৮-তে তিনি পরিবহণমন্ত্রী। মাদ্রাজের এক হাসপাতালে এক মহিলার মেয়ের পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ওই মহিলা বলেন, মেয়ের বাবার নাম এম করুণানিধি। হইচই পড়ে যায়। রজথি নামে ওই মহিলা কে? বিধানসভায় প্রশ্ন তোলে কংগ্রেস। তখন আচমকাই ভরা বিধানসভায় দাঁড়িয়ে করুণানিধি বলেন, ‘এন মগল কানিমোঝি তাইয়ার’ বা ‘আমার মেয়ে কানিমোঝির মা উনি।’ তারপর আর কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। সিআইটি রোডের বাড়িতে তৃতীয় স্ত্রী রজথি আম্মাল আর মেয়ে কানিমোঝি থাকতেন। আর গোপালপুরমের বাড়িতে দ্বিতীয় স্ত্রী দয়ালু আম্মাল আর পুত্র স্তালিন-সহ অন্যরা। কোনও বিবাদ ছিল না। বিয়ের তিন বছরের মাথায় ১৯৪৮ সালে তাঁর প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন।

[অসমে ৪০ লক্ষ বাঙালির এখন ডিটেনশন ক্যাম্পের আতঙ্ক]

তামিলনাড়ুতে থেকেই তিনি বহু সময়ে জাতীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। কংগ্রেস বিরোধী জাতীয় স্তরের ফ্রন্ট তৈরি করেছিলেন নিজের উদ্যোগে। ১৯৮৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাজের ময়দানে সেদিন হাজির হয়েছিলেন এনটি রামারাও,  ভিপি সিং, চন্দ্রশেখর, ইন্দ্রকুমার গুজরাল ও সুরজিৎ সিং বারনালা-সহ অন্যরা। আরও একটু এগিয়ে আসা যাক। ২০১৭ সালের ৩ জুন। চেন্নাইয়ে তৈরি হল ‘ফেডারেল ফ্রন্ট’। সেই একইভাবে এবারও কেন্দ্রের বিজেপি বিরোধী ফ্রন্ট গড়ার ক্ষেত্রেও অগ্রগামী ভূমিকা নিলেন করুণানিধি। যদিও তখন তিনি শয্যাশায়ী। উদ্যোক্তা তাঁর ছোট ছেলে স্তালিন। রাহুল গান্ধী, নীতীশ কুমার, ডেরেক ও’ব্রায়েন, ওমর আবদুল্লা, সীতারাম ইয়েচুরি ও ডি রাজা-সহ সব বিরোধী নেতা একত্র হয়েছিলেন। কিন্তু নিজে তিনি কোনও দিনই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে থাকেননি। বলা হত, তিনি হচ্ছেন জাতীয় স্তরের ‘কিং মেকার’। কিং হতে চান না। শুধু একটাই দাবি তাঁর, তামিলভাষীদের উন্নয়ন আর পিছিয়ে পড়া সমাজের অগ্রগতি। তাই ‘মণ্ডল কমিশন’-কে সমর্থন, তাই ‘এলটিটিই’-র পাশে দাঁড়ানো।

[দেশে প্রতি ঘণ্টায় ৮টি শিশু নিখোঁজ হয়]

