রামরাজ্যের হ্যাপা ভারি৷ প্রতিশ্রুতি ভুরি ভুরি৷ সাধারণের ভাঁড়ার খালি৷ চলে শুধু রাজনীতির গা জোয়ারি৷ গণতন্ত্রের অঙ্ক বড় জটিল৷ সমাজের ভুলভুলাইয়াতে ফের শিরোনামে রাম-নাম৷ তবে এবার কারণ ভিন্ন৷ আলোচনায় সুপর্ণা মজুমদার৷
সত্যযুগ নাকি সত্যই বড় সুখের সময় ছিল৷ সে যুগে রামচন্দ্রের মতো রাজা ছিলেন৷ আজ যুগের পঞ্জিকায় আর সে সত্য নেই, কিন্তু রামচন্দ্র আছেন বহাল তবিয়তেই৷ যখনই সংসদীয় কাঠামোয় রাজনীতির প্রয়োজন হয়েছে ভোট বৈতরণী পার হওয়ার, তখনই কোনও কোনও দল রামকে প্রায় তাদের পৈতৃক সম্পত্তি করে তুলেছে৷ অর্থাৎ এ যুগ সত্য না হোক, কলিতেও রামের থাকা ঘোর সত্য৷
এবং সেইসঙ্গে এও সত্য যে, এই ঘোর রামরাজ্যে থাকবেন না রামশঙ্কর যাদব বা রাম কিষান গ্রেওয়ালরা৷
রামশঙ্কর কে? এক মাস বাদে যাঁর একমাত্র মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল৷ কথা ছিল, নিজে হাতে বিয়ের সব কেনাকাটা করবেন৷ সে কাজ শুরুও করে দিয়েছিলেন ভোপাল পুলিশের কনস্টেবল৷ কিন্তু দীপাবলির আলোর রাত তাঁর জীবনে হঠাৎ চির অন্ধকার নিয়ে নেমে এল৷ আট সিমি ‘জঙ্গি’র পালানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন৷ ফল, গলা কেটে হত্যা করা হল হেড কনস্টেবলকে৷ আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশের হাতে খতম অভিযুক্ত আট সিমি সদস্য৷ ফাইল ক্লোজড, বলল রাজ্য প্রশাসন৷ কিন্তু, ফেক এনকাউন্টারের দাবি তুলে ফের সরব মানবিক মানুষের দল৷ ফের শুরু হয়েছে তদন্ত প্রক্রিয়া৷ হয়তো আদি-অনন্ত কাল ধরে চলবে৷ কিন্তু এসবের মধ্যে কোথাও থাকবেন না রামশঙ্কর৷ তাঁর মেয়েরও বিয়ে হবে৷ কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় উথাল-পাথাল দেশপ্রেম প্রকাশী জনগণ তার কতটাই বা খোঁজ রাখবে! হায়রে মধ্যবিত্ত দেশপ্রেম! আসলে রাম থাকেন, কিন্তু রামশঙ্করদের যেন থাকতে নেই৷
ফিরে আসবেন না আরও এক ‘রাম’৷ রাম কিষান গ্রেওয়াল৷ দেশের জন্য ৩০ বছর লড়েছেন এই সেনাকর্মী৷ কে জানে কত শত্রু নাশ করেছেন! শেষ জীবনের লড়াইটা আর লড়তে পারলেন না ক্লান্ত সৈনিক৷ এক পদ এক পেনশন প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ায় বেছে নিলেন আত্মহত্যার পথ৷ সুইসাইড নোটে জানিয়ে গেলেন, সরকার প্রতিশ্রুতিমতো বর্ধিত পেনশন এখনও দেয়নি৷ এ নিয়ে যন্তর মন্তরে ধরনাতেও বসেছিলেন৷ তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁকে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি৷ তারপরই এ সিদ্ধান্ত৷ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অবশ্য দাবি, এরকম কোনও আবেদন তাঁরা পাননি৷
প্রশ্ন উঠেছে, কিছু আবেদন-নিবেদন করেই কি নিজের অধিকার পেতে হবে? সরকারের কান কত উঁচুতে যে রাম কিষানদের আওয়াজ গিয়ে পৌঁছাতে পারল না? কিসের এত নিরপত্তাহীনতা, যে নিহত রাম কিষান গ্রেওয়ালকে শেষ শ্রদ্ধাটুকুও জানাতে দেওয়া হল না! হরিয়ানার গ্রামে সুবেদার রাম কিষানের শেষকৃত্যে সামিল হয়েছিলেন নেতা, বন্ধু, আত্মীয়, পরিজনরা৷ হিসেবনিকেশ অনেক হয়েছে৷ কিন্তু অঙ্ক মেলেনি৷ তা মেলবার কথাও নয়৷ কেননা এ ‘রাম’রাজত্বের অঙ্কটাই আলাদা৷
কী সেই অঙ্ক? এ আসলে সেই বাঁদরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠার গণিতই৷ এই একটু উঠল তো পিছল দু’ধাপ৷ সংসদীয় রাজনীতিরও এর থেকে কম কিছু নয়৷ সে বাঁশে এই এক ইস্যুতে এক ধাপ ওঠা, অমনি আর আর এক ইস্যুতে হুস করে নেমে যাওয়া৷ কিন্তু ওই ওঠানামার অঙ্কে তো আর ভোট পেরনো যায় না৷ তখন জনমানসে উসকে দেওয়া সেই সত্যযুগ৷ সেই রামরাজত্বের স্মৃতি ও প্রতিশ্রুতি৷ সুতরাং রামচরিতে ভরসা রেখেই রাজনীতির পাটিগণিত সমাধানের পাতা খোঁজে৷ কিন্তু বাস্তবের রামরা সেখানে ব্রাত্য৷ কে না জানে, কবি তো বলেইছেন, নামে কী আসে যায়! সুতরাং সত্যের রাম থাকলেও, কলির রামেদের টেকা মুশকিল৷
সুতরাং কয়েকদিনের জন্য তাঁরা খবরের শিরোনামে৷ নীতি-রাজনীতির অনেক দোহাই৷ মানবিকতার প্রশ্ন তুলে বহু আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা চলবে এবং চলতেই থাকবে৷ কিন্তু তাতে কি এখন রামশঙ্কর যাদব ও রাম কিষাণ গ্রেওয়ালের কিছু এসে যায়! রাম-আদমিরা তখতের নেশায় মেতে থাকলেও আমআদমিরা যে চিরকাল একই থেকে যাবে এটাই দস্তুর৷ তবে হ্যাঁ, তা বলে কেউ আর তাঁর সন্তানের নাম রামশঙ্কর বা রাম কিষান রাখবেন না তা তো নয়৷ শ্রীরামের মহিমাই যে এমন!