Advertisement
Advertisement
Wedding of Indira Gandhi

একটি বিয়ে, রাজনীতি ও ধর্ম পেরিয়ে

১৯৪২ সালের ২৬ মার্চ ইন্দিরা নেহরুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ফিরোজ জাহাঙ্গির গান্ধীর।

Wedding of Indira and Feroze Gandhi
Published by: Kishore Ghosh
  • Posted:April 6, 2025 10:12 pm
  • Updated:April 6, 2025 10:12 pm  

১৯৪২ সালের ২৬ মার্চ, ইন্দিরা নেহরুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ফিরোজ জাহাঙ্গির গান্ধীর। কনে ব্রাহ্মণ, পাত্র পারসি। উভয়ের ‘এনগেজমেন্ট’ ঘোষণার পরে জনমতে উঠে এসেছিল বিক্ষোভের আঁচ। জওহরলালের প্রাথমিক মত ছিল না। তবে মেয়ে কষ্ট পাক চাননি। মহাত্মা গান্ধীও মত দেন। লক্ষণীয়, এই বিয়ের সুবাদে কাউকে ধর্ম বদলাতে হয়নি। আর, ২৬ মার্চ ছিল রামনবমী। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

১৯৪২ সালের ৬ মার্চ। ঘোষণা হল, ইন্দিরা-ফিরোজের বিয়ে হবে ‘আনন্দ ভবন’-এ ২৬ মার্চ– রামনবমীর দিনে। দু’-সপ্তাহ আগেই অবশ্য ‘দ্য লিডার’ সংবাদপত্রে জওহরলাল নেহরু-কন্যা ইন্দিরার ‘এনগেজমেন্ট’-এর খবরটা বেরিয়েছিল প্রথম পাতায়। একজন হিন্দু ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে একজন পারসি যুবকের বিয়ে হতে চলেছে– এর বিরোধিতা করে ও রীতিমতো শাসিয়ে– বেশ কিছু চিঠি আসে গান্ধীজি এবং জওহরলালের কাছে। ওই পরিস্থিতিতে নেহরু অনুভব করেন, এই বিষয়ে ‘প্রেস বিবৃতি’ দেওয়া প্রয়োজন। তিনি বিবৃতি দিয়ে বলেন, “আমার কন্যা ইন্দিরার সঙ্গে ফিরোজ গান্ধীর এনগেজমেন্টের কথা একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই ব্যাপারে আমার কাছে বহু লোক জানতে চাওয়ায়, ওই রিপোর্টটি সঠিক বলেই জানাচ্ছি। বিয়ে ব্যক্তিগত এবং ঘরোয়া ব্যাপার, যা মূলত দু’জনের এবং আংশিকভাবে তাঁদের পরিবারের চিন্তার বিষয়। তবুও জনগণের সঙ্গে আমার যোগাযোগের কথা ভেবে আমার উচিত বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং সাধারণভাবে আমার উপর যাঁরা আস্থা রাখেন– সেই জনগণকেও এটা জানানো।”

Advertisement

পাশাপাশি, জওহরলাল বলেছিলেন, ‘মহাত্মা গান্ধী, যাঁর মতকে শুধুমাত্র জনগণের ব্যাপারেই নয়, আমার নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও গুরুত্ব দিয়ে থাকি, তিনি এই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন। আমার পরিবারের সদস্য এবং আমার স্ত্রীর পরিবারের সদস্যরাও সম্মতি দিয়েছেন।’ এ-ই ঘটনার বছরখানেক আগে, ইন্দিরা একদিন জেলে বন্দি বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানিয়েছিলেন– ফিরোজকে বিয়ে করতে চান। পরিচিত হলেও ফিরোজকে ‘জামাই’ হিসাবে প্রাথমিকভাবে মেনে নিতে পারেননি নেহরু। আবার তিনি চাইছিলেন না, একমাত্র মেয়ে কোনওরকম কষ্ট পায়। কথাটা শোনামাত্র ওদিনেই মেয়েকে কোনও মতামত জানাতে পারেননি নেহরু। পরের দিন ইন্দিরাকে চিঠি লিখলেন, ‘যদি তুমি ফিরোজকে বিয়ে করতে চাও, করো। কেউ তোমাকে বাধা দেবে না।’ যদিও পাশাপাশি তিনি মেয়েকে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। নেহরু তাঁর কন্যাকে বোঝাতে চাইলেন, ‘সে যে নতুন জীবনে যেতে চাইছে, তা কেমন তা সে জানে না। শুধু ফিরোজ বলে নয়, তার পরিবারের আরও অনেকের সংস্পর্শে আসতে হবে।

