Advertisement
Advertisement

Breaking News

গুজরাট মডেল দেশের জন্য আশীর্বাদ?

প্রধানমন্ত্রীর ব্রহ্মাস্ত্র হল, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর নৃসিংহ রূপ।

What lies beneath Narendra Modi's Gujarat model?
Published by: Monishankar Choudhury
  • Posted:October 26, 2018 4:36 pm
  • Updated:October 26, 2018 4:36 pm

রাজদীপ সরদেশাই: ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন যদি ৭০ মিলিমিটার সিনেমার রিল হয়ে থাকে, সেখানে একটাই রেকর্ডের টানা ক্যাকোফোনি আবহরূপে গাঁথা হয়ে ছিল– ‘গুজরাট মডেল’। এই আবহ, বলা ভাল, প্রচারে বিজেপির বক্তব্য ছিল: মোদির উত্থান ল্যুটেনস দিল্লির এলিট মানুষদের জীবনে এনে দেবে গান্ধীনগরের টাটকা ফুরফুরে হাওয়া। কেবলমাত্র তাই নয়! গোটা দেশের জন্যও রয়েছে সুব্যবস্থার বাণী- আজ যা ভাবছে গুজরাট, কাল তাই ভাববে সারা দেশ। কিন্তু হায়! নিয়তির খেয়ায় এসে লাগল অন্য হাওয়ার ঝাপটা। ‘সিবিআই বিতর্ক’-র পরমুহূর্ত থেকে ‘গুজরাট মডেল’ আজ স্ক্যানারের তলায় বিপদঘন্টি ছাড়া কিছু নয়। দেশের প্রধান তদন্ত সংস্থার ‘গ্যাং ওয়ার’ বিপজ্জনক এন্ট্রি নিয়েছে।

কী এই ‘গুজরাট মডেল’?

Advertisement

ভারতীয় রাজনীতির অভিধান বলছে, সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে বিজেপি ছাড়া অন্য দলের এবং দরকার হলে বিজেপির ভিতরেও সম্ভাব্য ও উঠতি ‘মাথা’দের যথাসম্ভব ধড় থেকে আলাদা করে দেওয়া। কেবলমাত্র মোদিই হবেন ‘সুপ্রিম লিডার’। ২০১৪-য় গুজরাটের বিজেপি পরিবার ছিল অগ্রজ নেতাদের সমন্বয়ে সম্ভ্রান্ত, সেখানে আজ থাকবেন শুধু একজনই হর্তাকর্তাবিধাতা। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ-র একটি স্লোগান- কংগ্রেস-মুক্ত ভারত! তাঁর আরও একটি প্রতিশ্রুতি যে, ‘বিজেপি আগামী ৫০ বছর ভারত শাসন করবে’। এ সমস্ত বক্তব্য তলায় তলায় শিকড় ছড়াতে থাকা অন্তর্নিহিত একটি রাজনৈতিক অভিসন্ধি স্পষ্ট করে দেয়। গুজরাটে ‘রাজনীতি’ নামের বাগানে বিগত ২০ বছর ধরে নির্বিঘ্নে কমলকলি ফুটে রয়েছে এবং আজ প্রায় ২০টি রাজ্য বিজেপি শাসনাধীন। সেই জায়গা থেকেই হয়তো বিজেপি সভাপতি আশাবাদী হয়েছেন। তাঁর এমন বলা তো সাজতেই পারে, তাই না?

Advertisement

[সিবিআই প্রধানের বিরুদ্ধে তদন্ত করবে সিভিসি, নির্দেশ শীর্ষ আদালতের]

