Advertisement
Advertisement

Breaking News

Raja Rammohan Roy

ষোলো বছরে বাবা তাড়িয়ে দিতেই রামমোহন চলে যান তিব্বতে! এই মহাজীবন আজও বিস্মিত করে

আড়াইশোতম জন্মদিনের সামনে রাজা রামমোহন রায়।

Strange life of social reformer Raja Rammohan Roy। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:May 20, 2022 5:21 pm
  • Updated:May 21, 2022 12:38 am

বিশ্বদীপ দে: ‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা।’ কলকাতাকে চিনতে ‘হেঁটে দেখতে’ শেখার কথা বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। সেই কথাকেই আরেকটু সম্প্রসারিত করতে শুরু করলে এটা মনে হওয়া আশ্চর্যের নয় যে, এই হাঁটা কেবল আজকের শহর বা বাংলার মাটিতে নয়। হাঁটতে চাইলে সময় সরণি বেয়ে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় সেই সময়কালে যাকে আমরা বহু দূরে ফেলে এসেছি। এতদিন পরে সেই শহর, সেই হারানো সময়কে কার্যতই অলীক বলে মনে হয়। সেই ‘অলীক’ সময়কালের এক ‘অবিশ্বাস্য’ চরিত্রের বয়স আড়াইশো হবে আগামী রবিবার। যাঁর কথা ভাবতে বসলে মনে হবে, সত্যিই তো ‘রাজা’ ছাড়া তাঁর নাম কি সম্পূর্ণ হয়? আজকের বাঙালি, ইতিহাস বিস্মৃত বাঙালিও তাঁকে একডাকে চেনে। রাজা রামমোহন রায় (Raja Ram Mohan Roy) যে আজও  সমসাময়িক।

একসময় এই বাংলায় এমন অনেক রাজা ছিলেন, যাঁরা সিংহাসনে না বসেও রাজা। রাজা নবকৃষ্ণ, রাজা সুবোধচন্দ্র কিংবা রাজা রাজেন্দ্রলাল মল্লিক… আরও অনেকে। কিন্তু রাজার রাজা নিঃসন্দেহে রামমোহনই। এমন আশ্চর্য জীবন, ফিরে দেখতে বসলে বিস্মিত হতেই হয়। রক্ষণশীলতা, গোঁড়ামিকে পিছনে ফেলে নতুন দিনের স্পন্দন বুকে নিয়ে এগিয়ে চলার দাবি তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। লড়াইটা কেবল কঠিন নয়, ছিল প্রায় অসম্ভব! সেই যুদ্ধে জিততে পেরেছিলেন বলেই তো তিনি অপরাজেয়।

Advertisement
Raja Rammohan Roy
রাজা নন, তিনি রাজার রাজা

[আরও পড়ুন: ওজু না করেই জ্ঞানবাপীতে নমাজপাঠ, জল্পনায় সরগরম কাশীর হাওয়া]

আর এই লড়াইটা শুরু হয়ে গিয়েছিল বলতে গেলে শৈশব থেকেই। মাত্র ১২ বছর বয়সেই খানাকুলের রামমোহনকে কাশী পাঠিয়ে দেওয়া হয় সংস্কৃত শিখতে। ততদিনে আরবি, ফার্সিতে রীতিমতো দক্ষ হয়ে উঠেছেন তিনি। ওই ভাষাতেই ইউক্লিড, অ্যারিস্টটলদের বই পর্যন্ত পড়ে ফেলেছেন। এবার শুরু হল তাঁর সংস্কৃত পাঠ। বেদান্ত পড়তে পড়তেই তিনি দেখলেন একমাত্র ব্রহ্মই অনাদি, অনন্ত। এই সময় থেকেই পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই শুরু। এক বালকের যুক্তির সামনে পড়ে অসহায় হয়ে পড়ল কাশীর পণ্ডিত সমাজ। তাবড় তাবড় পণ্ডিতদের চ্যালেঞ্জ করে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি লিখে ফেললেন ‘হিন্দুদিগের পৌত্তলিক ধর্ম্মপ্রণালী’ নামের এক বই। ১৭৭৮ সালে বাংলা হরফে ছাপা বই ছিল না। ,এই হরফই তৈরি হয়নি তখনও। যদি থাকত তাহলে যে রামমোহনের এই বই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শোরগোল ফেলে দিত সে ব্যাপারে নিশ্চিত ইতিহাসবিদরা।

