নির্মল ধর: অভিযানের ছবি আমরা অনেক দেখেছি। বেশিরভাগই হলিউড বা ইউরোপের। এখনও ভোলা যায় না পাতাগোনিয়ার মরুভূমিতে অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে ক্রিস মোলের ছবি ‘১৮০ ডিগ্রি সাউথ’। কিংবা সিডনি পোলকের পুরনো ছবি ‘আউট অফ আফ্রিকা’। অবশ্যই এই ছবিগুলোর পিছনে রয়েছে সত্যকাহিনি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি ছিল ‘চাঁদের পাহাড়‘। সেই কাহিনি থেকেই শংকরের চরিত্রকে তুলে এনে নিজের মতো করে কাহিনি লিখেছেন পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
ঘটনার সময়কাল ১৯১৫। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। বাবা মার্কো ফ্লোরিয়ান আমাজনিয়ার গভীর জঙ্গলে ‘এলডোরাডো’ অভিযানে গিয়ে জাহাজ ডুবে গেলে কোনওভাবে বেঁচে ফেরেন। কিন্তু হারিয়ে যায় বোতলের মধ্যে রাখা এলডোরাডোর পথের মানচিত্রটি। অভিযান অসাফল্যের কারণে মার্কো এখন হতাশায় মাতাল। মেয়ে অ্যানা ফ্লোরিয়ান বাবার সেই স্বপ্নের অভিযান পূর্ণ করতে বাংলাদেশের অজগ্রাম কেউটিয়াতে আসে শংকর চৌধুরিকে অভিযানে সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য। শংকর যায়ও। প্রথমে দীর্ঘ সমুদ্র সফরের পর বৃদ্ধ মার্কো, মেয়ে অ্যানা, এবং শংকর উপস্থিত হয় ব্রাজিলের বন্দর পোর্ট অফ স্যান্টোসে। চিত্রনাট্য এরপর ধারাবাহিকভাবে তাদের সেই স্বপ্নের জায়গা সিটি অফ মানাউস যাত্রার দীর্ঘ ধারাবিবরণ দিয়েছে।
প্রথমত, আমাজন নদীর বিশাল অববাহিকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা উপনদী, শাখানদীর মধ্যেই ঘুরে বেড়িয়েছে চিত্রনাট্য। নাটক তৈরিতে তেমন মনোযোগ দেননি পরিচালক। ফলে ওদের অভিযানের মধ্যে রোমহর্ষক এবং রোমাঞ্চকর পরিস্থিতিগুলো একেবারেই সাদামাটা হয়ে থেকে যায়। দর্শকের মনে কোনও বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয় না। অথচ আমাজন অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য, গহিন নদী, পদে পদে অজানা বিপদের হাতছানি, অচেনা পশুপ্রাণীর আক্রমণ এইসব নিয়েই চিত্রনাট্য জমজমাট হতে পারত। কিন্তু পরিচালক ভ্রমণের ধারাবাহিকতার উপরই জোর দিয়েছেন, অ্যাডভেঞ্চারের উপর নয়। যে কারণে অ্যানাকোন্ডা বধ বা চিতাবাঘের সঙ্গে লড়াই পর্ব একেবারেই বালখিল্যসুলভ। অ্যানাকোন্ডা যেভাবে মার্কোর পুরো মুণ্ড মুখের মধ্যে নিয়েও ছেড়ে দিল, সেটা কেন বোঝা গেল না। আবার শংকর প্রতিশোধ নেবে এটা কি অ্যানাকোন্ডা জানত? নইলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একই জায়গায় মৃত্যুফাঁদে সে পা দেবে কেন! আসলে হয়েছে কী, পরিচালক লোকেশনের কুমারী সৌন্দর্যে এতটাই বিভোর হয়েছিলেন যে ঘটনার মধ্যে তো বটেই চরিত্রগুলির পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রেও নাটককে কোনও গুরুত্বই দেননি। এমনকী বিভিন্ন উপজাতির সঙ্গে মার্কোর সখ্যতার পর্বগুলোও অনুপস্থিত থেকেছে। দর্শক অনেক সময়ই এই দীর্ঘ জলযাত্রা দেখতে একঘেয়ে বোধ করবেন। যদি না কেউ পরিচালকের মতোই ভ্রমণ সৌন্দর্যপিয়াসী হন। পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় মাঝেমাঝেই ধারাবিবরণী দিয়ে ছবির গতিকে ব্যাহত করেছেন তো বটেই, উপরন্তু বিভিন্ন জায়গার পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ নাম শুনিয়ে দর্শককে ক্লান্ত করে দেন। এটার দরকার ছিল না।
এ ছবির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সৌমিক হালদারের ক্যামেরার কাজ। তিনি বিভিন্ন দুরূহ অ্যাঙ্গেল থেকে পাহাড়ি অভিযানের ছবিগুলো বিশ্বাসযোগ্য করেই তুলেছেন। ব্যবহার করতে হয়েছে ড্রোন, হেলিকপ্টার এবং আধুনিক প্রযুক্তি। কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কাজ মন্দ নয়। কিন্তু এলডোরাডোর সেট যে বানানো, তা বারবারই প্রকট হয়েছে। চিত্রনাট্য কারণেই সম্পাদনায় রবিরঞ্জন মৈত্র কাহিনির গতিকে প্রত্যাশিত মাত্রায় নিয়ে যেতে পারেনি। তবে সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র ব্রাজিলের বিভিন্ন উপজাতির দেশজ সংগীতের সুর ব্যবহার করে ছবির পুরো শরীরেই এক ধরনের এথনিক আবহাওয়া জড়িয়ে দিয়েছেন। অভিনয়ে ডেভিড জেমস (মার্কো) এবং শ্বেতলানা (অ্যানা) বেশ ভাল। বিশেষ করে শ্বেতলানা ভাঙা বাংলায় সুন্দর কাজ চালিয়েছেন। শংকর হয়েছেন দেব। তিনিই অভিযানের প্রধান। কিন্তু চিত্রনাট্যে অভিযানের নাটক কতটুকু? ফলে নায়কোচিত হওয়ার বদলে দেবকে খুবই সাধারণ লেগেছে। একমাত্র জলে ঝাঁপানো আর অ্যানাকোন্ডার সঙ্গে বুদ্ধির লড়াইয়ে তিনি কিছুটা স্বাভাবিক। দেব এবং তাঁর দলবল ধরে নিতে পারি একমাসের অভিযানে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের পোশাক এবং রূপসজ্জায় কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। একমাত্র শেষ তিন-চারদিন বাদে।
‘আমাজন অভিযান’ অভিযানের ছবি হল না, হয়ে গেল বেড়ানোর ছবি। যা আমাজন নদীর মতোই শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দর্শককে বিভ্রান্ত করবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.