‘গুজরাট মডেল’-কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে তার শরীর ঢেকে দেওয়া হয়েছে ‘বিকাশ’ অর্থাৎ উন্নয়নের লোভনীয় মোড়কে। গুজরাটের ঝাঁ চকচকে বন্দর, হাইওয়ে, ২৪x৭ বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং দুদ্দাড় গতিতে নগরায়নের পালিশ করা সব ছবি, শুধু বিজ্ঞাপন হিসাবেই নয়, প্রমাণ হিসাবেও ব্যবহার করা হয়েছে। কীসের প্রমাণ? প্রমাণ হল এই যে- প্রধানমন্ত্রীর এমনতর দক্ষ শাসনশৈলী একদিন ভারতকে উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং বিশ্বের আশ্বাস এনে দেবে। উপর্যুপরি, সূচনা ঘটবে নতুন এক যুগের। বার্তাটি জলের মতো স্বচ্ছ- এমন জ্বলজ্বলে গুজরাট আসলে ভবিষ্যতের জ্বলজ্বলে ভারতের এক ‘প্রোটোটাইপ’ মডেল। কিন্তু ছবিগুলি পালিশ করতে গিয়ে গুজরাটের যে অন্ধকার- তা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ হোক, কিংবা ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক বৈষম্য, এখানে চাপা পড়ে গিয়েছে বেমালুম। বা বলা ভাল, চাপা দেওয়া হয়েছে।

‘গুজরাট মডেল’ ছিল সম্ভবত নরেন্দ্র মোদিকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ রূপে জনতার সামনে উপস্থাপন করার রণনীতি। মোদি সেখানে একচ্ছত্রভাবে একজন শক্তপোক্ত এবং চতুর দলনেতা, যিনি অলস এবং অসমর্থ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার গোঁড়া পদ্ধতিসমূহ ঝেঁটিয়ে বিদায় করবেন। দেশের অভিজাত ব্যবসায়ী মহল গুজরাতের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন- একমাত্র এই রাজ্যই নাকি ব্যবসায়িক অর্থনীতির কথায় ‘সিঙ্গল উইন্ডো ক্লিয়ারেন্স’-এর রাজ্য, যেখানে ব্যক্তির গুরুত্ব প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্বের চেয়ে কম নয়। এমনও গল্প ভেসে বেড়ায়– আপনার ‘কাজ’ হয়ে যাওয়ার জন্য গান্ধীনগরে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে নাকি একটা ফোনই যথেষ্ট! যদিও এই গল্প কতখানি সত্যি, সন্দেহ রয়েছে। চেক এবং ব্যালান্সের নথিপত্র যা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মাঝেসাঝেই কাজে লাগে, প্রায়ই প্রকাশ্যে আনা হত এবং ছড়িয়ে দেওয়া হত। ছড়ানো হত আসলে শুধু এটুকু দেখাতেই যে, সমগ্র সিস্টেমটি আসলে একজন ব্যক্তির সদিচ্ছা-নির্ভর। এতে দেখনদারিই ছিল বেশি, নিশ্চয়তা ছিল না। ক্ষমতাবান সিএমও এই ‘সিঙ্গল উইন্ডো’-র মাধ্যমে আসলে বোঝাতে চেয়েছিল, দুর্নীতি-বিরোধী পাহারাদাররাও রাজনৈতিকভাবে তাদের হাতের মুঠোয়। এবং যখন-তখন তাদের কাজে লাগানো যাবে। রাজ্যে একটি ‘লোকায়ুক্ত’ নিয়োগের সময় নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে রাজ্যপালের বিরোধের ঘটনাই এই বিবৃতির চরম উদাহরণ। তখন খুব ভালরকম খোলসা হয়েছিল যে, গান্ধীনগরের সরকার সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষকেও তাদের শাসনব্যবস্থায় মাথা গলাতে দিতে কতটা অনিচ্ছুক। রাষ্ট্রীয় মানবাধিকার কমিশন এবং তথ্য কমিশনকেও কীভাবে প্রান্তিক করা হয়েছিল, সেটাও কি একটা বড় উদাহরণ নয় এ ব্যাপারে? অস্বস্তিকর এমন সব সিদ্ধান্ত আসলে শাসনব্যবস্থার ফাঁকফোকর প্রকাশ্যে আসার ভয় থেকেই নেওয়া; ভয় এই যে- যদি কখনও জনসাধারণের চিরুনির তলায় পড়ে, তাহলে তল্লাশির শেষ থাকবে না।

