দোরগোড়ায় উত্তর-পূর্বের চার রাজ্য- ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে বিধানসভা ভোট। লোকসভা আসনের বিচারে এই রাজ্যগুলোর ফলের বিশেষ গুরুত্ব না থাকলেও, যেহেতু সব জায়গাতেই বিজেপি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় রয়েছে, তাই মোদি-ম্যাজিক কার্যকর কি না, পরীক্ষা তারও।কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা ভোট এবং দিল্লির পুরভোটের ফলাফলের পর ফের চর্চা শুরু হয়েছে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের সম্ভাব্য পরিণতি ঘিরে। বস্তুত, হিমাচল প্রদেশ ও দিল্লি পুরসভা বিজেপির হাতছাড়া হওয়ায় বেশ কিছুদিন বাদে বিরোধীরা কিছুটা অক্সিজেন পেয়েছে। এই ভোটের ফল-কে কার্যত বিজেপির বিরুদ্ধে ২-১ ব্যবধানে জয়ের নিরিখে দেখছে বিরোধীরা। একইসঙ্গে সাত জায়গায় উপনির্বাচনের পাঁচটিতেই বিজেপি পরাজিত হওয়ায় বিরোধী শিবিরে উচ্ছ্বাস। কংগ্রেস-সহ তামাম বিরোধী দল সংগতভাবেই প্রশ্ন তুলেছে, মোদি-ম্যাজিকের অস্তিত্ব নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে গুজরাতিদের অহংকার ভোটে নিশ্চয়ই ফ্যাক্টর। কিন্তু গুজরাতের বাইরে কেন মোদির মুখ দেখে পদ্মে ভোট এল না?
দোরগোড়ায় এসে গিয়েছে উত্তর-পূর্বের চার রাজ্যের ভোট। আগামী ফেব্রুয়ারিতেই ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডে বিধানসভা ভোট। কয়েক দিনের মধ্যেই ওই চার রাজ্যের ভোটের নির্ঘণ্ট জারি করবে নির্বাচন কমিশন। কংগ্রেস প্রায় পুরোটাই তৃণমূলের সঙ্গে চলে আসায় মেঘালয়ে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মেঘালয় সফর শুরু করেছেন। অন্যদিকে, শরিক দলের সঙ্গে দ্বন্দ্বে মেঘালয়ে কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে বিজেপি। ছবিটা স্পষ্ট না হলেও ত্রিপুরায় বিজেপিকে রুখে দেওয়ার জন্য তৎপরতা রয়েছে বিরোধী শিবিরে। ত্রিপুরার বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক জন-অসন্তোষ রয়েছে। মে মাসেই সেখানে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে। বিপ্লব দেবের জায়গায় মানিক সাহাকে আনা হয়েছে। তাতে যে পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন ঘটেছে, তেমন নয়।
[আরও পড়ুন: নতুন মোড়কে পুরনো প্রশাসন, পাকিস্তান আছে পাকিস্তানেই!]
মিজোরামে বিজেপির সেভাবে অস্তিত্ব না থাকলেও সেখানে তাদের শরিক দল ক্ষমতায় আছে। অনেকটা একই ছবি নাগাল্যান্ডেও। গতবার নাগাল্যান্ডে ১২টি বিধানসভা আসন জিতেছিল বিজেপি। লোকসভা আসনের বিচারে উত্তর-পূর্বের এই চার রাজ্যের ফলের বিশেষ গুরুত্ব না থাকলেও, যেহেতু সব জায়গাতেই বিজেপি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় রয়েছে, তাই মোদি-ম্যাজিক কার্যকর কি না, সেই পরীক্ষা এই চার রাজ্যের ফলাফলেও থাকবে। ত্রিপুরা ছাড়া খ্রিস্টান অধ্যুষিত বাকি তিন রাজ্যয় বিজেপির প্রান্তিক উপস্থিতি। ত্রিপুরা বিজেপির হাতছাড়া হলে গেরুয়া শিবিরের বড় ধাক্কা।
উত্তর-পূর্বের চার রাজ্যের ভোটের ফল নিয়ে কাটাছেঁড়া শেষ হতে না হতেই এসে যাবে কর্নাটকের বিধানসভা ভোট। ২২৪টি আসনের কর্ণাটক বিধানসভায় ১০৪ জন বিধায়কের দল বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও সরকার রয়েছে। ‘অপারেশন লোটাস’ মাঝপথে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনে। কর্নাটকের ফলের রাজনৈতিক গুরুত্বও যথেষ্ট। ২০১৩ সালে কংগ্রেস কর্ণাটকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। হিমাচলের মতো কর্ণাটকেও গত দু’-দশকের রেওয়াজ হল পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলে যাওয়া। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনও সরকারি কাজে ৪০ শতাংশ কাটমানি নেওয়ার অভিযোগকে সামনে রেখে ভোটে যাবে কংগ্রেস। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে-র রাজ্যে কংগ্রেসেরও সাংগঠনিক শক্তি কম নয়। বিশেষত, রাজ্যের দুই হেভিওয়েট রাজনৈতিক নেতা, সিদ্ধারামাইয়া এবং ডি. কে. শিবকুমার কংগ্রেসেই রয়েছেন। ইয়েদুরাপ্পাকে সরিয়ে দেওয়ার পর বিজেপির হাতে বড় মাপের রাজ্য নেতা নেই। কর্নাটকে সরকার না বঁাচাতে পারলে ফের মোদি-ম্যাজিক নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন উঠবে।
