সমকামিতা কোনও অপরাধ নয়। সম যৌনতাকে স্বীকৃতি দিয়ে বৃহস্পতিবার যুগান্তকারী রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ভালবাসার নীল আকাশে আজ রামধনুর ছটা। খুশির হাওয়া সর্বত্র। sangbadpratidin.in-কে একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রতিক্রিয়া দিলেন পরিচালক সঞ্জয় নাগ। শুনলেন বিশাখা পাল
রবি ঠাকুর যতই বলুন, বাঁধ ভেঙে দাও। কিন্তু বাঁধ ভাঙতে গেলেই সমস্যা। গতানুগতিকতা পর্যন্ত ঠিক আছে। তার বাইরে বেরোতে গেলেই লালচোখ করে তাকিয়ে থাকবে ‘আধুনিক’ সমাজ। নীতি পুলিশের অনুগামীদের বিরুদ্ধে গিয়ে বেঁচে থাকা সহজ কাজ নয়। তা প্রতি পদক্ষেপে বোঝেন সমকামী বা রূপান্তরকামীরা। প্রকৃতি তাঁদের যেভাবে বানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে যেতে জোর করে সমাজ। নিজের সত্ত্বা টিকিয়ে রাখা মানে প্রতিনিয়ত লড়াই। তাতে অন্তত যদি আইনি সাহায্যও মিলত, হয়তো লড়াইটা অনেক সহজ হত। এতদিন সেটাই তাঁরা চেয়ে এসেছেন। আজ সেইসব মানুষের নিশ্চিন্তে শ্বাস নেওয়ার দিন। আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিযেছে, সমকামিতা অপরাধ নয়। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের তৈরি করা একটি আইন মেনে নেওয়া অযৌক্তিকতার নামান্তর।
স্বভাবকই রামধনুর রঙে আজ খুশির হাওয়া। এই প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য আমরা যোগাযোগ করেছিলাম পরিচালক সঞ্জয় নাগের সঙ্গে। খুশির খবর তাঁর মননের অন্দরমহলেও। প্রথমেই তিনি বললেন, এটা তো হওয়ারই ছিল। এই রায় বেশিদিন আটকে রাধা সম্ভব ছিল না। আর তাছাড়া এটা তো মানুষের মৌলিক অধিকার। এই আইন আজকের নয়, পরাধীন দেশের সময় এই আইন তৈরি হয়েছিল। তাই এটা ভাঙা তো অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় সমকামীদের মাথা সমাজের চোখে উঁচু করে দিল।
[ সমকামিতা কোনও অপরাধ নয়, ঐতিহাসিক রায় সুপ্রিম কোর্টের ]
পরিচালক আরও বলেছেন, তাঁর আশপাশের মানুষ, তাঁর সমকামী বন্ধুরা আজ নতুন করে বেঁচে থাকার রসদ পেলেন। আজকের দিনটি তাঁদের কাছে ‘ডে অফ সেলিব্রেশন’। আজ যদি ঋতুপর্ণ ঘোষ বেঁচে থাকতেন, তিনিও খুব খুশি হতেন। নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতেন তিনি। নিজের জায়গা খুঁজে পেতেন। তাঁর জীবনে শ্রেষ্ঠ কাজ ছিল ‘চিত্রাঙ্গদা’। নেহাত সহজ ছিল না এই ছবি করা। আজকের দিনেই সমকামিতা নিয়ে এত ছুঁৎমার্গ। আজ থেকে বছর ছয়েক আগে তো আরও ছিল। সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ‘চিত্রাঙ্গদা’ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল ঋতুপর্ণকে। এমনকী সঞ্জয় নাগ যখন ‘মেমরিজ ইন মার্চ’ করেন, তিনিও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আজ, সুপ্রিম কোর্টের এই ঐতিহাসের রায়ের পর সেই মানুষটা স্বীকৃতি পেল। তাঁর কাজ স্বীকৃতি পেল।
