নির্মল ধর: ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এ যেভাবে সিনেমা ব্যাকরণের ছক ভেঙেছিলেন প্রতীম, তাঁর সাম্প্রতিক ছবিতে আবার ফিরে এলো সেই ছক ভাঙার ভিশন। এবার সেই ভাঙনের তলায় রয়েছে প্রেম ও কবিতার এক চোরা ফল্গুধারা। যে ধারাটিকে আঁজল ভরে নিয়ে গান ধরতে ইচ্ছে করবে বুদ্ধিমান দর্শকের। ‘আহারে মন’ একই সঙ্গে ফুরফুরে মন ভাল করার ছবি, আবার চিনচিনে ব্যথায় বুকটাকে ভারীও করে বইকি! এখনকার বাংলা সিনেমায় যখন ফুলটুস মস্তি আর দর্শক নিচ্ছে না, তখনই দর্শক গোগ্রাসে গিলছে খুচরো একটা সমস্যার ওপর কমেডির কোটিং লাগানো ছবি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীম ডি. গুপ্তর এই ‘আহারে মন’ সত্যি যেন ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর সুবাতাস বয়ে নিয়ে এল।
[নভেম্বরেই বাজছে সানাই, বিয়ের দিনক্ষণও পাকা রণবীর-দীপিকার!]
সাতজন মানুষের চারটি গল্প। একেবারেই আলাদা। হয়তো বা সময়টাও আলাদা। কিন্তু একটা জায়গায় এসে মিলে যায়। এক সময় এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসার পূর্ণেন্দু (আদিল) আর রমোনার (পাওলি) সখ্যতার পাশাপাশি চারুলতার (মমতা শংকর) পরবর্তী সময়ে পাহাড়ির চিঠি-প্রেম না হয় বোঝা গেল। কিন্তু মাইকেল (ঋত্বিক) ও সুজি (পার্ণো) নামের দুই চোরের মাঝরাত্তিরে একই বাড়িতে ঢুকে পড়াটা চমকপ্রদ লাগলেও ওই খালি বাড়ির মালিক দশ দিনের জন্য বাইরে যাওয়ার বিষয়টি প্রশ্ন তোলে, তাহলে বাড়ির মালিক কি চারুলতাই? এবার প্রশ্ন, ঘটনাগুলোর সময়কাল কখন?
আবার ক্যানসার রোগে আক্রান্ত তিতলি(চিত্রাঙ্গদা) নায়ক দেবের ভক্ত। দেবের ‘চ্যাম্প’ ছবি মুক্তি পেয়েছে ২০১৭-এ। সেই দেব তিতলির সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। স্বপ্নে হলেও সময়ের এই আগুপিছু হওয়া নিয়ে দর্শক বিভ্রান্ত হতে পারেন। আর যদি ধরে নেওয়া যায় যে সবটাই ঘটেছে মনের কল্পনায়। আহারে! এমনটা যদি হত এমন ভাবনায়, তাহলে সেই কাব্যিক সুখময় এই ছবি প্রতীমকে অন্য জায়গা দেবে প্রয়োগিক ভাবনা ও কৌশলের ব্যবহারে।
[রণবীর নয়, ‘সঞ্জু’র চরিত্রে বলিউডের এই নায়ককেই পছন্দ ছিল প্রযোজকের]
তিনটি গল্পকে পরিচালক টুকরো টুকরো করে পাশপাশি সাজিয়েছেন। গল্পের একটি দৃশ্য নাটকীয় মুহূর্তে পৌঁছানোর মুহূর্তেই তিনি অন্য গল্পে সরে গিয়েছেন। তিনটির মধ্যে সেরা গল্প হচ্ছে বরুণ (অঞ্জন) আর চারুলতার এপিসোড। দু’জনেই একা, নিঃসঙ্গ। এক ওল্ডএজ হোমের বাসিন্দা। কথায় কথায় দু’জনের মধ্যে একটা বিনি সুতোর মালা কেমন করে যেন গাঁথা হয়ে যায়। বয়স্ক দু’টি মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। চারুলতা যেন বরুণের মধ্যেই ব্যাংককে দেখা বন্ধুকে আবার আবিষ্কার করেন। অসুস্থ তিতলির গল্পটাও মন ছুঁয়ে যায়। বাঁচতে চাওয়ার আকুতি, আর নায়ক দেবকে দেখার স্বপ্ন নিয়ে তিতলি মারণরোগকেও যেন জয় করতে চায়। চিত্রাঙ্গদা দারুণ অভিনয় করেছেন তিতলির এই চরিত্রে। ওঁর অভিনয়ই তিতলির জন্য মনখারাপ করায়। ছবির তৃতীয় গল্প দুই চোরকে নিয়ে। এটিই দুর্বলতম। দুই পাগল চোরের কার্যকলাপের মধ্যে কৌতুক মেশানো কিছু বাস্তব ছবি আছে ঠিকই, কিন্তু অন্য দু’টি গল্পের সঙ্গে এটির যোগাযোগটি স্পষ্ট না হওয়ায় কেমন বিচ্ছিন্ন মনে হয়। যদিও পার্ণো ও ঋত্বিক দু’জনেই অভিনয়ে খামতি রাখেননি। আর বরুণের ভূমিকায় অত্যন্ত সংযত এবং ব্যক্তিত্ব নিয়ে অঞ্জন দত্ত অতি নাটকীয় অভিনয় ছেড়ে একেবারেই স্বাভাবিক ও সুন্দর। ‘চিনি গো চিনি তোমারে’ গানেও গায়ক অঞ্জন অত্যন্ত সাবলীল। মমতাশংকরের সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। তাঁর অভিনয়ে ‘অভিনয়’ ব্যাপারটা নেই। সৌমিক হালদারের ক্যামেরা তাঁর সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছে। গীতিকার হিসেবে শ্রীজাত এখন পয়লা সারিতে। তবে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কলমেও গানটি বেশ ভাল বাঁধা হয়েছে। এই দু’টি গানই পুরো ছবির গায়ে শীতের সকালের হালকা কুয়াশার মতো জড়ানো। আর সেই কুয়াশার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে পরিচালকের কাব্যিক চেতনা! যে কারণে ‘আহারে মন’ একই সঙ্গে সিনেমা এবং কবিতা দুইই।