Advertisement

তবে বই ছাপার আকারে প্রকাশিত না হলেও কাশীতে (Kashi) সাড়া পড়তে সময় লাগেনি। একদিকে সাধারণ জনগণের প্রশংসা, অন্যদিকে পণ্ডিতদের রক্তচক্ষু- শেষ পর্যন্ত কাশী ত্যাগ করলেন রামমোহন। কিন্তু বাড়ি ফিরে রামমোহন বুঝলেন, জল গড়িয়ে গিয়েছে তাঁর বাড়ির অন্দরমহলেও। এতদিন পরে সন্তানকে কাছে পেয়েও মা গ্রহণ করলেন না প্রণাম। জানিয়ে দিলেন, ”আমার গৃহে বিধর্মীর স্থান নেই।”

Raja Rammohan Roy
ব্রিস্টলে রামমোহনের সমাধি

[আরও পড়ুন: হাই কোর্টের নির্দেশে চাকরি খোয়ালেন পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা, ফেরাতে হবে বেতনও]

বিদ্রোহের আঁচ এটুকুতেই আটকে থাকল না। ততদিনে সহমরণ প্রথার নিষ্ঠুর ছোবলে ভিতরে ভিতরে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছেন কিশোর রামমোহন। চোখের সামনে দেখেছেন কীভাবে এক তরুণী বিধবার শরীর আগুনের লেলিহান শিখার ভিতরে জোর করে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে! ভাল করে শাস্ত্র পড়ে রামমোহন বুঝে নিতে চাইলেন, সত্য়িই সেখানে এমন কিছু লেখা আছে কি না। স্বাভাবিক ভাবেই ছেলের এমন মতি দেখে প্রমাদ গুণলেন বাবা-মা। এ যে শোধরাবার নয়। তাঁরা দু’জনেই বোঝালেন ছেলেকে। ক্রমে তা গড়িয়ে গেল উত্তপ্ত তর্কের দিকে। রামমোহন যুক্তি সহকারে বুঝিয়ে ছাড়লেন, তিনি যা বলছেন তা শাস্ত্রবিরোধী নয়। বরং হিন্দু ধর্মকে নানা কুপ্রথার হাত থেকে রক্ষা করতেই তিনি চান। পরবর্তী সময়ে যে কথা তাঁর লেখাতেও আমরা পাই। রামমোহন লিখেছিলেন, ‘আমি কখনও হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করি নাই। উক্ত নামে বিকৃত ধর্ম এক্ষণে প্রচলিত তাহাই আমার আক্রমণের বিষয় ছিল।’ কিন্তু ছেলের কাছে হার মানতে রাজি ছিলেন না বাবা রামকান্ত। সটান জানিয়ে দিলেন, কোনও কূট তর্কে তাঁর রুচি নেই। এমন সন্তানের জন্ম দিয়ে তাঁর নিজেকে পাপী বলে মনে হচ্ছে।

কেবল বলাই নয়, ছেলেকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েই ছাড়লেন বাবা। এই বিতারণে যেন শাপে বরই হয়েছিল রামমোহনের। তিনি ঘুরে দেখলেন গোটা দেশ। ঠিক যেমন বিবেকানন্দ, নেতাজির মতো মহাপুরুষরাও করেছিলেন। বৈচিত্রময় এই দেশের নানা প্রান্তে যে বিভিন্নতা- ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির ভিতরে লুকিয়ে থাকা ঐক্যের সুর বুঝতে চেয়েছিলেন তাঁরা। এই অন্বেষণ রামমোহনও করেছিলেন। আর তারপর সেখান থেকে সোজা চলে গেলেন দুর্গম তিব্বতে! আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও যে স্থানের দুর্গমতা এতটুকু কমেনি। এক ষোলো বছরের কিশোর সেদিন কী করে যে সেখানে পৌঁছেছিলেন ভাবতে বসলে সত্যিই খেই মেলে না।