২০২৩-এর নভেম্বরে ভোট রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে। গত লোকসভা ভোটের আগে এই তিন রাজ্যেই জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু, লোকসভা ভোটে এই তিন রাজ্যেই ৬৫টি আসনের মধ্যে ৬১টি আসন দখল করে বিজেপি। পরে কংগ্রেস ভাঙিয়ে মধ্যপ্রদেশের সরকারের দখলও নেয় বিজেপি। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের একটি করে বিধানসভা আসন ছিল। ২টি আসনই কংগ্রেস রক্ষা করেছে। রাজস্থানে অশোক গেহলট ও শচীন পাইলটের লড়াই কংগ্রেসকে উদ্বেগে রাখলেও সংকট রয়েছে বিজেপির মুখ নিয়েও। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরারাজে সিন্ধিয়াকে এবারও মুখ্যমন্ত্রীর মুখ করা হবে কি না, তা নিয়ে বিজেপি দ্বিধায়। ছত্তিশগড়ে জনজাতিদের জন্য সংরক্ষণের কোটা বাড়িয়ে মাস্টারস্ট্রোক দিয়ে রেখেছেন কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল। মধ্যপ্রদেশে বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে চূড়ান্ত পর্যায়ে। এবারও লোকসভা ভোটের মুখে এই তিন রাজ্যের ভোট নিয়ে খুব স্বস্তিতে থাকবে না গেরুয়া শিবির। আগামী বছরের শেষ বিধানসভা নির্বাচন হবে তেলেঙ্গানায়। দক্ষিণের এই রাজ্যটিতে সম্প্রতি বিজেপি কিছুটা শক্তি বাড়িয়েছে। তেলেঙ্গানায় গত লোকসভা ভোটে বিজেপি ১৭টির মধ্যে ৪টি আসন পায়। যদিও পাঁচ বছর আগে বিধানসভা ভোটে ১১৯টির মধে্য মাত্র একটি আসন জুটেছিল বিজেপির কপালে। বিধানসভার একটি আসনের উপর ভরসা করেই গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি লাগাতার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে. সি. আর-এর দিকে।
কয়েকদিন আগে তেলেঙ্গানার একটি বিধানসভা উপনির্বাচনে বিপুল অর্থ ও শক্তি ক্ষয় করেও বিজেপি কে. সি. আর-এর দল তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতির কাছে পরাজিত হয়েছে। তেলেঙ্গানায় এখনও মোদি-ম্যাজিকের কোনও জোরালো প্রমাণ মেলেনি।
[আরও পড়ুন: ঋণনীতি যেন শাঁখের করাত, কোন পথে দেশের অর্থনীতি?]
ফলে লোকসভা ভোটের মুখে এই ন’টি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে যদি বিজেপি ধাক্কা খায়, তাহলে মোদি-ম্যাজিকের তত্ত্ব ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে আরও বিবর্ণ হবে। তবে এই ন’টি বিধানসভা ভোট বিরোধী দলগুলির কাছেও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দিল্লি ও হিমাচলের ফলাফলের শিক্ষা নিয়ে বিরোধীরা স্থানীয় ইস্যুকে সামনে রেখে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করতে পারবে কি না, তার পরীক্ষা। চারটি বড় রাজ্যে যেহেতু কংগ্রেসই বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই তাদের ভূমিকাটা এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হিমাচলে কংগ্রেসের জয় নিঃসন্দেহে ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’-কে অনেকটাই অক্সিজেন দিয়েছে। হিমাচলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১১টি সভা করেছেন। হিমাচল একটি হিন্দু প্রধান রাজ্য। হিমাচলে মোদি-ম্যাজিক ছাড়াও বিজেপির অন্যতম হাতিয়ার ছিল হিন্দুত্ব। এবার ক্ষমতায় এলে হিমাচলে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ লাগু করা হবে বলে বিজেপির ঘোষণা ছিল। হিমাচলের ফল দেখিয়েছে– মূল্যবৃদ্ধি, আপেল চাষিদের ফসলের দাম না পাওয়ার সংকট ইত্যাদি স্থানীয় ইস্যু গুরুত্ব পেলে বিজেপির উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাতীয় নিরাপত্তা ও হিন্দুত্বের মতো তুরুপের তাস কাজ করে না। কাজ করছে না মোদির ভাবমূর্তিও। ১৫ বছর ধরে দিল্লি পুরসভার ক্ষমতায় থেকেও যেমন আম আদমি পার্টির বিনামূলে্য বিদু্যৎ ও জল সরবরাহের ধাক্কায় বিজেপিকে এবার সরতে হয়েছে।
দিল্লি ও হিমাচল প্রদেশের ফল বিরোধীদের যে অক্সিজেন জুগিয়েছে, তা অাগামী বছরের ন’টি বিধানসভা ভোটে কার্যকর থাকলে ২০২৪-এর অনেক হিসাবনিকাশই বদলে দিতে পারে।