তবে শুধু আইন করে চিরাচিরতি এই ধ্যানধারণা বদলানো যাবে না বলেই মনে করেন পরিচালক। তাঁর মতে, আইন এক জায়গায়। সে নিজের কাজ করেছে। কিন্তু তার মানে এই নয়, একটা কলমের আঁচড়ে সবকিছু বদলাবে। তা কখনই সম্ভব নয়। এর জন্য দায়িত্ব নিতে হবে মানুষকেই। সবে মিলি করি কাজ হলে তবেই এই আইন গ্রহণযোগ্য হবে। নাহলে কোর্টের রায়, রায়ই থেকে যাবে। তাকে বাস্তবে রূপ দিতে মানুষের অ্যটিটিউড পালটানো দরকার। তবে এই আইন সমাজকে বদলানোর পথ যে অনেক সুগম করে দিল, তা একবাক্যে স্বীকার করেছেন তিনি।
সমকামিতা অপরাধ নয়। কোনও দিক থেকেই অপরাধ নয়। একটি প্রাকৃতিক বিষয় কি করে অপরাধ হতে পারে? কিন্তু সমাজ তা বোঝে না। আজ যেখানে মানুষ এত উন্নত, সেখানে সমকামিতাকে অচ্ছুতের নজরে দেখা হয়। পরিচালক বলেছেন, তিনি তো এমনও শুনেছেন, ‘ও সমকামী। ওর কাছে না ঘেঁষাই ভাল।’ একবারও কেউ ভাবেনি, ওই মানুষটির কী মনে হতে পারে। আজ সেই মানুষগুলোর দিকে আঙুল তোলার আগে পুরনো ধ্যানধারণা আঁকড়ে বসে থাকা মানুষগুলো দু’বার অন্তত ভাববে। আর সেই মরমে মরে থাকা মানুষটি মাথা তুলে পথ চলতে পারবে। কারণ আইনত সে আজ স্বীকৃত।
[ মুক্তির দিন, যুগান্তকারী রায়ে উচ্ছ্বসিত রূপান্তরকামী বোর্ডের সদস্য রঞ্জিতা সিনহা ]
আর ঋতুপর্ণ ঘোষ? সারা জীবন সমকামিতাকে প্রতিষ্ঠা করতে লড়ে গিয়েছেন তিনি। তাঁর ‘চিত্রাঙ্গদা’ সেই লড়াইয়েরই বহিপ্রকাশ। তিনি বেঁচে থাকলে কী হত? অদ্বিতীয় এই মানুষটিকে অনেক কাছ থেকে দেখেছিলেন পরিচালক সঞ্জয় নাগ। তিনি বললেন, আজ ব্যক্তি ঋতুপর্ণের স্বীকৃতির দিন।
হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাঁকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। অনেক পাতা খরচ হয়েছে, শব্দ ব্যয় হয়েছে। কিন্তু ওই কালো অক্ষরগুলোর কখনও জীবন্ত হতে পারেনি। ঋতুপর্ণের লড়াই লড়াই হিসেবেই থেকে গিয়েছে। তিনি চেষ্টা করে গিয়েছেন। কিন্তু আমরা তাঁকে মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। তর্কের খাতিরে না হয় মেনেও নেওয়া গেল, ঋতুপর্ণের মতো পরিচালক ক্ষণজন্মা। তাঁকে কেন বাঙালি মানবে না? কিন্তু প্রশ্ন, ব্যক্তি ঋতুদাকে ক’জন মানতে পেরেছে? যাঁরা তাঁকে ভালবাসত, শ্রদ্ধা করত, তাঁর শিল্পীসত্তাই সেখানে প্রাধান্য পেত। কিন্তু শিল্পীর বাইরে তিনিও তো একজন মানুষ। তা বুঝল ক’জন? কোথাও তো আজ আমরা তাঁর কাছে ছোটই হয়ে আছি। মুখে শত স্বীকার করি, মনে এখনও ব্যক্তি ঋতুপর্ণ ব্রাত্য। আমাদের ‘বিজ্ঞ’ সমাজ ঋতুপর্ণকে মেনে নেওয়ার অনুমতি দেয়নি। কিন্তু আজ, তাঁকে আদালত স্বীকৃতি দিল। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরাও পারব। সত্যিই মন থেকে চাইব, “বনমালি তুমি পরজনমে হইও রাধা।”