Advertisement
Advertisement
Rabindranath Bhattacharjee

সম্পাদকীয়: মাস্টারমশাই, আপনিও?

রাজনীতি মানে কি শুধুই ‘ভোটের টিকিট’?

TMC dissident Rabindranath Bhattacharjee joining BJP shows the other side of politics | Sangbad Pratidin
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:March 10, 2021 1:49 pm
  • Updated:March 10, 2021 1:49 pm

কিংশুক প্রামাণিক: তাহলে কি যাঁরা টিকিট পেলেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ প্রার্থীপদ না পেলে বিজেপিতে চলে যেতেন? নীতি-আদর্শের কথা থাক। সেসবের বারোটা বহুদিন আগে বেজেছে। ন্যূনতম মূল্যবোধও কি হারিয়ে ফেলছেন রাজনীতিবিদরা? রাজনীতি মানে কি শুধুই ‘ভোটের টিকিট’?

[আরও পড়ুন: বাংলার ছিনিয়ে নেওয়া সম্পদ কি ফেরাতে পারবেন মোদি?]

ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাস অথবা বাঁকুড়ার শম্পা দরিপার কথা বাদ দিলাম। দীপেন্দু নবীন, শম্পাদেবীর সঙ্গেও তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতা খুব গভীর নয়। বরং রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, জটু লাহিড়ী, সোনালি গুহ, শীতল সর্দাররা দীর্ঘদিন তৃণমূলে রয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া টিকিটে ২০০১ সাল থেকে বিধায়ক। তাঁদের যে বিরাট কিছু দাবি আছে, কখনও মনে হয়নি। কখনও এমন কিছু করেননি যাতে মনে হতে পারে, তৃণমূলে তাঁরা অতৃপ্ত। দুই মন্ত্রীর দলবদলের সময়ও তৃণমূল বিধায়কদের গেরুয়াকরণের যে-তালিকা শোনা যাচ্ছিল তাতেও তাঁদের নাম ছিল না।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথবাবু সিঙ্গুর আন্দোলনের নেতা। তাঁকে বিরাট শ্রদ্ধা করতেন মুখ্যমন্ত্রী। ২০১১ সালে সিঙ্গুর থেকে জেতার পর মমতা তাঁকে মন্ত্রী করেন। শিবপুরের বিধায়ক জটুবাবু দীর্ঘদিনের গান্ধীবাদী রাজনীতিক। নির্বিবাদী ভদ্রলোক। আর সোনালি গুহর কথা যতটা লিখতে পারি তার চেয়ে বেশি জানেন রাজ্যের মানুষ। একসময় সোনালি দেবীই ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর সর্বক্ষণের সঙ্গী, স্নেহধন্য। মমতা তাঁকে ডেপুটি স্পিকার করেছিলেন।

Advertisement

এমন ঘরের নেতা-নেত্রীরা রাতারাতি তৃণমূল থেকে বিজেপিতে চলে যাবেন কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। সম্ভবত, তাঁরাও নয়। কিন্তু টিকিট বড় বালাই! দুই প্রবীণ নেতা ও মহিলা নেত্রী সোনালি প্রমাণ করলেন দলের প্রতি আনুগত্য আসল কথা নয়, লক্ষ্য ভোটের টিকিট। নীতিফিতি ফালতু। এরপর মনে হয়, দলবদল যে কেউ করতে পারেন। গান্ধী বনাম গডসের লড়াই আসলে ‘কথার কথা’। নীতি হল: যখন যেমন তখন তেমন! টিকিট না-পেয়ে বিক্ষুব্ধ হওয়া অ-বাম দলগুলিতে পরিচিত ছবি। আগে এসব ক্ষেত্রে ক্ষুব্ধ নেতা ‘নির্দল’ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন। তলে তলে বিরোধিতা করতেন। দলের মধ্যেও ক্ষোভ মেটানোর প্রক্রিয়া ছিল। এখন সোজা উল্টোদিকে ঝাঁপ। মানুষ কী ভাবল, বয়েই গিয়েছে।

