Advertisement
Advertisement

Breaking News

কুমারী হলেই ‘দেবী’রূপে আরাধনা! নইলে ‘ভোগ্যা’?

পুজো স্পেশাল খাতির শুধু কুমারীদের জন্য বরাদ্দ।

Why only a virgin girl is worshipped as Devi Durga?
Published by: Sangbad Pratidin Digital
  • Posted:October 8, 2016 4:50 pm
  • Updated:October 8, 2016 7:02 pm

নারী যে ভোগ্যবস্তু, তা কে নির্ধারণ করলেন?  আর ‘ভোগ্য’ যে ‘পূজ্য’ নয় সেটাই বা কে বলে দিয়েছেন? কোনও না কোনওভাবে কুমারীকে ঈশ্বর এবং যাঁরা কুমারীত্ব হারিয়েছেন তাঁদের ‘ভোগ্য’ বলার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতই কি এর মধ্যে লুকিয়ে নেই? উত্তর খুঁজলেন উর্মি খাসনবিশ।

ছোটবেলায় জেঠিমাকে দেখতাম অষ্টমীর দিন বাড়িতে কুমারী পুজোর আয়োজন করতেন। পাড়ার বাচ্চাদের খাওয়াতেন, উপহার দিতেন। দূরদর্শনে যেমন বেলুড় মঠের কুমারী পুজো দেখায়, ব্যাপারটা ততটা জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও, আনন্দ পেতাম। খেয়াল আছে, জেঠিমার সবচেয়ে আদরের বলে নিজে  দুর্গা হওয়ায় একপ্রকার একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার একটি মহৎ দোষ রয়েছে। সেটি হল, প্রশ্ন করা। অতিরিক্ত প্রশ্ন করার জন্য নিজে বহুবার বিপাকে পড়েছি। ধমক দিয়ে অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন, “আহ এত প্রশ্ন কেন কর বল তো?”

Advertisement

এই প্রশ্নের বহর নিয়েই জেঠিমার কাছে গিয়েছি। বয়স তখন ছয় কিংবা সাত। সঠিক খেয়াল নেই। “বম্মা, পুজোয় বুড়িকে সরস্বতী সাজালে, বাবুকে কার্তিক সাজালে না কেন?” বলে রাখি বাবু আর বুড়ি আমার ছেলেবেলার দুই পাড়ার বন্ধু। জেঠিমা বললেন, “এটাতো কুমারী পুজো। শুধু মেয়েদের পুজো করা হয়।” আবারও বললাম, “তাই? তবে মাকে পরের বার দুর্গা বানাব হ্যাঁ?” এবার জেঠিমার ধৈর্য হারানোর পালা। বললেন, “না ভুতো! মাকে তো পুজো করা যাবে না। এই পুজো ছোট মেয়েদেরই করা যায়। যাদের বিয়ে হয়নি” “কিন্তু দুর্গা ঠাকুর তো মা! চারটে ছেলেমেয়ে আছে! শিব ঠাকুর তো দুর্গা ঠাকুরের বর।” যথারীতি বলে ফেললাম! “হ্যাঁ! কিন্তু দুর্গা তো ঠাকুর! তাই পুজো করা হয়! আর ছোট কুমারী মেয়েদের মধ্যে ঠাকুরের বাস! তাই ঈশ্বর জ্ঞানে তাদের পুজো করা হয়!” কথাটা বলতে বলতে চলে গেলেন জেঠিমা!

Advertisement

বুঝলাম ঠাকুরকে মা বলা যাবে! কিন্তু মাতৃস্থানীয় কাউকে ঠিক পুজো করা যাবে না। পুজো স্পেশাল খাতির শুধু কুমারীদের জন্য বরাদ্দ।

পরে জেনেছি, কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হল নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি হল নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধন পদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে; তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। আর তাই বীজরূপী কুমারী মেয়েকেই দেবীর আসনে বসিয়ে মানুষ ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো করে।

গোটা বিষয়টি জেনে যে প্রশ্ন সবার আগে জেগেছে, তা হল নারী যে ভোগ্যবস্তু, তা কে নির্ধারণ করলেন?  আর ‘ভোগ্য’ যে ‘পূজ্য’ নয় সেটাই বা কে বলে দিয়েছেন?