‘গুজরাট মডেল’-এর এই কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা হয়তো অপেক্ষাকৃত ছোট বলয়ে কার্যকর। কিন্তু আজ সেই পদ্ধতি প্রধানমন্ত্রীর অফিস অনুকরণ করতে গিয়ে মহা টানাপোড়েনে। কর্মক্ষেত্রের যে বৈচিত্র এবং বিপুল সরকারি কর্মশালার যে নিবিড় পরিধি ভারতীয় গণতন্ত্রে ‘নিয়ন্ত্রণকারী’ মানসিকতার বিরুদ্ধে কাজ করে– এই প্রক্রিয়া তারই অন্তরায়। সিবিআইয়ের ভিতরকার অভূতপূর্ব ‘যুদ্ধ’-ই উত্তমমধ্যম বুঝিয়ে দেয়, একটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্যই চাপিয়ে দিলে তার কী বিরূপ ফলাফল হতে পারে।… আমলাতন্ত্র এবং দেশের শীর্ষ তদন্তকারী সংস্থার ‘রোল কল’ হলেই দেখা যাবে সেখানে অস্বাভাবিকভাবে গুজরাতের অফিসারদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বেশিরভাগ তাঁরাই, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর পূর্ব পরিচিত।

হয়তো কথা উঠবে, আর পাঁচজন প্রধানমন্ত্রী যেমনভাবে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্কে থাকা অফিসারদের বেছে নিয়েছিলেন, নরেন্দ্র মোদিও ঠিক তেমনটাই করেছেন। ভুল কী করেছিলেন? কিন্তু কাজের সুবিধার্থে ‘কমফোর্ট জোন’ বানিয়ে নেওয়ার জন্য অনুগামী বেছে নেওয়া এক বিষয়, আর গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের সময় সাংবিধানিক নিয়ম এবং সাংগঠনিক স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা আরেক বিষয়। ভিন্নমত পোষণের প্রতি যে এই সরকার অসহিষ্ণু, তা অবশ্য অনেক আগেই বিশ্বাসযোগ্যরূপে খোলসা হয়ে গিয়েছিল। একটু একটু করে কোণঠাসা হয়ে রঘুরাম রাজন শেষ অবধি রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর পদ থেকে চিরতরের জন্য সরে যেতে মনস্থ করেন। সিবিআই-কাণ্ডে আরও প্রকট হল সেই বিশ্বাস। এই কেন্দ্রীয় সরকার একচ্ছত্রভাবে রাজনীতিক হস্তক্ষেপ করতে চাইছে। এবং রক্ষা করছে সেসব অফিসারকে যাঁদের কর্মজীবনের হালখাতা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট কালিমালিপ্ত।

প্রধানমন্ত্রীর ব্রহ্মাস্ত্র হল দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর নৃসিংহ রূপ। আর তুরুপের তাস হল এক লাইনের স্লোগান- ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা!’ কিন্তু সিবিআইয়ের একজন অফিসার ভিতরে ভিতরে বলপূর্বক আদায়ের চক্র চালাচ্ছেন এমন অভিযোগ এনে যখন সিবিআইয়েরই আরেকজন পদস্থ কর্তা এফআইআর করলেন, রাতারাতি তাঁকে সরানো হল, এবং এমনকী তদন্ত টিমও বদলে দেওয়া হল। এর মানে কী দাঁড়ায়? এটা কতখানি সমর্থন করে প্রধানমন্ত্রীর ‘দুর্নীতিবিরোধী’ ইমেজকে? এই অপসারণ কি কোনও ঘেঁষাঘেঁষি যুদ্ধ আটকাতে, না কি রাফাল চুক্তির তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে? অভিযুক্ত অফিসারকেও ছুটিতে যেতে বলা হয়েছে বটে, কিন্তু তারপরেও কি সম্পূর্ণ তদন্ত হবে? না কি মানুষের স্বল্পায়ু স্মৃতির বালুকায় স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে তলিয়ে যাবে দুষ্কর্মের তালিকা?

সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগত। অস্বস্তিকর প্রশ্নের হাঁসফাঁসের মাঝে এবার মনের কথা প্রধানমন্ত্রী মুখে আনুন।

পুনশ্চ ইউপিএ সরকার যখন ক্ষমতায়, সিবিআই-কে তখন ‘খাঁচার তোতা’ বলে কটাক্ষ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। তাহলে আজ এই এনডিএ সরকারের জমানায় সিবিআই-কে কী বলা হবে?

[টেন্ডারে দুর্নীতি, কাশ্মীরে সরকারি কর্মীদের বিমা প্রকল্প বাতিল রাজ্যপালের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