Raja Rammohan Roy
কেবল ইতিহাস নন, তিনি আজও ‘বর্তমান’

এমনই ছিলেন রামমোহন। পরবর্তী সময়ে যিনি আত্মীয়সভা গড়বেন, সতীদাহ প্রথাকে চিরতরে তুলিয়ে ছাড়বেন, স্ত্রীশিক্ষা প্রসার, কুসংস্কার দূরীকরণে অক্লান্ত সংগ্রাম করে নবজাগরণের মশালকে এগিয়ে নিয়ে চলবেন, তাঁর সেই সংগ্রামের ভিত্তিপ্রস্তর কিন্তু স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল কিশোরবেলাতেই। পরবর্তী সময়ে পূর্ণবয়স্ক রামমোহনের যে বর্ণনা পাই, সেখানে দেখা যাচ্ছে তাঁর দৈর্ঘ্য ছিল ৬ ফুটেরও বেশি। যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া। কিন্তু তাঁর মানসিক দৈর্ঘ্য যেন ছাপিয়ে গিয়েছিল শারীরিক বিশালতার ব্যাপ্তিকেও। বুকের মধ্যে ধারাল ছোরা লুকিয়ে ঘুরতেন তিনি। হাতের লাঠিতেও গোপন তরোয়াল থাকত। এমন ডাকাবুকো ‘অ্যাটিটিউড’! 

দিল্লির বাদশা তাঁর মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলেন ‘রাজা’ উপাধির শিরোপা। খোদ ইংল্যান্ডের রাজা তাঁকে ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দেশ পেরিয়ে বিদেশেও নিজের রাজ্যপাট যেন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বাঙালির একাংশ অবশ্য এহেন মানুষকে ধিক্কারই জানিয়েছিল। পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কলকাতার রাজকাহিনি’তে পাচ্ছি, সেই সময় ছড়া বাঁধা হয়েছিল ‘সুরাই মেলের কুল/ বেটার বাড়ি খানাকুল/ ওঁ তৎসৎ বলে বেটা/ বানিয়েছে ইস্কুল।’ বাড়িতে পড়েছিল ঢিল। লোকটা কিনা মেয়েদের পড়াশোনা করাতে চায়। সতীদাহ প্রথা তুলে আমাদের ধর্ম কর্ম শিকেয় তুলে দিচ্ছে! এই ছিল সমাজের বড় এক অংশের মনোভাব। তবু তিনি পরোয়া করেননি। নিজের কাজ করে গিয়েছেন। আসলে ‘রাজা’রা তো এমনই হন।

Raja Rammohan Roy
ছবির পর্দায় রামমোহনের ভূমিকায় বসন্ত চৌধুরী

সনৎ মিত্রের বিখ্যাত বই ‘ভারত পথিক রামমোহন’-এ লেখা হয়েছে, ‘রামমোহনের আবির্ভাব শুধু সমাজ সংস্কারক ও ধর্ম সংস্কারক হিসেবে নয়, তিনি এসেছিলেন মুমূর্ষূ জাতির শিয়রে পিতা-মাতা রূপে।’ এই উচ্চারণ যথার্থ ও অমোঘ। এমন অভিভাবককে আমাদের আজও প্রয়োজন। সমাজের সমস্ত গোঁড়ামি ও রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে রুখে চলার যে মন্ত্র তিনি রেখে গিয়েছেন তা শতকের পর শতক পেরিয়েও সমসাময়িক। আড়াইশো বছরে পা দিয়েও তিনি ইতিহাসের পাতার কোনও অধ্যায় মাত্র নন, এই সময়েরই এক মুখ। আসলে এমন মানুষদের তো কালখণ্ডের নিক্তিতে বেঁধে রাখা যায় না। তাঁরা সমসময়কে ছাপিয়ে, নিজের আয়ুষ্কালকে পেরিয়ে গিয়ে হয়ে উঠতে থাকেন চিরনতুন, হয়ে ওঠেন চিরকালীন। 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