বিজেপি তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে জটুবাবুদের নিল। এখন প্রশ্ন, পুনর্বাসন প্রক্রিয়া কি টিকিট দিয়েও সম্পন্ন হবে? যাঁরা আগে গিয়েছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে টিকিট দিতে গিয়ে আদি-নব্য অশান্তিতে গেরুয়া শিবির জেরবার। এবার নতুন করে পাঁচজন দিলীপবাবুদের ঘাড়ে চাপল।

পরের ধাপগুলিতে কারা কারা প্রার্থী হতে চান বিধানসভা আসন ধরে নামের তালিকা বিজেপিতে রেডি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রিন সিগন্যাল দেবে। সেক্ষেত্রে উড়ে এসে জুড়ে বসাদের কি নিজ কেন্দ্রে টিকিট দিতে পারবে বিজেপি? টিকিট না পেয়েই তাঁরা দল ছেড়েছেন। অচেনা পদ্মবনে গিয়েছেন নিশ্চয়ই টিকিট পেতেই। সেখানে টিকিট না পেলে কোথায় যাবেন? নিজের আসনে পদ্ম প্রার্থীকে জেতাতে আদাজল খেয়ে নিশ্চয়ই নামবেন না!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল যতটা ভাঙার হুমকি বিজেপি নেতারা দিয়েছিলেন, ততটা কিন্তু সম্ভব হয়নি। দুই মন্ত্রীর সঙ্গে কয়েকজন বিধায়ক বিজেপিতে গিয়েছিলেন। সাংসদদের মধ্যেও যে ভাঙনের বার্তা ছিল, তা-ও হয়নি। ঝড় থেমেই গিয়েছিল। সেক্ষেত্রে মনে করাই গিয়েছিল, প্রার্থীতালিকা প্রকাশের পর ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ আসতে পারে। হলও তাই। পাঁচ মন্ত্রী ও ২৮ বিধায়ককে মমতা টিকিট দেননি। তাদের মধ্যে পাঁচজন বিজেপিতে গেলেন। এই দৌড়ে সবাই আছে, এমন নয়। কারণ, সবার অ্যাজেন্ডা এক নয়। ভোটের টিকিট চাওয়া গণতন্ত্রে অন্যায় নয়। সেজন্য তৃণমূল ভবনে বিশাল একটি বক্স রাখা হয়েছিল। তাতে হাজার হাজার আবেদন পড়ে। সব স্ক্রুটিনি হয়। এমনকী, বিধানসভায় গিয়ে গিয়ে রীতিমতো মানুষের মধ্যে সমীক্ষা করে তৃণমূলের টিম। তাদের একটাই প্রশ্ন ছিল, আপনার এলাকায় কাকে প্রার্থী হিসাবে দেখতে চান। জেলা-নেতাদের তালিকা, দলের সমীক্ষা এবং সর্বোপরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত- সব মিলিয়ে গ্রহণযোগ্য মুখকেই এবার প্রার্থী করার চেষ্টা করা হয়েছে।

মমতা যেহেতু সারা বছর জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ান, সেই জন্য সব খবর তিনি রাখেন। এলাকায় কারা কারা দলের মুখ হতে পারেন, তা নখদর্পণে। ফলে প্রার্থীতালিকায় ফাইনাল টাচ দিয়েছেন তিনিই। একটা সিদ্ধান্ত এবার ছিল, অশীতিপর কাউকে প্রার্থী করা হবে না। সেই প্রেক্ষিতেই বাদ পড়েন সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই, শিবপুরের জটুবাবুরা। কিন্তু তাঁদের এখনও ভোটে দাঁড়ানোর শখ। সোনালিদেবীর বাদ পড়ার কারণ শুধুই ‘হাই সুগার’, না কি অন্য কিছু, তা তৃণমূল নেতৃত্ব বলতে পারবে। কিন্তু নেত্রীর বৃত্তের বাইরে তিনি অনেক দিন আগেই চলে গিয়েছিলেন। শুধু সোনালি নয়, মমতা এবার কলকাতার দুই বিধায়ক মালা সাহা, স্মিতা বক্সীর মতো বিশ্বস্ত সহকর্মীকেও টিকিট দেননি। এমনকী, এলাকা বিরূপ বলে টিকিট পাননি অভিনেত্রী দেবশ্রীও। বাদ পড়েছেন চাকদহের মন্ত্রী রত্না। বোঝা যাচ্ছে, কঠিন যুদ্ধ জিততে কঠোর হতে হয়েছে মমতাকে।