পতিতাপল্লির যে মা, রোজ রাতে মুখে রং মেখে পথের ধরে এসে দাঁড়ান, আর দিনের আলোয় সন্তানকে ভাত বেড়ে খাওয়ান তাঁকে ‘ভোগ্য’ না ‘পূজ্য’র তালিকায় রাখা হবে, উত্তর পাচ্ছি না। একই সঙ্গে  প্রশ্ন জাগে ফসল যখন সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করি, তখন কেবল বীজাবস্থাকে ‘পূজ্য’ গণ্য করে বাকি সমস্ত বিষয়টিকে ‘ভোগ্য’ বলার কারণ কী?

বিশ্বের অতি প্রাচীন ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেই সময় পূজিত নারী মূর্তিরা হতেন একেবারেই ‘মা’-এর আদলে গড়া। এলো চুল, সুডোল বক্ষ, পরিপূর্ণ নারী। রবীন্দ্রনাথের কথায় ঠিক যেন ‘বর্ষা’ ঋতু। দাত্রী! কিন্তু আশ্চর্যভাবে সময় পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যেতে থাকে পূজনীয় নারীর ভাবনা। মা’কে কেবল মূর্তিতে পুজোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে কুমারী মেয়ের মধ্যে ঈশ্বর খুঁজতে একপ্রকার মত্ত হয়ে ওঠে সমাজ। ফুলে, ফলে, অলংকারে সাজিয়ে সেই কুমারীকেই বানিয়ে তোলা হয় দশভুজা।

ভাবনার জগতে যখন নিজের মতো আঁকিবুকি করি তখন মনে হয় ‘ভার্জিন মেরি’ এবং আমাদের ‘কুমারী মা দুর্গা’র মধ্যে যেন কোনও অজানা সুত্র রয়ে গিয়েছে। কোনও না কোনওভাবে কুমারীকে ঈশ্বর এবং যাঁরা কুমারীত্ব হারিয়েছেন তাঁদের ‘ভোগ্য’ বলার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাই। সেই ইঙ্গিত যে কেউ আমায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তেমন নয়, তবু যেন এমনটাই মনে হয়। প্রথমত নারী যে ভোগ্যবস্তু নয় এবং দ্বিতীয়ত কুমারিত্ব কোনও নারীকে ‘ভোগ্য’ তকমা থেকে কত সহজে উদ্ধার করতে সক্ষম তা দেখেই চমকে যাই। কিন্তু এমনটাই হয়ে এসেছে প্রাচীনকাল থেকে। নারী বেদের আদিপর্বে সম্মান এবং পুরুষের সম-মর্যাদা পেলেও কালক্রমে সেই মর্যাদা খর্ব করার চেষ্টা করা হয়েছে। নারীকে রুখতে বেঁধে দেওয়া হয়েছে তাঁর সীমারেখা। বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, সমাজের চোখে ঠিক কী করলে ‘দেবী’ হওয়া যায় আর ঠিক কী করলে অবলীলাক্রমে হারিয়ে ফেলা যায় সেই ‘দেবী’র আসন। আর তাই বোধহয়, মায়ের পুজো কুমারী মেয়ের সামনে অর্পণ করা হচ্ছে। বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ঠিক কেমনভাবে থাকলে ‘দেবী’ বলবে সমাজ! আর ঠিক কী করলে মায়েদের খুব ডিপ্লোম্যাটিক পদ্ধতিতে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান থেকে দূরে রাখা যাবে!

যাই হোক, এই প্রথা এক দমকে পাল্টে ফেলে নিজের মা’কে দেবীর আসনে বসালে ‘অধার্মিক’ তকমা জুটতে পারে। তবে একটা কথা অস্বীকার করব না, আমি কিন্তু এখনও ভাবি, কুমারী পুজোর বদলে যদি আমার মা’কে ঈশ্বররূপে পুজো করা যেত, মন্দ হত না। আপনিও কি এমনটা ভাবেন?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