Advertisement
Advertisement

Breaking News

Election

দিবারাত্রির ভোটকাব্য

দ্বিতীয়বার বিজেপি সরকার গড়লে মোদি-শাহর পাশে আসন পেতে বসে পড়বেন যোগী।

The rise of Kejriwal and Yogi Adityanath this polling season | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:February 17, 2022 2:42 pm
  • Updated:February 17, 2022 9:59 pm

উত্তরপ্রদেশের ভোট অনেকগুলি আপেক্ষিক আগ্রহ ও সম্ভাবনার জন্ম দিচ্ছে। সম্ভাবনার একটা যদি হয় প্রথম বড় চ্যালেঞ্জার হিসাবে কেজরিওয়ালের উঠে আসা, তবে অন্যতম আগ্রহ হবেন যোগী আদিত্যনাথ। দ্বিতীয়বার বিজেপি সরকার গড়লে মোদি-শাহর পাশে আসন পেতে বসে পড়বেন যোগী। দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণ তখন কেমন হবে? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

দেখতে দেখতে উত্তরপ্রদেশের ১১৩ আসনের রায় ইভিএম বন্দি হয়ে গেল। শেষ হল উত্তরাখণ্ড ও গোয়ার ভোটও। ‘পাঞ্জাবি’ সাসপেন্স কংগ্রেসের ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে। বাতাসে ভাসছে রাজনৈতিক দ্বেষ ও ঘৃণার বিষ। শাসক দলীয় ‘হিন্দুত্ববাদী’ নেতাদের বিষোদ্‌গার মাত্রাছাড়া। হিন্দু ধর্মে হিংসা ও ঘৃণা যে এমন অতলস্পর্শী জানা ছিল না। হলাহলের তীব্র জ্বালায় মহাদেব নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন। এখন নীলে নীল সমাজ। নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ডহীনতা নিত্য প্রমাণ করছে ইদানীং তারা কতটা নির্বিষ। নেতাদের কাণ্ডজ্ঞান কতখানি লোপ পায় ভোটের সময়, অবুঝও তা বুঝতে পারে। এভাবেই ৭৫ বছরের ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র!

Advertisement

এত কিছু ‘নেতি’ সত্ত্বেও ‘ইতি’ এটাই যে, এই উপমহাদেশে এখনও ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত। সে কৃতিত্বের মূল দাবিদার যতটা ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ততটাই এ দেশের মানুষ। মানুষ চায়, তাই এখনও শাসকের রং বদলে বদলে যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কল্পনাতীত। এই স্বস্তির মাঝেই এসে যাবে ১০ মার্চ। সেদিন বোঝা যাবে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ভাগ্য কার কীরকম। কিন্তু ততদিন উত্তপ্ত আলোচনা চলতেই থাকবে উত্তরপ্রদেশ নিয়ে। এই রাজ্যের ফল শুধু আগামী দিনের শাসক সম্পর্কিত চরিত্রের ইঙ্গিতবাহীই নয়, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকেও করে তুলতে পারে জমকালো। উত্তেজনার খই তাই ফুটেই চলেছে।

Advertisement

[আরও পড়ুন: সুভাষচন্দ্র বসু কি নাৎসিদের সমর্থক ছিলেন?]

উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব ও গোয়াও কম নয়। এই চার রাজ্য বুঝিয়ে দেবে ১০ মার্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিবারাত্রির কাব্য নিশ্চিন্তে ও নির্ভাবনায় লেখা যাবে কি না। ভোটের সম্ভাব্য রায় ঘিরে এই অনিশ্চয়তা বছরখানেক আগেও কিন্তু সেভাবে আঁচড় কাটেনি। জাতীয় পর্যায়ে তো অবশ্যই, আঞ্চলিক স্তরেও ছিল নানা জিজ্ঞাসা। নানা সংশয়। সেই অর্থে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ যদি ধরতেই হয় তবে নিশ্চিতভাবেই তা দিল্লি সীমান্তে কৃষক বিক্ষোভ। প্রধানমন্ত্রী যতই সাফাই গান, যতই বলুন ‘যা করেছিলাম কৃষকদের মঙ্গলের জন্য’, সিদ্ধান্ত যে হঠকারী ছিল তিনি নিজেই তার প্রমাণ। না হলে এভাবে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতেন না। কিল খেয়ে কিল হজমে তাঁকে অবশ্যই কিছুটা বাধ্য করেছিল পশ্চিমবঙ্গে সপার্ষদ বেইজ্জত হওয়ার উপাখ্যান। বঙ্গ-অহমিকার দাপটে মাথা নুইয়ে তিনি এই সত্যই প্রমাণ করেছিলেন যে, চূর্ণ হওয়াই দর্পের ধর্ম। বিজেপি যে অজেয় নয়, সেই বার্তা গত মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এবারের ভোটে গরিমার ফানুস চুপসে গেলে আরও একবার প্রমাণিত হবে পরিবর্তনই একমাত্র চিরন্তন। সেই জল্পনা এখন থাক! এই অবসরে বরং ভাবা যাক, চালে বেচাল হলে কী কী হতে পারে।