এবারে তৃণমূলের তালিকা কেমন? কেউ কেউ বলছেন, এত ‘ফিল্মস্টার’ কেন? ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, মহিলা, তফসিলি ও আদিবাসী ভোটব্যাংককে এবার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন মমতা। ৭৯ তফসিলি প্রার্থী। যা সংরক্ষিত আসনের চেয়েও অনেক বেশি। মহিলা প্রার্থী ৫০। কোনও রাজনৈতিক দলই এত মহিলা প্রার্থী দিতে পারবে বলে মনে হয় না।

তৃণমূল স্লোগান দিয়েছে, ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’। এই স্লোগানও খুব সচতুর। একদিকে যেমন দলনেত্রীকে নির্বিকল্পভাবে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তেমনই মহিলা ক্ষমতায়নে মহিলা তত্ত্ব সামনে এসে যাচ্ছে। লক্ষ করার বিষয়, মমতা ইতিমধ্যেই বলেছেন, এখন দেশের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী একমাত্র তিনিই। তাঁকেও বিজেপি উৎখাত করার চেষ্টা করছে। এবারের প্রচারে ‘বাংলার মেয়ে’ প্রচার খুবই উর্বর মস্তিষ্কের ফসল।

স্বভাবত মমতাকে যেমন নানা কারণে পুরনো বিধায়কদের বাদ দিতে হয়েছে, তেমনই নিয়ে আসতে হয়েছে নতুন মুখ। তৃণমূলের তালিকা খুব ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, বিতর্কিত মুখ যথাসম্ভব ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। একটা ঘটনা দিয়ে লেখা শেষ করি।

২০০৭ সাল। তখন সিঙ্গুর আন্দোলন তুঙ্গে। বিধানসভায় বিরোধী দলনেতার ঘরে রোজ দুপুর থেকে আমরা পলিটিক্যাল রিপোর্টাররা আড্ডা দিতাম। তৃণমূল তখন মাত্র ২৯। সেই আড্ডায় মধ্যমণি ছিলেন সৌগত রায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, সোনালি গুহ, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, অর্জুন সিংরা। আসতেন সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথবাবু। সজ্জন মানুষ। কোণের দিকে একটা চেয়ারে বসতেন। কথাবার্তা, আচার-আচরণে বোঝা যেত মানুষটা কতটা সৎ ও নির্ভীক। একদিন তুমুল আড্ডা চলছে। আজ আর নাম লিখছি না, এক তৃণমূল বিধায়ক, এখন বিজেপি নেতা, খানিকটা ঠাট্টা করেই বললেন, ‘কী করছেন মাস্টারমশাই! এত বড় সুযোগ। টাটাদের সঙ্গে কথা বলে বসে যান। কী হবে আন্দোলন করে? ইস, আমার এলাকায় যদি কৃষিজমি থাকত।’ হাসির রোল উঠল। কিন্তু কথাটা শোনামাত্র চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথবাবুর। সোজা হয়ে বসলেন। গমগমে গলায় বললেন, “আমি গরিব মাস্টার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল করি। ডাল-ভাত খেয়ে থাকব, তবু কোনও দিন আদর্শ বিকাব না।’ ওই বিধায়ক একেবারেই তামাশা করে বলেছিলেন। তিনিও চুপ করে গেলেন সিঙ্গুরের বিধায়কের গম্ভীর মুখ দেখে। সেদিন বুঝেছিলাম মানুষটার তেজ! নারী দিবসের বিকেলে টিভিতে তাঁর হাতে গেরুয়া পতাকা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। অস্ফুটে মনে হয় বললাম: মাস্টারমশাই, আপনিও?

[আরও পড়ুন: আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে জোট বামেদের ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