নিজে পিছিয়ে পড়া সমাজেরই প্রতিনিধি ছিলেন। জন্মসূত্রে ইসাই ভেলাল্লার। বিয়ে বা শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান গাইতেন তাঁর পূর্বজরা। কখনও দুঃখের, কখনও বা আনন্দের। আর তাই নির্বাচনে হার বা জিত,  কোনও অবস্থাতেই তিনি ভেঙে পড়েননি। বৃহত্তর তাঞ্জোর বা তাঞ্জাভুর জেলায় জন্ম তাঁর। এখন ভাগ হয়ে হয়েছে তিরুভারুর। কাবেরী উপত্যকার সবথেকে উর্বর ভূমি। সম্পন্ন এলাকা। কিন্তু তাঁদের পরিবারের হাতে সম্পদ তেমন ছিল না। উচ্চবর্ণের মানুষের সামনে গায়ে জামা চড়াতে পারতেন না। খালি গায়ে শুধু ধুতি। পায়ে জুতো পরাও ছিল ‘অপরাধ’। ছোটবেলা থেকেই এই চরম অত্যাচার দেখে তাঁর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। ক্লাস ফাইভে যে প্রধানশিক্ষক তাঁকে স্কুলে ভরতি করতে চাননি, তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। নাম কস্তুরী আয়েঙ্গার। তাই অল্প বয়সেই পেরিয়ার আর তাঁর সুযোগ্য শিষ্য আন্নাদুরাইয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তখন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী বা রাজাজি মাদ্রাজ প্রদেশের প্রিমিয়ার বা আজকের মুখ্যমন্ত্রী। স্কুলে হিন্দি বাধ্যতামূলক করে দিলেন। ব্যস, প্রদেশ জুড়ে শুরু হয়েছিল প্রতিবাদ। শামিল হয়ে গেলেন মুথুও। ১৯৩৮ সালে স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে রিকশায় চড়ে প্রতিবাদ। শুরু করলেন লেখালিখি। ১৯৪২ সালে সিএন আন্নাদুরাই শুরু করলেন ‘দ্রাবিড়নাড়ু’  নামে পত্রিকা। মূল বক্তব্য, দ্রাবিড়দের জন্য চাই পৃথক রাষ্ট্র। ঠিকানা ছিল না। কিশোর মুথুভেল একটি লেখা লিখে পোস্ট করে দিলেন, ঠিকানায় কী লিখবেন? পাঠালেন শুধুমাত্র ‘দ্রাবিড়নাড়ু, কাঞ্চিপুরম’ লিখেই। তা পৌঁছেও গিয়েছিল। ছাপা হল ‘ইলমাই বলি’ বা ‘বলিপ্রদত্ত যৌবন’ শিরোনামে। লেখা পড়ে মুগ্ধ আন্নাদুরাই। দুই সপ্তাহ পরে তিরুভারুরে একটি অনুষ্ঠানে এসে খোঁজ করলেন, এখানে মুথুভেল নামে এক লেখক কোথায় থাকেন? লোকের মুখে শুনে চলে এলেন মুথু। তাঁকে দেখে কিন্তু মোটেই খুশি হতে পারলেন না আন্নাদুরাই। এত ছোট বয়সে কেন এসব করছ! আগে লেখাপড়া শেষ করো। তারপর রাজনীতি আর লেখালিখি। গুরু আন্নাদুরাইয়ের এই একটি কথা কিন্তু মানতে পারেননি করুণানিধি। একের পর এক আন্দোলনে জড়িয়ে পরপর তিনবার ফেল। লেখাপড়া ছেড়ে দিলেন। কিন্তু লেখালেখি আরও বেড়ে গেল। দ্রাবিড় আন্দোলনে শরিক হয়ে একের পর এক নাটক লিখতে শুরু করলেন। ঘরের জিনিসপত্র বেচে দিয়ে সেই নাটক গ্রামে গ্রামে মঞ্চস্থ করলেন।

[আমরা-ওরা পিছিয়ে পড়া]

আন্নাদুরাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় তখন। ‘ডিএমকে’ তৈরি হওয়ার পর থেকেই তিনি দলে দুই নম্বরে। গুরু-শিষ্যের এই পরম্পরায় আন্নার মৃত্যুর পরে তিনিই হলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সেই ১৯৬৭ সালে। ব্যস! টানা পঞ্চাশ বছর দলের সভাপতি। ৮০ বছরের রাজনৈতিক জীবন। কথা বলা বন্ধ ২০১৬ থেকে। গলায় যন্ত্র বসানো হয়েছে। স্পিচ থেরাপিতে আসা চিকিৎসকের কাছে তাঁর একটাই প্রশ্ন ছিল: কবে আবার জনসভায় দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতে পারব? হার না মানা এই মানুষটি চলে যাওয়ার পর এককথায় ফ্যাকাসে হয়ে গেল তামিল রাজনীতি।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