উত্তরাখণ্ড, গোয়া ও পাঞ্জাবে এই প্রথম বড় চ্যালেঞ্জার হিসাবে উঠে আসার সম্ভাবনা প্রবলভাবে জাগিয়েছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আন্না হাজারের ছত্রছায়ায় লালিত হলেও প্রবীণ গান্ধীবাদীর মতো নিষ্কাম কর্মযোগী তিনি নন। মনে পড়ছে, আন্নার সঙ্গে তর্কে শামিল হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সিস্টেম বদলাতে হলে সিস্টেমের ভিতরে ঢুকতে হবে। বাইরে থেকে লাভ নেই।’ সেদিন তিনি ‘উচ্চাভিলাষী’ বলে চিহ্নিত হয়েছিলেন। তাতে তাঁর কিছু যায়-আসেনি। বন্ধুহারা হয়েছেন, কিন্তু সঙ্গীহারা হননি। সাত বছরের যাপিত রাজনৈতিক জীবনে উত্তরাখণ্ড, গোয়া ও পাঞ্জাবে শাসকের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন। তিন রাজ্যেই প্রবলভাবে উঠে এসে তাঁর দল শেষ পর্যন্ত যদি সরকার গঠনের ভারসাম্যের খেলায় অনুঘটক হতে পারে, তাহলে বলতেই হবে আম আদমি পার্টি-র ডালপালা ছড়ানোর দিন শুরু হল। তা হবে কি হবে না পরের কথা, কিন্তু জল্পনার আঙিনা থেকে কেজরিওয়ালের দলকে সরানো যাচ্ছে না। এটা যদি কেজরিওয়ালের সাফল্য হয়ে থাকে তবে নিশ্চিতভাবেই মোদির ব্যর্থতা কংগ্রেসকে সমূলে উৎপাটিত করতে না-পারা।

ক্ষমতায় আসা ইস্তক মোদি ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ গড়তে প্রাণপাত করছেন। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এ-দেশে কংগ্রেসই একমাত্র দল যা ফিনিক্স পাখির সঙ্গে তুলনীয়- যাকে তিনি এখনও ডরান। তা যদি না হবে, তাহলে একটা দিনও তিনি কেন কংগ্রেসকে গালি না দিয়ে অতিবাহিত করেন না? এই সেদিন লোকসভা ও রাজ্যসভায় যে-ভাষণ তিনি দিলেন, তারও সিংহভাগ জুড়ে শুধুই কংগ্রেস ও গান্ধী পরিবার। এবং তা করতে গিয়ে ভাষাজ্ঞান ও ইতিহাসবিস্মৃত হয়ে টেনে আনলেন জওহরলাল নেহরুকেও। বারবার নিজের ও দলের সমালোচনার জবাব দিতে যিনি নেহরু-গান্ধী পরিবারকে বর্ম হিসাবে ব্যবহার করেন তাঁর বোঝা উচিত, এই কৃতকর্ম হীনবল ও ক্ষীয়মান কংগ্রেসের প্রাসঙ্গিকতাই প্রতিষ্ঠা করে। এটা ঠিক, নিজের পায়ে কুড়ুল মারার মতো ওস্তাদি কংগ্রেস ছাড়া আর কেউ দেখাতে পারে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর আচরণে স্পষ্ট উত্তরাখণ্ড, গোয়া ও পাঞ্জাবে কংগ্রেসের প্রাণ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা তাঁর কাছে অশনি সংকেতের ন্যায়। কারণ, তিনি বিলক্ষণ জানেন, কংগ্রেসের গোকুলে বৃদ্ধি হতে পারে তাঁরই সর্বনাশের কারণ। সেই সর্বনাশ তাঁর সম্ভাব্য ললাটলিখন হলেও এখনও ঢের সময় বাকি। ততদিনে রাজনীতিতে বহু জল বহু ঢালে গড়াবে। কিন্তু চার রাজ্যের ফল যদি খারাপ হয়, উত্তরপ্রদেশে শতাধিক আসন হারিয়েও যোগী যদি সরকার গড়েন (যে সম্ভাবনা প্রবল), তা হলেও সংক্রান্তি মোদির শিয়রে।

এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে রাজ্যসভায় খালি হচ্ছে মোট ৭৫টি আসন। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশে ১১, পাঞ্জাবে ৭ ও উত্তরাখণ্ডে খালি হবে একটি আসন। অর্থাৎ, মোট ১৯টি। বাকি আসন ভরাবে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, বিহার, কেরল, কর্নাটক, ওড়িশা, অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, ত্রিপুরা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও হিমাচলপ্রদেশ। এগুলো অধিকাংশই বিরোধী রাজ্য। ফলে, রাজ্যসভায় বিজেপির আসন বাড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এবারের ভোটের ফল খারাপ হলে হাল আরও শোচনীয় হতে বাধ্য।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন জুলাই মাসে। রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করেন লোকসভা, রাজ্যসভা ও বিধানসভার সদস্যরা। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে রামনাথ কোবিন্দকে নির্বাচিত করেছিলেন ৪ হাজার ৯৮৬ জন সাংসদ ও বিধায়ক। তাঁদের সম্মিলিত ভোটের মূল্য ছিল ১০ লক্ষ ৯৮ হাজার ৯০৩। মাথাপিছু ভোটমূল্য নির্ধারিত হয় রাজ্যের সাংসদ-বিধায়ক সংখ্যা ও ১৯৭১ সালের গণনা অনুযায়ী জনসংখ্যার ভিত্তিতে। এই নিরিখে সবচেয়ে বেশি ভোটমূল্য উত্তরপ্রদেশের। তারপর মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, তামিলনাড়ু। মনে রাখতে হবে, কোবিন্দ পেয়েছিলেন মোট ৭ লক্ষ ২৪৪ ভোট (৬৫.৬৫ শতাংশ), বিপরীতে মীরা কুমার পেয়েছিলেন ৩ লক্ষ ৬৭ হাজার ৩১৪ (৩৪.৩৫ শতাংশ)। ১৯৬৯ সালে ভি. ভি. গিরি সবচেয়ে কম ভোট (৪৮%) পেয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। রামনাথ কোবিন্দের প্রাপ্তি দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। চার রাজ্যের ভোটের ফল বিরোধীদের জোটবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করলে প্রধানমন্ত্রীকে পছন্দের রাষ্ট্রপতি বাছতে বাড়তি কসরত করতে হবে। কাজটা কিন্তু সহজ নয়।

উত্তরপ্রদেশের ভোট অন্য এক আগ্রহেরও জন্ম দিচ্ছে। রাজ্য হাতছাড়া হলে কত কীই-না ঘটবে! কিন্তু উপর্যুপরি দ্বিতীয়বার বিজেপি সরকার গড়লে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহর পাশে আসন পেতে বসে পড়বেন যোগী আদিত্যনাথ। তখন তাঁর প্রভাব, প্রতিপত্তি, অবস্থান ও অধিষ্ঠানের দরুন দলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণ কেমন হবে আগ্রহ তা নিয়েই। যোগীর উত্থান বিজেপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কতটা আন্দোলিত করবে সেটাই হবে ভোট-পরবর্তী দ্রষ্টব্য। সবাই জানেন, পাঁচ বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যোগী মোটেই মোদি—শাহর প্রথম পছন্দ ছিলেন না। এ-ও জানা, যোগী কতটা উচ্চাশী।

[আরও পড়ুন: জাতের যাতনা ও ‘উলটাপ্রদেশ’]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