এটা যেমন ঠিক– কোনও পরিবারের সঙ্গে বিবাহ হয় না, তেমনই এটাও ঠিক– পরিবারকে অগ্রাহ্য করা যায় না।’ ফিরোজকে জানলেও পণ্ডিতজি তাঁদের পরিবারের অন্য কাউকে চেনেন না বলেই সেদিন জানিয়েছিলেন। ইন্দিরার স্বাস্থ্যের কথা ভেবে জওহরলাল সতর্ক করেছিলেন ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে এরকম স্বাস্থ্যের অবস্থায় সন্তানধারণ ঠিক নয়। এছাড়া, জওহরলাল তাঁকে গান্ধীজির পরামর্শ নিতে বলেন।

প্রিয়দর্শিনী আত্মবিশ্বাসী ছিলেন– গান্ধীজির আস্থা অর্জন করতে পারবেন, এবং গান্ধীজির আশীর্বাদ নেওয়াটা বিয়ের ক্ষেত্রে কাজেও লাগবে বুঝেছিলেন। গান্ধীজিও বুঝতে পেরেছিলেন, এই মেয়ে বিয়ের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর, তাই তিনিও এই বিয়েতে মত দেন। অবশ্য তিনি ফিরোজের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন, যত দিন না নেহরু মত দেন– তত দিন বিয়ে হবে না।

এর কিছু দিন বাদে জেল থেকে প্যারোলে ছাড়া পান নেহরু। তার ঠিক পরেই একদিন বেনারসে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির বৈঠক সেরে রাতের ট্রেনে এলাহাবাদ ফিরছিলেন ইন্দিরা, ফিরোজ এবং জওহরলাল। তঁারা তিনজন একই কম্পার্টমেন্টে বেশ কিছুক্ষণ ছিলেন। সেই ট্রেন যাত্রাপথেই ফিরোজ-ইন্দিরার বিয়ের ব্যাপারে নেহরুর সম্মতি মিলেছিল। তবে শুধু নেহরু নন, এই বিয়ের বিরোধিতা করা চিঠিগুলির জবাব মহাত্মা গান্ধীও দিয়েছিলেন ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ‘হরিজন’ পত্রিকায়।

গান্ধীজি লিখেছিলেন, ‘আমি বেশ কিছু খারাপ ভাষায় লেখা চিঠি পেয়েছি এবং তাতে খোলাখুলিভাবেই ফিরোজের সঙ্গে ইন্দিরার এনগেজমেন্টের কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু একটা চিঠিতেও ফিরোজ গান্ধীকে খারাপ লোক বলা হয়নি। তার শুধুমাত্র অপরাধ, সে একজন পারসি। আমি এখনও আগের মতোই বিয়ের কারণে কোনও একজনের ধর্ম পরিবর্তনের চরম বিরোধী। ধর্ম– পোশাকের মতো ইচ্ছামতো পরিবর্তন করা যায় না। এই ক্ষেত্রে কোনওরকম ধর্ম পরিবর্তনের প্রশ্নই উঠছে না। ফিরোজ দীর্ঘদিন ধরে নেহরু পরিবারের ঘনিষ্ঠ। সে অসুস্থ কমলা নেহরুর সেবা-শুশ্রূষা করেছে। সে ছিল তাঁর সন্তানের মতো।’ ফিরোজ এবং ইন্দিরার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে গান্ধীজি জানিয়েছিলেন, বন্ধুত্বকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েই তঁাদের মধ্যে স্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। কোনও পক্ষই জওহরলাল নেহরুর আশীর্বাদ এবং সম্মতি ছাড়া বিয়ে করার কথা ভাবেনি। তিনি সম্মতি দিয়েছেন, যখন বুঝেছেন এঁদের আকর্ষণের শক্ত ভিত রয়েছে।

জনগণ জানে, তাঁর সঙ্গে নেহরুর সম্পর্ক। তিনি দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাপুর মনে হয়েছিল, ‘ওঁদের এনগেজমেন্টে সম্মতি না-দেওয়াটা নিষ্ঠুরতা হত। সময় যত এগবে এমন বন্ধনে সমাজের মঙ্গল হবে বহুগুণ। এই মুহূর্তে দেশবাসী সেই পারস্পরিক সহনশীলতার স্তরে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু সেই সহনশীলতা যদি বৃদ্ধি পায়, পারস্পরিক ধর্মীয় শ্রদ্ধার মাধ্যমে, তাহলে এমন বন্ধনকে স্বাগত জানাতেই হবে।’

ইন্দিরা-ফিরোজের পরিণয়‌ এ-দেশের বিয়ের ক্ষেত্রে একটা নবযুগের সূচনা বলা চলে। হিন্দুর সঙ্গে একজন অ-হিন্দুর বিবাহ। অথচ, কারও ধর্ম পরিবর্তন হল না। ধর্মের দিক থেকে দু’জনেই আগের মতো রইলেন। যা একদিক দিয়ে সে যুগে বিরল যুগান্তকারী ঘটনা, এবং পরে বিবাহ-সংক্রান্ত আইন সংস্কারের‌ ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে ওঠে। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে অভিনবত্বও ছিল। ইন্দিরার হাতে একটি তরবারি তুলে দিয়ে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়, যা রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। শপথে বলা হয়েছিল, ‘বিশ্বের কোনও দিক থেকে যদি কেউ চলে আসে আমাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করতে, আমি তরবারি হাতে তাদের শেষ পর্যন্ত বাধা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। আমি প্রার্থনা করি, এই স্বাধীনতার আলো ছড়িয়ে পড়ুক। যা সবদিক থেকে আমাদের ঢেকে রাখবে।’ তৎকালীন ‘দ্য লিডার’ কাগজ অনুসারে, বিয়ের এই শপথবাক্যটি গান্ধীজির বার্তা ছিল। কারণ, সেই সময় অহিংসায় বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও মহাত্মা মহিলার পক্ষ থেকে হিংসাকে সমর্থন করেছিলেন শুধুমাত্র তঁাদের মর্যাদারক্ষার জন্য। হিন্দু অথবা পারসি– কারও কোনও গোঁড়া আচার-অনুষ্ঠান সেখানে স্থান পায়নি। উভয় সম্প্রদায়ই ‘অগ্নি’-কে মান্য করে, তাই বিবাহ অনুষ্ঠান হয়েছিল অগ্নিকে সামনে রেখে। বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে শেষ হয়ে যায়।

বিয়ের জন্য নির্দিষ্ট মঞ্চের উপর অগ্নিকুণ্ড, তার পাশেই বসেছিলেন ফিরোজ। জওহরলাল কন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে সেখানে আসেন। সেখানে একটি গদি দেওয়া ‘শূন্য আসন’ সংরক্ষিত ছিল– কমলা নেহরুর স্মৃতিতে। ইন্দিরার পরনে ছিল গোলাপি রঙের খাদির শাড়ি, যেটা তৈরি হয়েছিল তঁার বাবা জওহরলালের চরকায় কাটা সুতো থেকে। শাড়ির পাড়ে রুপোর সুতোয় এমব্রয়ডারি করা ছিল। তিনি বাবার পাশে বসেছিলেন যতক্ষণ না কন্যাদান হয়! ফিরোজের পরনে ছিল খাদি শেরওয়ানি, হঁাটু পর্যন্ত দীর্ঘ‌ কোট এবং চুড়িদার বা টাইট ফিটিং পাজামা। লক্ষ্মীধর শাস্ত্রীর নেতৃত্বে দু’জন পুরোহিত আচার-অনুষ্ঠানের কাজ সেরেছিলেন। পারসি সমাজের বেশ কিছু মানুষ ওই দিন বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিল, যাদের মধ্যে কেউ-কেউ ওই বিয়ের বিরোধিতা করে আগে ‘আনন্দ ভবন’-এর সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। শেষমেশ শান্তিতেই আচার-অনুষ্ঠান মিটেছিল। অপ্রীতিকর চিঠির বদলে ‘আনন্দ ভবন’-এ তারপর পোস্টম্যান নিয়ে আসে বেশ কিছু উপহার।

যদিও সেদিনের বিয়ের বৈধতা নিয়ে পরে প্রশ্ন উঠেছিল। এম. ও. মাথাই মন্তব্য করেছিলেন, ‘তখন বৈদিক রীতি অনুসারে আন্তঃধর্মীয় এবং আন্তঃবর্ণীয় বিবাহ আইনত বৈধ ছিল না।’ আবার উমা বাসুদেব একটি সাক্ষাৎকারে তঁার বিয়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করায় ইন্দিরা সাফ জানিয়েছিলেন, এটা ‘বৈধ’ কি না তা নিয়ে তিনি বিব্রত বোধ করেন না। বিয়ের প্রস্তুতি যখন পুরোদমে, তখন হঠাৎ লন্ডন থেকে ঘোষণা হল– ‘ওয়ার ক্যাবিনেট’-এর সদস্য ‘স্যর’ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্‌স ভারতে আসছেন৷ তখন জওহরলালের পক্ষে বিয়ের দিন পরিবর্তন করা সম্ভব ছিল না, কারণ জ্যোতিষীরা ২৬ মার্চকে শুভদিন বলে বেছেছিলেন, কারণ দিনটি ছিল রামনবমী। তবে টেলিগ্রাম পাওয়ায় গান্ধীজিকে দিল্লি যেতে হল স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্‌সের সঙ্গে দেখা করতে। ফলে বাপুর এই বিয়েতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও তিনি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। যদিও তিনি খাদির জিনিস ‘উপহার’রূপে পাঠিয়েছিলেন।

এই বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই মহাত্মা ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’-এর ডাক দেন, আর তাতে সাড়া না দিয়ে পারেননি ইন্দিরা-ফিরোজ। ফলস্বরূপ, কারাগারে ঠঁাই হয় নবদম্পতির!

(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
[email protected]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement